১৮ জুলাইয়ের নির্মম দুপুরে শহীদ হয় ইরফান

- আপডেট সময় : ০৯:১২:৩০ অপরাহ্ন, শনিবার, ৫ জুলাই ২০২৫
- / ২৫ জন পড়েছেন
২৩ বছর বয়সী ইরফান ভূঁইয়া ছিলেন স্বপ্নবাজ, সাহসী এবং মেধাবী এক তরুণ। বাবা-মা আর দুই বোনের চোখের মণি। ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের এই ছাত্র পড়ালেখা শেষ করে বাবার জমিতে একটি ঘর বানানোর স্বপ্ন দেখতেন। বাবাকে কথা দিয়েছিলেন, “লোন নেবো, নিজের হাতে তোমার জন্য বাড়ি বানাবো।” সেই স্বপ্ন পূরণ হওয়ার আগেই গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হলেন ইরফান। খুনি স্বৈরাচার সরকারের গুলিতে। তার বাবা মোঃ আমিনুল ইসলাম বলেন, “আমি নিজেই ওকে শেষবারের মতো ১০০ টাকা দিয়েছিলাম। ভাবিনি ওই টাকাই আমার সন্তানের শেষ যাত্রার খরচ হবে।”
ইরফান ভূঁইয়া জন্মগ্রহণ করেন ২০০১ সালের ১২ নভেম্বর, নরসিংদী জেলার নরসিংদী সদর উপজেলার সাতগ্রাম ইউনিয়নের কান্দাইল গ্রামে। পিতা মোঃ আমিনুল ইসলাম ভূঁইয়া প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন, আর মা মোসলেমা একজন গৃহিণী। দুই ছোট বোন বুশরা ও সায়মা এবার এইচএসসি পাশ করেছে। সন্তানদের পড়াশোনা নিয়েই ছিল পরিবারটির স্বপ্ন ও বিনিয়োগ। চাকরির সুবাদে আমিনুল ইসলাম পরিবার নিয়ে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের নিমাইকাশারী এলাকায় বাস করতেন। সেখানেই একটি ছোট জমি কিনে বাড়ি বানানোর পরিকল্পনা ছিল। আর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের সবচেয়ে বড় ভরসা ছিল বড় ছেলে ইরফান।
ইরফান ছোটবেলায় ডাক্তার হতে চাইতেন। পরে প্রযুক্তিপ্রেমী হয়ে উঠেন। ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগে। পড়াশোনার পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা ও ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। পরিবার জানতো না, সে আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক। পরিবারের চিন্তা না বাড়ানোর জন্য ইরফান সবার সামনে আন্দোলনের সমালোচনা করত, আর গোপনে লড়াই চালিয়ে যেত। তার বাবার ভাষায়, “আমাদের সামনে সে আন্দোলনের বিরোধিতা করত। পরে বুঝি, এটা ছিল একটা অভিনয়। আসলে ও চুপচাপ আমাদের চিন্তা না করিয়ে লড়ছিলো।”
১৮ জুলাই ২০২৪, বৃহস্পতিবার। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের “কমপ্লিট শাটডাউন” কর্মসূচির অংশ হিসেবে সকাল থেকে সারাদেশে ছাত্র-জনতা রাস্তায় নামে। সেদিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে বারবার গলা আটকে আসছিলো ইরফানের বাবার। সেদিন সকালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের নিমাই কাশারী এলাকায় নিজ বাসায় ছিলেন ইরফান। সকাল থেকে আমাশয়ে ভুগছিলেন ইরফান। কিন্তু বন্ধুদের বারবার ফোন পেয়ে আন্দোলনে যোগ দিতে যেতে চাইছিলো সে, বলেন; শোকার্ত বাবা আমিনুল।
পেটেরে সমস্যার জন্য সকাল থেকেই কিছু খেতে চাচ্ছিলো না কিন্তু বাহিরে যেতে চাইছিলো। মা দুপুর পর্যন্ত তাকে বাসায় আটকে রাখতে পারলেও ছেলের জেদের কাছে হার মানতে হয় মাকে। শেষ পর্যন্ত জোহরের নামাজের সময় কিছু না খেয়েই বেরিয়ে পড়েন ইরফান। আন্দোলনে যোগ দিতে সরাসরি চলে যান যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়ায়।
“ইরফান আন্দোলনে যাওয়ার ব্যাপারে একরোখা মনোভাব দেখালে আমি ওর মাকে বলি, ওকে ১০০ টাকা দিয়ে দিতে, যেন যাতায়াত করতে পারে। কখনো ভাবিনি এটাই হবে ওর সঙ্গে আমার শেষ দেখা” কাঁদতে কাঁদতে বলেন আমিনুল।
“এখন মনে হয়, ওই টাকা দিয়েই আমি ছেলেকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছি” আফসোস করে বলেন তিনি।
আমিনুল জানান, তিনি জানতেন না যে সেদিন রাস্তায় পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ ছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নির্বিচারে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে হত্যা করছিলো নির্দয়ের মতো।
বিকেল ৩টা। যাত্রাবাড়ীর কাজলা টোলপ্লাজার পাশে ছাত্র-জনতার একটি বিশাল মিছিল। একদিকে সরকার পতনের গর্জন, অন্যদিকে স্বৈরাচার সরকারের পাল্টা নিপীড়ন। হঠাৎ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যৌথভাবে ছাত্রদের উপর হামলা চালায়। বিজিবি ও পুলিশ শুরু করে এলোপাতাড়ি গুলি। ইরফান তখন মিছিলের সামনের সারিতে। একটি গুলি ইরফানের পিঠে ঢুকে বাম দিক দিয়ে শরীরের ভেতরে আটকে যায় । ঘটনাস্থলেই নিথর হয়ে যান ইরফান। বন্ধুরা ছুটে নিয়ে যায় একাধিক হাসপাতালে। সালমান হাসপাতাল, আল মদিনা – কেউ তাকে ভর্তি নেয় না। পরে সদরঘাটের জাতীয় মেডিকেল ইনস্টিটিউটে নেওয়া হয়। বাবা আমিনুল ফোন পান আসরের নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বের হওয়ার সময়। তিনি স্মরণ করেন, ইউআইইউ-র ছাত্র ইরফানের বন্ধু পিয়ালই প্রথম তাকে দুঃসংবাদটি জানান। তিনি তখন আসরের নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বের হয়েছেন। ‘আংকেল, আপনাকে দ্রুত যাত্রাবাড়ী যেতে হবে। ইরফান গুলিবিদ্ধ হয়েছে, হাসপাতালে আছে,’ জানান পিয়াল। সেখানে পৌঁছার আগেই সব শেষ। তিনি বলেন, “গিয়ে দেখি আমার ছেলের নিথর দেহ পড়ে আছে। ওর মুখে তখনো একটা শান্তির ছাপ। মনে হচ্ছিল, যেন বলছে — আমি লড়েছি। আমি শেষ পর্যন্ত পেরেছি।”
ইরফানের স্বপ্ন ছিল একটা মোটরসাইকেল কেনার, একটা ল্যাপটপ কেনার। পড়ালেখা শেষে ছোট্ট জমিতে নিজের হাতে বাবা-মার জন্য ঘর বানানোর। সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। সেই জমি আজও খালি পড়ে আছে। সেখানে এখন শুধু ইরফানের স্মৃতি। পরদিন সকালেই তাকে দাফন করা হয় নরসিংদীর কান্দাইল গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে। পরিবারে নেমে আসে শোকের ছায়া। মা মোসলেমা এখনো ছেলের ছবি বুকে চেপে কাঁদেন। বাবা বলেন, “আমার স্ত্রী সারাদিন চুপচাপ থাকে। রাতে ঘুমাতে পারে না। আমাকে দোষ দেয়, কেন ছেলেকে যেতে দিলাম। আমি আর কী বলি?” ইরফানের পরিবারকে “জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন” থেকে ৫ লাখ টাকা এবং জামায়াত থেকে ২ লাখ টাকা দেওয়া হয়। তারা এক টাকাও রাখেননি। বাবার কণ্ঠে তখনো দৃঢ়তা, “আমার ছেলের স্বপ্ন আমি পূরণ করতে পারিনি, সেই দান আমি নিতে পারি না। সব টাকা মসজিদে দিয়ে দিয়েছি।” তারা যাত্রাবাড়ী থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন, যেখানে সরকারের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের দায়ী করা হয়েছে। কিন্তু বিচার মিলেনি।
একজন শহীদের অসমাপ্ত স্বপ্ন। ইরফানের মৃত্যুর পর শুধু একটি পরিবার না, কেঁদেছে পুরো ইউনিভার্সিটি, কেঁদেছে সহপাঠীরা। তার বাবা বলেন, “ছেলের স্বপ্ন ছিল, দুই বোনকে ডাক্তার বানাবে। আজ তারা দোয়া করে, ভাইয়ার রক্ত বৃথা না যাক।” ইরফান শহীদ হয়েছেন রাষ্ট্রের অন্যায়ের বিরুদ্ধে, একটি সুবিচারের সমাজের জন্য। তার শহীদ হওয়া মানে শুধু একটি জীবন নয়, এটি একটি সম্ভাবনার শেষ, একটি ঘরের স্বপ্নের অপমৃত্যু। তিনি আজ কবরেই আছেন, কিন্তু তার স্বপ্ন, সাহস, প্রতিবাদ বেঁচে আছে লাখো তরুণের হৃদয়ে।