হোটেল বয় থেকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সৈনিক
হোটেল বয় থেকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সৈনিক

- আপডেট সময় : ০৪:৩৫:৩৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৭ জুলাই ২০২৫
- / ১২ জন পড়েছেন
আল আমীন মাহমুদ অর্ণব
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে পুলিশের গুলিতে নিহত শাহীন মিয়া (১৯) ছিলেন একজন হোটেল ম্যানেজার, একজন গরিব ঘরের সন্তান এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন নীরব সহযোদ্ধা। তাকে হত্যা করা হয়েছে ২০ জুলাই ২০২৪, বিকেলে নারায়ণগঞ্জের চট্টগ্রাম রোড সংলগ্ন নিউ হীরাঝিল হোটেলের ভেতরে। দোকানের ঝাঁপ নামিয়ে আত্মরক্ষা করেও শেষ রক্ষা হয়নি। হাসিনা সরকারের স্বৈরাচারী বাহিনী ঢুকে পড়ে গায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে হত্যা করে এই নিরীহ তরুণকে। এই ঘটনাটি এখন শহরজুড়ে এক শোকের নাম, এক প্রতিরোধের আহ্বান।
শহীদ শাহীনের জন্ম ২০০৫ সালের ১৬ জানুয়ারি বরিশালের হিজলা থানার ঘুন্না গোবিন্দপুর গ্রামে। বাবা হাসান আলী এবং মা নাজমা বেগম, দুজনেই দিনমজুর শ্রেণির সাধারণ মানুষ। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাজীবনের পর পরিবারের অভাব-অনটনের কারণে মাত্র দশ বছর বয়সেই বাবা-মায়ের সাথে ঢাকায় পাড়ি জমান শাহীন। শুরু হয় কঠিন বাস্তবতার সঙ্গে জীবন সংগ্রাম। নারায়ণগঞ্জ-চট্টগ্রাম রোড সংলগ্ন নিউ হীরাঝিল হোটেলে একটি সহকারী পদে কাজ শুরু করেন।
ধীরে ধীরে সেই ছোট্ট কর্মচারী হয়ে ওঠেন হোটেলের সবচেয়ে আস্থাভাজন ম্যানেজার। নিজের পরিশ্রম, সততা এবং কর্তব্যনিষ্ঠার জন্য সকলের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। ছোট ভাই শামীমকেও একই হোটেলে নিয়ে এসেছিলেন কাজে। একটি নিম্নবিত্ত পরিবারের জন্য যা ছিল এক ধরনের স্থিতিশীলতা।
যদিও শাহীন সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, তবে ছাত্র আন্দোলনের প্রতি তার ছিল প্রবল সমর্থন। তিনি বিশ্বাস করতেন এই রাষ্ট্রব্যবস্থায় বৈষম্য ও দমননীতির অবসান দরকার। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজি এই তরুণ কখনো অন্যায় সহ্য করতেন না। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে চলমান অবিচার, দুর্নীতি ও পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে তার ছিল তীব্র প্রতিবাদ। বন্ধু ও সহকর্মীদের জানান, শাহীন সবসময় বলতেন, “আল্লাহ যেন এই স্বৈরাচারী সরকারকে দ্রুত পতন করান”। তার সেই কামনা বাস্তব হলো কিন্তু শাহীন তা দেখে যেতে পারলেন না।
১৪ জুলাই থেকে দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলন শুরু হলে সরকার কঠোর অবস্থান নেয়। ১৯ জুলাই মধ্যরাতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয় এবং ২০ জুলাই বিকেল থেকে নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় সহিংস দমনপীড়ন শুরু করে পুলিশ ও সেনা-বিজিবির সমন্বিত বাহিনী সাথে সরকার মদদপুষ্ট ছাত্রলীগ-যুবলীগের সন্ত্রাসী বাহিনী।
বিকেলে চিটাগাং রোড এলাকায় চলমান মিছিলে পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। তখন অসংখ্য মানুষ আশ্রয়ের জন্য ছোটাছুটি করে। শাহীন ও হোটেলের অন্যান্য কর্মচারীরা দোকানের ঝাঁপ নামিয়ে ভিতরে লুকিয়ে পড়ে। তাদের বিশ্বাস ছিল দোকানের ভেতর নিরাপদ থাকবে। কিন্তু বাস্তবতা ছিল নিষ্ঠুর। কয়েকজন ছাত্রজনতা প্রাণ বাঁচাতে হোটেলের ভেতরে ঢুকলে কিছুক্ষণ পরই সশস্ত্র পুলিশ হোটেলের ঝাঁপ তুলে ঢুকে পড়ে।
পুলিশ সদস্যরা কাউকে কিছু না বলে হোটেলের ভিতরে থাকা মানুষদের মারধর করতে থাকে। হোটেলের মালিক প্রাণভিক্ষা করে বলেন, “আমরা আন্দোলন করিনি, দয়া করে ছেড়ে দিন।” কিন্তু তারা তা শোনেনি। পুলিশ শাহীনকে লক্ষ্য করে বন্দুক ঠেকিয়ে দুটি গুলি করে। রক্তে ভেসে যায় হোটেলের মেঝে। মালিক নিজেও গুলিবিদ্ধ হন, তবে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান।
শাহীনের পিতা হাসান বাড়ি বলেন, “আমার শাহীন সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতো। কখনো কোনো অন্যায় করেনি। সে তো আন্দোলনেও ছিল না। তবু হোটেলে ঢুকে ওকে গুলি করলো। পুলিশের কি কাজ মানুষ হত্যা করা? আমি আমার ছেলের হত্যার বিচার চাই।”
তার মা নাজমা বেগম আজ নিস্তব্ধ। একমাত্র বড় ছেলেকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ। গরিব সংসারের প্রধান ভরসাটুকু চিরতরে হারিয়ে গেছে। ছোট ভাই শামীম এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না, তার ভাইকে সেদিন চোখের সামনে মেরে ফেলা হয়েছে।
ঘটনার পর পুলিশের পক্ষ থেকে লাশ হস্তান্তরেও গড়িমসি করা হয়। বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী শাহীনের লাশ নিয়ে মিছিল করতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয় এবং অনেককে মারধর করে। পরে পরিবারের অনুরোধ এবং স্থানীয় মানুষের চাপে শাহীনের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
বরিশালের নিজ গ্রাম ঘুন্না গোবিন্দপুরে গ্রামের মানুষদের উপস্থিতিতে জানাযা ও দাফন সম্পন্ন হয়। এলাকার মানুষ এই হত্যার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেন, “একজন কিশোরকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, তা কোনো সভ্য রাষ্ট্রের কাজ হতে পারে না।”
শহীদ শাহীন এখন শুধুই একজন নিহত হোটেল কর্মচারী নন তিনি হয়ে উঠেছেন দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে একটি প্রতীক, একটি প্রতিবাদ। যারা বৈষম্যহীন, দুর্নীতিমুক্ত, বাকস্বাধীনতা রক্ষা আর ভোটাধিকারের বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে তাদের হৃদয়ে শাহীন বেঁচে থাকবেন বহুদিন। তার রক্তের বিনিময়ে পতিত হয়েছে এক স্বৈরাচারী সরকার, তবে শহীদের আত্মা আজো ন্যায়বিচারের অপেক্ষায়।