সংবাদ শিরোনাম :
নারায়ণগঞ্জ-৩ (সোনারগাঁ) আসনে ধানের শীষ ঘিরে টানাপড়েন

চীফ রিপোর্টার
- আপডেট সময় : ০৮:৩৩:৫৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৮ জুন ২০২৫
- / ৬৫ জন পড়েছেন
নারায়ণগঞ্জ-৩ (সোনারগাঁ) আসন ঘিরে বিএনপির অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতা এবং জামায়াতের সুসংগঠিত উত্থান নির্বাচনী মাঠে ব্যাপক উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি থেকে একাধিক প্রার্থী মনোনয়নপ্রত্যাশী। অন্যদিকে, মাঠপর্যায়ে নিরবচ্ছিন্ন গণসংযোগ ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় শূরা সদস্য প্রিন্সিপাল ড. ইকবাল হোসাইন ভূঁইয়া, যিনি এই আসনে ধানের শীষের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছেন।
বিএনপির ঘরে পাঁচ প্রার্থী, কিন্তু একটি টিকিট
সোনারগাঁয়ে বিএনপি থেকে অন্তত পাঁচজন মনোনয়নপ্রত্যাশী মাঠে সক্রিয় রয়েছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন—
• মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী রেজাউল করিম,
• সোনারগাঁ উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও সাবেক চেয়ারম্যান আজহারুল ইসলাম মান্নান,
• নারায়ণগঞ্জ-৪ এর সাবেক সংসদ সদস্য ও উপজেলা চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন,
• স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা অধ্যাপক ওয়াহিদ বিন ইমতিয়াজ বকুল,
• যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ওয়ালিউর রহমান আপেল।
এই পাঁচজনের মধ্যে কিছু নেতা সংগঠনের জন্য কাজ করেছেন নীরবে-নিভৃতে, কেউ আবার বিগত দেড় দশকে রাজপথে থেকেছেন নিরলসভাবে।
এর মধ্যে সবচেয়ে অভিজ্ঞ ও সিনিয়র নেতা অধ্যাপক মোঃ রেজাউল করিম। নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনের তিন বারের সাবেক এমপি এবং মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী তিনি ২০০৩ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকারের মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। সেই সময় তিনি সংসদ সদস্য ছিলেন এই নারায়ণগঞ্জ-৩ আসন থেকেই। তৃণমূলে এখনো তার একটি ভোট ব্যাংক রয়েছে, যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তিনি মাঠে সক্রিয় ছিলেন না বলে বিস্তর অভিযোগ পাওয়া যায় তৃণমূল থেকে।
আজহারুল ইসলাম মান্নান দলের জন্য মাঠে সক্রিয় ছিলেন প্রতিটি আন্দোলনে। সোনারগাঁও বিএনপি’র একজন কর্মী বান্ধব নেতা হিসেবে পরিচিত আজারুল ইসলাম মান্নান। স্বৈরাচারী হাসিনার দীর্ঘ ১৬-১৭ বছর সোনারগাঁও বিএনপি নেতাকর্মীদের নিয়ে বিএনপির প্রতিটি কর্মসূচি রাজপথে আন্দোলন- সংগ্রামের মধ্যদিয়ে সফলভাবে পালন করেছেন আজহারুল ইসলাম মান্নান। জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ বিএনপি’র একজন ত্যাগী ও সফল নেতা সোনারগাঁও বিএনপি’র আহবায়ক আজহারুল ইসলাম মান্নান আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হবেন। দীর্ঘ যুগেরও বেশী সময় ধরে সোনারগাঁও বিএনপি’র অঙ্গ সংগঠনগুলোকে একত্র করে এক ছাতার নিচে ধরে রেখেছেন তিনি। বিগত সময় বিএনপির আন্দোলন সংগ্রাম ও গত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়ে মামলা-হামলায় নির্যাতিত নেতাকর্মীদের পাশে ছিলেন তিনি। নেতাকর্মীদের আইনি সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি তাদের বাড়ীতে খোঁজখবর নিয়েছেন নিয়মিত। বিএনপি’র কোন দলীয় কর্মসূচী আসলে নেতাকর্মীদের নিয়ে রাজপথে নেমে পড়েন এবং আন্দোলন-সংগ্রাম সফল করেন তিনি বলেন, “আমার নেতাকর্মীরা যখন নির্যাতিত, আমি তখন রাজপথে ছিলাম। পদ-পদবির জন্য নয়, আদর্শের রাজনীতি করি।”
অধ্যাপক ওয়াহিদ বিন ইমতিয়াজ বকুল একজন ক্লিন ইমেজধারী প্রার্থী হিসেবে তৃণমূলে পরিচিত। তিনি বিগত ১৫ বছর ধরে দলের দুঃসময়ে পাশে ছিলেন। ছাত্র রাজনীতি থেকে উঠে আসা এই নেতা বলেন, “ক্ষমতার রাজনীতি নয়, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার রাজনীতিতে বিশ্বাস করি।”
গিয়াস উদ্দিন আগে নারায়ণগঞ্জ-৪ (ফতুল্লা-সিদ্ধিরগঞ্জ) থেকে সংসদ সদস্য ছিলেন। এখন তিনি সোনারগাঁয়ে মনোনয়নপ্রত্যাশী। তবে এক আসন ছেড়ে অন্য আসনে যাওয়ায় তৃণমূলে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কিছু প্রশ্ন উঠেছে। সোনারগাঁ সরেজমিনে গিয়াস উদ্দিনের বিষয়ে এলাকার সাধারণ ভোটার সহ বিএনপি থেকেই বিরূপ মন্তব্য পাওয়া যায়। গিয়াস আসলে কি চান? উনি কি ৪ না-কি ৩ আসনে লড়বেন? এমন ধোঁয়াশা এখনও কাটেনি তৃণমূল বিএনপির নেতাকর্মীদের মাঝে। এবিষয়ে কথা বলতে গিয়াস উদ্দিনকে গত কয়েকদিনে একাধিকবার ফোন দিলে তিনি রিসিভ করেননি। ক্ষুদে বার্তা দিয়েও কোন সাড়া পাওয়া যায়নি।
ওয়ালিউর রহমান আপেল প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন, তবে তিনি রাজনৈতিক ময়দানে কতটা দক্ষ, তা নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে দলের অভ্যন্তরে।
সবমিলিয়ে এই পাঁচজনের মধ্যে যে কেউ যোগ্য হতে পারেন, তবে দলীয় ঐক্য বজায় না থাকলে ভাঙনের সম্ভাবনা থেকে যায়।
জামায়াতের মাঠ দখল: জনসম্পৃক্ততায় এগিয়ে ড. ইকবাল
এই আসনে বিএনপির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছেন জামায়াত নেতা ড. ইকবাল হোসাইন ভূঁইয়া। তিনি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় শূরা সদস্য। পেশায় প্রিন্সিপাল হওয়ায় শিক্ষিত ও সুদক্ষ বক্তা হিসেবেও তাঁর পরিচিতি রয়েছে।
তিনি সম্প্রতি সোনারগাঁয়ের ৩ কিলোমিটার খাল খনন, দরিদ্র পরিবারে খাদ্য সহায়তা, শিক্ষার্থীদের মাঝে বই বিতরণ, গরিবের মেয়ের বিয়েতে সহায়তা, চিকিৎসা ক্যাম্প ইত্যাদির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মাঝে আস্থা তৈরি করেছেন।
স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, “সরকারি কোনো সাহায্য ছাড়াই উনি যেভাবে খাল খনন করলেন, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। ওনার মতো নেতা আর কয়জন আছে?”
ড. ইকবাল হোসাইন বলেন, “আমরা জনগণের কল্যাণে কাজ করতে চাই। দলীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষ এখন সৎ ও সাহসী নেতৃত্ব খুঁজছে।”
খেলাফত মজলিসও আসছে মাঠে
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের নারায়ণগঞ্জ জেলা শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাওলানা শাহজাহান শিবলীকেও সোনারগাঁ থেকে নির্বাচন করার সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ইসলামপন্থী রাজনীতির একটি অংশ তাঁর সঙ্গে থাকলেও বাস্তবে তিনি বিএনপি বা জামায়াতের মতো তৃণমূলে সুসংগঠিত নন।
রাজনৈতিক সমীকরণে ধোঁয়াশা
বিএনপির একাধিক প্রার্থী থাকায় মনোনয়নপ্রাপ্তির আগে থেকেই সৃষ্টি হয়েছে বিভক্তি ও অভ্যন্তরীণ লবিং। দলের একাংশ মনে করছে, একজন সৎ, জনপ্রিয় ও আন্দোলনে সক্রিয় নেতাকেই মনোনয়ন দিলে জামায়াতকে ঠেকানো সম্ভব। অন্যদিকে কেউ কেউ বলছেন, জামায়াতের জনপ্রিয়তা এখন তৃণমূলে বাড়ছে, এবং বিএনপি ঐক্যবদ্ধ না হলে জামায়াত সুবিধা নিয়ে নিতে পারে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সিনিয়র বিএনপি নেতা বলেন, “দলীয়ভাবে আমাদের এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে—আমরা প্রার্থী দিয়ে ভোটে যাব, না কি কাউকে সমর্থন দেব। না হলে জামায়াত ভোট কেটে দিতে পারে।”
ভোটারদের চোখে: কে এগিয়ে?
সাধারণ ভোটারদের অনেকেই বলছেন, জামায়াত এবার ভিন্নভাবে মাঠে নেমেছে। শুধু ধর্মীয় ভোট নয়, তারা উন্নয়নকেও প্রাধান্য দিচ্ছে। তবে বিএনপি প্রার্থী চূড়ান্ত হলে দৃশ্যপট বদলে যেতে পারে। ভোটারদের একটি বড় অংশ এখনো ধানের শীষের প্রতি অনুগত, কিন্তু প্রার্থী বিতর্ক তাদের মনোজগতে প্রভাব ফেলছে।
ধানের শীষ কার হাতে যাবে?
সোনারগাঁয়ের নির্বাচনী মাঠে প্রধান লড়াই হবে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে—এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে বিএনপি যদি ঐক্যবদ্ধভাবে, সঠিক ও জনপ্রিয় প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনে নামে, তাহলে ধানের শীষ এখনো জয় পেতে পারে। অন্যথায় জামায়াত তাদের মাঠপর্যায়ের জনসম্পৃক্ততার মাধ্যমে বড় চমক দিতে পারে।
ট্যাগ :