বাড়ছে জনদুর্ভোগ, গার্মেন্টস শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব
পঞ্চবটী-মুক্তারপুর সড়কের বেহাল দশা

- আপডেট সময় : ০৪:০২:৪৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ২২ জুন ২০২৫
- / ৪৫ জন পড়েছেন
নারায়ণগঞ্জের অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র ফতুল্লা বিসিক শিল্প এলাকা এবং মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুরের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী পঞ্চবটি-মুক্তারপুর ৬ লেন সড়কের নির্মাণ কাজ চলছে বছরের পর বছর ধরে। অথচ কাজের অগ্রগতি আশানুরূপ নয়। অব্যবস্থাপনা, ধীরগতি, সমন্বয়ের অভাব এবং বর্ষার মরশুমি প্রতিবন্ধকতা সব মিলিয়ে এই গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো প্রকল্পটি যেন সাধারণ মানুষের জন্য গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে।
প্রতিদিন এই সড়কে পণ্য পরিবহনকারী হাজার হাজার যানবাহন এবং কয়েক লাখ সাধারণ মানুষ চলাচল করে। বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জের বিসিক শিল্পনগরী, মুক্তারপুরের সিমেন্ট ও হিমাগার শিল্প এবং আশপাশের অসংখ্য গার্মেন্টস কারখানার শ্রমিক-কর্মচারীদের চলাচলের প্রধান মাধ্যম এই সড়ক। কিন্তু নির্মাণাধীন অবস্থায় পড়ে থাকায় প্রতিনিয়ত তাদের পোহাতে হচ্ছে সীমাহীন দুর্ভোগ।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায় পথ যেন আর পথ নেই, যেন যুদ্ধের ময়দান। খানাখন্দে ভরা, কোথাও আবার কাটা ড্রেনের মুখ খোলা, কোথাও উঁচু নিচু ডিভাইডার আর নির্মাণ সামগ্রী ছড়িয়ে ছিটিয়ে। এমন পরিস্থিতিতে প্রতিদিন হাজার হাজার শ্রমিক কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য এই সড়ক ব্যবহার করেন। রিকশা, অটোরিকশা এমনকি মোটরসাইকেলেও ঝুঁকি নিয়েই যাত্রা করতে হয়।
ফতুল্লার একটি পোশাক কারখানার কর্মী সুমন বলেন, “ভোরে বের হয়ে সময় মতো অফিসে পৌঁছাতে পারি না। একটানা পায়ে হেঁটে, কাদা ডিঙিয়ে যেতে হয়। ফিরতি পথে আবার একই অবস্থা। বৃষ্টি হলে তো পথে চলাই যায় না।”
আরেক গার্মেন্টস কর্মী রোকসানা বেগম বলেন, “গতকাল এক রিকশা উল্টে পড়ে আমার সহকর্মীর পায়ে সেলাই দিতে হয়েছে। এত ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন অফিসে যাওয়া মানে একটা মানসিক শাস্তি।”
এই সড়কে প্রতিদিন হাজার হাজার ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও মিনি ট্রাক চলাচল করে। যারা পোশাক, সিমেন্ট, খাদ্যপণ্য, কাঁচামাল, হিমায়িত পণ্য বহন করে। নির্মাণাধীন রাস্তায় ধীরগতির যানবাহন ও ট্র্যাফিক জটের কারণে সময়মতো পণ্য ডেলিভারি করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে ব্যবসায়িক ক্ষতির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক রপ্তানিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
বিসিক শিল্পনগরীর একজন মালিক জানান, “আমাদের এক্সপোর্ট গার্মেন্টসের নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকে। কিন্তু রাস্তার কারণে প্রতিনিয়ত সময়মতো পণ্য পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। এতে অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে, আবার ক্লায়েন্টদেরও ক্ষোভ বাড়ছে।”
তিনি আরও বলেন, “বৃষ্টি হলেই রাস্তা তলিয়ে যায়। পণ্যবোঝাই ট্রাক কাদায় আটকে থাকে। পণ্যের ক্ষতি হয়, কারখানার কর্মীরা সময়মতো পৌঁছাতে পারে না।”
মুক্তারপুর-পঞ্চবটি ৬ লেন মহাসড়ক প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ হচ্ছে প্রায় ১০ দশমিক ৩৭ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক। এর মধ্যে প্রায় ৯.৬ কিমি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে (দ্বিতল সড়ক) এবং বাকি অংশ অ্যাটগ্রেড চার থেকে ছয় লেনের রাস্তা। একই সঙ্গে থাকছে র্যাম্প, ওজন স্টেশন, টোল প্লাজা, গোলচত্বর ও সংযোগ সড়ক। প্রকল্পটির প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৬৫৯ কোটি টাকা। পরে তা বাড়িয়ে প্রায় ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়।
প্রথমে ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত মেয়াদ ধরা হলেও কাজের ধীরগতির কারণে তা বাড়িয়ে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা হয়েছে। চায়নার দুটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান “স্যানডং লুকিয়াও গ্রুপ” ও “স্যানডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেশন গ্রুপ” কাজটি বাস্তবায়ন করছে।
প্রকল্প পরিচালক মো. ওয়াহিদুজ্জামান জানান, “এখন পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি প্রায় ৬০ শতাংশ। নারায়ণগঞ্জ অংশে গোপচর এলাকায় অধিগ্রহণ সংক্রান্ত কিছু সমস্যা আছে, তাই সেখানে গতি কিছুটা কম। তবে আমরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই প্রকল্প শেষ করার লক্ষ্যে কাজ করছি।”
তবে স্থানীয়রা বলছেন, বাস্তবে কাজের অগ্রগতি আরও ধীর। কোথাও কোথাও মাসের পর মাস কাজ বন্ধ পড়ে থাকে। সাধারণ মানুষের নিরাপদ চলাচলের কোনো বিকল্প পথ বা বিকল্প পরিকল্পনাও নেই।
বিসিক মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও বিকেএমইএর সহ-সভাপতি মোরশেদ সারোয়ার সোহেল বলেন, “যানজট ও সড়ক ভোগান্তি এখন নারায়ণগঞ্জের নিত্যদিনের ঘটনা। কিন্তু পঞ্চবটি-মুক্তারপুর সড়কের অবস্থা আলাদাভাবে ভয়াবহ। বড় কোনো প্রকল্পের কাজ চললে সাধারণ মানুষ ও শ্রমিকদের চলাচলের ব্যবস্থা নিশ্চিত করেই কাজ করা উচিত। কিন্তু এখানে সেটা উপেক্ষিত।”
তিনি বলেন, “বৃষ্টি হলেই সড়কে জমে থাকা পানিতে পণ্যবোঝাই যানবাহন উল্টে পড়ে মালামাল নষ্ট হচ্ছে। আমাদের দাবি, দ্রুত কাজ শেষ করুন এবং ততদিন যেন একটি বিকল্প নিরাপদ যাতায়াত ব্যবস্থা রাখা হয়।”
প্রকল্পটি শেষ হলে পঞ্চবটি থেকে মুক্তারপুর হয়ে মুন্সীগঞ্জ, চট্টগ্রাম, বরিশাল, ভোলা, খুলনার মতো দক্ষিণাঞ্চলগামী যানবাহন সরাসরি এই পথে চলাচল করতে পারবে। ঢাকার ভেতর দিয়ে প্রবেশ না করেই পণ্য ও যাত্রী পরিবহন অনেক সহজ হবে। এতে যানজটও কমবে, পণ্য পরিবহন ব্যয় হ্রাস পাবে।
তবে প্রশ্ন হচ্ছে, যদি বর্তমান দুর্ভোগে মানুষ কর্মস্থলে যেতে না পারে, মালিকরা পণ্য পাঠাতে না পারে, অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে উন্নয়ন কার জন্য? কেন জনগণের কষ্টের বিনিময়ে উন্নয়ন?
পঞ্চবটি-মুক্তারপুর ৬ লেন মহাসড়ক একটি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো। এটি ভবিষ্যতের জন্য অপরিহার্য। তবে বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপে জনগণের নিরাপত্তা ও চলাচলের স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করা একটি মৌলিক দায়িত্ব।
বর্তমানে যে অবস্থা বিরাজ করছে, তা উন্নয়নের নামে জনজীবনকে ত্যাগে বাধ্য করা। কর্তৃপক্ষের উচিত দ্রুত কাজের গতি বাড়ানো, জনগণের দুর্ভোগ লাঘবে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সঠিক তদারকি নিশ্চিত করা।