ঢাকা ০৮:২৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৫, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যস্ত জামায়াত

সোজাসাপটা রিপোর্ট
  • আপডেট সময় : ১২:৪১:৩৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৫
  • / ১০৮ জন পড়েছেন

নারায়ণগঞ্জের রাজনীতি ঐতিহাসিকভাবে নানা রঙে রাঙানো। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও তাদের সহযোগী সংগঠনগুলোর পাশাপাশি শহর ও গ্রামাঞ্চলে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক ধারাও সবসময় সক্রিয় ছিল। বিশেষ করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী দীর্ঘদিন ধরে নীরবে হলেও তৃণমূল পর্যায়ে নিজেদের সাংগঠনিক ভিত্তি শক্ত করেছে। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নারায়ণগঞ্জের পাঁচটি আসনেই দলটির প্রার্থীরা ব্যাপক প্রচার প্রচারণায় ব্যাপক সাড়া দেখা যাচ্ছে।
নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে জামায়াতের দীর্ঘ সময়ের সাংগঠনিক উপস্থিতি থাকলেও ২০১৩ সালের পর থেকে দলটির প্রকাশ্য রাজনৈতিক কার্যক্রম অনেকটাই সীমিত ছিল। তবে দেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং নতুন প্রজন্মের অংশগ্রহণের সুযোগকে সামনে রেখে এবার দলটি নতুন উদ্যমে মাঠে নেমেছে। স্থানীয় পর্যায়ে সামাজিক সংগঠন, মসজিদভিত্তিক কার্যক্রম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যুবসমাজের সাংগঠনিক উদ্যোগ এবং মানবিক সেবামূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দলটি ধীরে ধীরে নিজেদের উপস্থিতি পুনর্গঠন করছে। ফলে আসন্ন নির্বাচনে তাদের প্রচারণা ব্যাপক সাড়া ফেলছে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ মজলিসের শুরা ও কর্মপরিষদ সদস্য এবং সামাজিক সংগঠন ‘রূপগঞ্জ উন্নয়ন ফোরাম’-এর সভাপতি আনোয়ার হোসেন মোল্লা। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ইসলামপন্থী রাজনীতির সাথে যুক্ত থেকে বিভিন্ন সময় স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। এর আগে তিনি জামায়াতে ইসলামীর হয়ে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন।
শিক্ষিত, সমাজসেবী ও জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে রূপগঞ্জের তরুণদের মধ্যে তার প্রভাব ক্রমশ বাড়ছে। স্থানীয় জনসাধারণের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো, ধর্মীয় ও সামাজিক উদ্যোগে সক্রিয় অংশগ্রহণের কারণে তার প্রচারণা এলাকায় নতুন আলোচনার সৃষ্টি করেছে। নির্বাচনী এলাকায় তিনি ‘নৈতিক রাজনীতি, সুশাসন ও জনগণের সেবা’কে মূল প্রতিশ্রুতি হিসেবে তুলে ধরছেন। তাঁর সাম্প্রতিক নানা রকম প্রচার-প্রচারণায় নেতা-কর্মীসহ সাধারণ ভোটারদেরও ব্যাপক সাড়া লক্ষ্য করা গেছে।
নারায়ণগঞ্জ-২ (আড়াইহাজার) আসনে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী অধ্যাপক ইলিয়াস মোল্লা। তিনি জেলা জামায়াতের সমাজকল্যাণ সম্পাদক এবং দুপ্তারা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান। শিক্ষিত, বিনয়ী ও পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির এই রাজনীতিক স্থানীয়ভাবে শিক্ষা ও সামাজিক উন্নয়ন কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছেন। তার নেতৃত্বে দুপ্তারা ও আশপাশের এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মানোন্নয়ন, রাস্তা-ঘাট নির্মাণ এবং মসজিদ-মাদরাসার উন্নয়নে বেশ কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে।
প্রচারণার শুরু থেকেই তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের কাছে যাচ্ছেন, বিশেষ করে তরুণ ও প্রথমবারের ভোটারদের মধ্যে তার প্রচারণা বেশ সাড়া ফেলছে। তার মূল বার্তা হলো, ‘নৈতিক সমাজ প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতি ও মাদকমুক্ত আড়াইহাজার গড়া’। বিএনপি ও অন্যান্য দলের অভ্যন্তরীণ বিভাজনের সুযোগে জামায়াত এখানে একটি ঐক্যবদ্ধ ও শৃঙ্খলাপূর্ণ সংগঠন হিসেবে নিজেদের তুলে ধরছে, যা স্থানীয় রাজনৈতিক মাঠে নতুন ভারসাম্য তৈরি করেছে।
নারায়ণগঞ্জ-৩ (সোনারগাঁ-সিদ্ধিরগঞ্জ) আসনে দলটির প্রার্থী কেন্দ্রীয় শুরা সদস্য ড. মো. ইকবাল হোসাইন ভুঁইয়া। তিনি একজন শিক্ষানুরাগী ও সমাজভিত্তিক গবেষক হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় পর্যায়ে পরিচিত। অতীতে তিনি উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন এবং ভালো পরিমাণ ভোটও পেয়েছিলেন। সোনারগাঁয়ের প্রাচীন ঐতিহ্য, ইতিহাস ও শিক্ষিত সমাজে তার গ্রহণযোগ্যতা উল্লেখযোগ্য।
এবার নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি শিক্ষার মানোন্নয়ন, যুব কর্মসংস্থান, স্থানীয় শিল্প পুনরুজ্জীবন এবং পরিবেশ রক্ষাকে প্রধান ইস্যু হিসেবে তুলে ধরছেন। শিক্ষিত সমাজের অনেকেই মনে করছেন, ড. ইকবাল হোসাইন ভুঁইয়ার উপস্থিতি সোনারগাঁর রাজনীতিতে একটি বিকল্প শক্তির উদ্ভব ঘটিয়েছে। সোনারগাঁ শিল্পাঞ্চলে কর্মরত তরুণ শ্রমিকদের মধ্যেও তার প্রচারণা ভালো সাড়া পাচ্ছে, কারণ তিনি শ্রমিক অধিকার ও জীবনমান উন্নয়নে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছেন।
নারায়ণগঞ্জ-৪ (ফতুল্লা) আসনে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী হিসেবে মাঠে আছেন দলটির কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য ও নারায়ণগঞ্জ মহানগর আমীর মাওলানা আব্দুল জব্বার। তিনি ইসলামী ছাত্র শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি হিসেবে ছাত্র রাজনীতি থেকে উঠে আসা একজন দক্ষ সংগঠক। ছাত্র জীবন থেকেই ইসলামী আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত এই নেতা দীর্ঘ সময় ধরে জামায়াতের নীতি, আদর্শ ও সাংগঠনিক শৃঙ্খলাকে ধরে রেখেছেন। ফতুল্লা অঞ্চলে তিনি ধর্মীয় নেতা হিসেবে যেমন প্রভাবশালী, তেমনি সমাজসেবী হিসেবেও পরিচিত।
নারায়ণগঞ্জের সবচেয়ে আলোচিত আসন ফতুল্লার একজন চৌকস নেতা হিসেবে দেখেন তাঁর নেতা-কর্মীরা। ফতুল্লা আসনের বিভিন্ন সময় দুর্যোগকালীন ত্রাণ বিতরণ, সামাজিক উন্নয়ন, মানুষের বিপদ-আপদে দ্রুত এগিয়ে আসা, যুব প্রশিক্ষণ ও দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহায়তা প্রদানে তিনি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। তার প্রচারণার মূল বার্তা হলো ‘পরিবর্তনের রাজনীতি, শান্তি ও সুশাসনের রাজনীতি’। স্থানীয়ভাবে তার শৃঙ্খলাপূর্ণ কর্মী সংগঠন, স্মার্ট প্রচার-প্রচারণা, মসজিদ কমিটি ও তরুণ প্রজন্মের অংশগ্রহণের কারণে ফতুল্লায় জামায়াতের মাঠ কার্যক্রম অন্যান্য আসনের চেয়ে বেশি চোখে পড়ছে। তাঁর প্রতিদিনের প্রচারণায় সাধারণের ব্যাপক সাড়া দেখা যায়।
নারায়ণগঞ্জ-৫ (সদর-বন্দর) আসনে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী হিসেবে মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য, জেলা ও মহানগরের সাবেক আমীর মাওলানা মঈনুদ্দিন আহমাদ। তিনি একাধারে একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিক ও ব্যবসায়ী। দীর্ঘদিন ধরে জামায়াতের নেতৃত্বে থাকার ফলে জেলা পর্যায়ে তার পরিচিতি ও প্রভাব গভীর। বিগত কয়েক দশক ধরে রাজনৈতিক প্রতিকূলতা, মামলা-হামলার মধ্যেও তিনি সংগঠন ধরে রেখেছেন। এবার নির্বাচনে তিনি তৃণমূল পর্যায়ে ঘরে ঘরে প্রচারণা চালাচ্ছেন এবং স্থানীয় ব্যবসায়ী ও শিক্ষিত শ্রেণির সমর্থন পাচ্ছেন। মঈনুদ্দিন আহমাদ প্রচারণায় ‘নৈতিক অর্থনীতি, জনগণের মালিকানা ও ন্যায্য বণ্টন ব্যবস্থা’ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করছেন। স্থানীয় বাজার, হাট, গলিপথ ও ধর্মীয় স্থানে তার উপস্থিতি প্রতিদিনই নজরে পড়ছে।
জামায়াতে ইসলামী এবার নির্বাচনে যে সাংগঠনিক প্রস্তুতি দেখাচ্ছে, তা তাদের আগের অবস্থানের তুলনায় অনেক বেশি পরিপক্ব ও পরিকল্পিত। বিভিন্ন আসনে তারা দলীয় প্রার্থীদের সঙ্গে সমন্বিতভাবে কেন্দ্রীয় নীতি ও নির্বাচনী ইশতেহার প্রচার করছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের ডিজিটাল প্রচারণাও সক্রিয়, যেখানে তরুণরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। স্থানীয় পর্যায়ে জামায়াতের কর্মীরা প্রচলিত পোস্টার-লিফলেট ছাড়াও দরজায় দরজায় গিয়ে সরাসরি ভোটারদের সঙ্গে কথা বলছেন, যা অন্য দলগুলোর প্রচারণা কৌশল থেকে কিছুটা আলাদা।
স্থানীয়রা বলছেন, জামায়াতে ইসলামী এখন আর কেবল একটি ধর্মভিত্তিক দল হিসেবে নয়, বরং সামাজিক পরিবর্তনের শক্তি হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করতে সচেষ্ট। তারা এখন ভোটারদের সামনে ধর্মীয় নৈতিকতার পাশাপাশি সুশাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনের প্রশ্নও তুলছে। এতে করে শহুরে ভোটারদের পাশাপাশি গ্রামের ভোটারদের মধ্যেও দলটির গ্রহণযোগ্যতা অনেকটা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
নারায়ণগঞ্জে জামায়াতের রাজনীতি সবসময়ই বিতর্ক মুক্ত। তারা সংঘাত নয়, সুষ্ঠু রাজনীতিতে পরিবর্তন চান। দলের এক কর্মপরিষদ সদস্য বলেন, “আমরা জনগণের মধ্যে ইসলামি মূল্যবোধ, সুশাসন এবং জবাবদিহিমূলক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে চাই। মানুষের ভোটই আমাদের শক্তি।”
তৃণমূল পর্যায়ে জামায়াতের প্রচারণায় দেখা যাচ্ছে দলীয় প্রতীক ছাড়াও প্রার্থীর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার ওপর বিশেষ জোর দেয়া হচ্ছে। রূপগঞ্জ থেকে বন্দর সব আসনেই দেখা যাচ্ছে মসজিদভিত্তিক দোয়া মাহফিল, স্বাস্থ্যসেবা ক্যাম্প, শিক্ষাসামগ্রী বিতরণ, রক্তদান কর্মসূচি, দরিদ্র পরিবারের সহায়তা, সামাজিক যেকোন সমস্যায় জনগণের পাশে দাঁড়ানোসহ নানা দৃষ্টিকাড়া আয়োজন। এইসব কার্যক্রমের মাধ্যমে দলটি সাধারণ মানুষের নিকটে নিজেদের সামাজিক ভূমিকা তুলে ধরে এগিয়ে চলেছে।
নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনী মাঠে এখন জামায়াতের ব্যানার, লিফলেট, স্লোগান ও র‌্যালিতে নতুন প্রাণচাঞ্চল্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শহরের রাস্তাঘাট, বাজার ও হাটে সাধারণ মানুষ এখন খোলামেলাভাবে জামায়াতের প্রার্থীদের নিয়ে আলোচনা করছে। তাদের প্রচারণায় দেখা যাচ্ছে পরিবারের সদস্যদের সক্রিয় অংশগ্রহণ, বিশেষ করে নারী ও তরুণ ভোটারদের মাঝে আগ্রহ।
সার্বিকভাবে বলা যায়, নারায়ণগঞ্জে জামায়াতে ইসলামী এবার এক নতুন রাজনীতির বার্তা নিয়ে মাঠে নেমেছে। দীর্ঘ নীরবতা শেষে তৃণমূল থেকে উঠে আসা তাদের এই প্রচারণা স্থানীয় রাজনৈতিক ভারসাম্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ভোটের দিন ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে দেখা যাচ্ছে—যে দলটিকে অনেকে নিষ্ক্রিয় ভাবছিল, তারা এখন ধীরে ধীরে জনসমর্থনের নতুন রূপ দেখাচ্ছে। আর সেই কারণেই বলা যায়, নারায়ণগঞ্জে জামায়াতের প্রচারণা এখন সত্যিই ব্যাপক সাড়া ফেলছে।

সংবাদটি সোস্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন

নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যস্ত জামায়াত

আপডেট সময় : ১২:৪১:৩৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৫

নারায়ণগঞ্জের রাজনীতি ঐতিহাসিকভাবে নানা রঙে রাঙানো। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও তাদের সহযোগী সংগঠনগুলোর পাশাপাশি শহর ও গ্রামাঞ্চলে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক ধারাও সবসময় সক্রিয় ছিল। বিশেষ করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী দীর্ঘদিন ধরে নীরবে হলেও তৃণমূল পর্যায়ে নিজেদের সাংগঠনিক ভিত্তি শক্ত করেছে। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নারায়ণগঞ্জের পাঁচটি আসনেই দলটির প্রার্থীরা ব্যাপক প্রচার প্রচারণায় ব্যাপক সাড়া দেখা যাচ্ছে।
নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে জামায়াতের দীর্ঘ সময়ের সাংগঠনিক উপস্থিতি থাকলেও ২০১৩ সালের পর থেকে দলটির প্রকাশ্য রাজনৈতিক কার্যক্রম অনেকটাই সীমিত ছিল। তবে দেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং নতুন প্রজন্মের অংশগ্রহণের সুযোগকে সামনে রেখে এবার দলটি নতুন উদ্যমে মাঠে নেমেছে। স্থানীয় পর্যায়ে সামাজিক সংগঠন, মসজিদভিত্তিক কার্যক্রম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যুবসমাজের সাংগঠনিক উদ্যোগ এবং মানবিক সেবামূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দলটি ধীরে ধীরে নিজেদের উপস্থিতি পুনর্গঠন করছে। ফলে আসন্ন নির্বাচনে তাদের প্রচারণা ব্যাপক সাড়া ফেলছে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ মজলিসের শুরা ও কর্মপরিষদ সদস্য এবং সামাজিক সংগঠন ‘রূপগঞ্জ উন্নয়ন ফোরাম’-এর সভাপতি আনোয়ার হোসেন মোল্লা। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ইসলামপন্থী রাজনীতির সাথে যুক্ত থেকে বিভিন্ন সময় স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। এর আগে তিনি জামায়াতে ইসলামীর হয়ে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন।
শিক্ষিত, সমাজসেবী ও জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে রূপগঞ্জের তরুণদের মধ্যে তার প্রভাব ক্রমশ বাড়ছে। স্থানীয় জনসাধারণের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো, ধর্মীয় ও সামাজিক উদ্যোগে সক্রিয় অংশগ্রহণের কারণে তার প্রচারণা এলাকায় নতুন আলোচনার সৃষ্টি করেছে। নির্বাচনী এলাকায় তিনি ‘নৈতিক রাজনীতি, সুশাসন ও জনগণের সেবা’কে মূল প্রতিশ্রুতি হিসেবে তুলে ধরছেন। তাঁর সাম্প্রতিক নানা রকম প্রচার-প্রচারণায় নেতা-কর্মীসহ সাধারণ ভোটারদেরও ব্যাপক সাড়া লক্ষ্য করা গেছে।
নারায়ণগঞ্জ-২ (আড়াইহাজার) আসনে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী অধ্যাপক ইলিয়াস মোল্লা। তিনি জেলা জামায়াতের সমাজকল্যাণ সম্পাদক এবং দুপ্তারা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান। শিক্ষিত, বিনয়ী ও পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির এই রাজনীতিক স্থানীয়ভাবে শিক্ষা ও সামাজিক উন্নয়ন কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছেন। তার নেতৃত্বে দুপ্তারা ও আশপাশের এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মানোন্নয়ন, রাস্তা-ঘাট নির্মাণ এবং মসজিদ-মাদরাসার উন্নয়নে বেশ কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে।
প্রচারণার শুরু থেকেই তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের কাছে যাচ্ছেন, বিশেষ করে তরুণ ও প্রথমবারের ভোটারদের মধ্যে তার প্রচারণা বেশ সাড়া ফেলছে। তার মূল বার্তা হলো, ‘নৈতিক সমাজ প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতি ও মাদকমুক্ত আড়াইহাজার গড়া’। বিএনপি ও অন্যান্য দলের অভ্যন্তরীণ বিভাজনের সুযোগে জামায়াত এখানে একটি ঐক্যবদ্ধ ও শৃঙ্খলাপূর্ণ সংগঠন হিসেবে নিজেদের তুলে ধরছে, যা স্থানীয় রাজনৈতিক মাঠে নতুন ভারসাম্য তৈরি করেছে।
নারায়ণগঞ্জ-৩ (সোনারগাঁ-সিদ্ধিরগঞ্জ) আসনে দলটির প্রার্থী কেন্দ্রীয় শুরা সদস্য ড. মো. ইকবাল হোসাইন ভুঁইয়া। তিনি একজন শিক্ষানুরাগী ও সমাজভিত্তিক গবেষক হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় পর্যায়ে পরিচিত। অতীতে তিনি উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন এবং ভালো পরিমাণ ভোটও পেয়েছিলেন। সোনারগাঁয়ের প্রাচীন ঐতিহ্য, ইতিহাস ও শিক্ষিত সমাজে তার গ্রহণযোগ্যতা উল্লেখযোগ্য।
এবার নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি শিক্ষার মানোন্নয়ন, যুব কর্মসংস্থান, স্থানীয় শিল্প পুনরুজ্জীবন এবং পরিবেশ রক্ষাকে প্রধান ইস্যু হিসেবে তুলে ধরছেন। শিক্ষিত সমাজের অনেকেই মনে করছেন, ড. ইকবাল হোসাইন ভুঁইয়ার উপস্থিতি সোনারগাঁর রাজনীতিতে একটি বিকল্প শক্তির উদ্ভব ঘটিয়েছে। সোনারগাঁ শিল্পাঞ্চলে কর্মরত তরুণ শ্রমিকদের মধ্যেও তার প্রচারণা ভালো সাড়া পাচ্ছে, কারণ তিনি শ্রমিক অধিকার ও জীবনমান উন্নয়নে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছেন।
নারায়ণগঞ্জ-৪ (ফতুল্লা) আসনে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী হিসেবে মাঠে আছেন দলটির কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য ও নারায়ণগঞ্জ মহানগর আমীর মাওলানা আব্দুল জব্বার। তিনি ইসলামী ছাত্র শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি হিসেবে ছাত্র রাজনীতি থেকে উঠে আসা একজন দক্ষ সংগঠক। ছাত্র জীবন থেকেই ইসলামী আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত এই নেতা দীর্ঘ সময় ধরে জামায়াতের নীতি, আদর্শ ও সাংগঠনিক শৃঙ্খলাকে ধরে রেখেছেন। ফতুল্লা অঞ্চলে তিনি ধর্মীয় নেতা হিসেবে যেমন প্রভাবশালী, তেমনি সমাজসেবী হিসেবেও পরিচিত।
নারায়ণগঞ্জের সবচেয়ে আলোচিত আসন ফতুল্লার একজন চৌকস নেতা হিসেবে দেখেন তাঁর নেতা-কর্মীরা। ফতুল্লা আসনের বিভিন্ন সময় দুর্যোগকালীন ত্রাণ বিতরণ, সামাজিক উন্নয়ন, মানুষের বিপদ-আপদে দ্রুত এগিয়ে আসা, যুব প্রশিক্ষণ ও দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহায়তা প্রদানে তিনি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। তার প্রচারণার মূল বার্তা হলো ‘পরিবর্তনের রাজনীতি, শান্তি ও সুশাসনের রাজনীতি’। স্থানীয়ভাবে তার শৃঙ্খলাপূর্ণ কর্মী সংগঠন, স্মার্ট প্রচার-প্রচারণা, মসজিদ কমিটি ও তরুণ প্রজন্মের অংশগ্রহণের কারণে ফতুল্লায় জামায়াতের মাঠ কার্যক্রম অন্যান্য আসনের চেয়ে বেশি চোখে পড়ছে। তাঁর প্রতিদিনের প্রচারণায় সাধারণের ব্যাপক সাড়া দেখা যায়।
নারায়ণগঞ্জ-৫ (সদর-বন্দর) আসনে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী হিসেবে মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য, জেলা ও মহানগরের সাবেক আমীর মাওলানা মঈনুদ্দিন আহমাদ। তিনি একাধারে একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিক ও ব্যবসায়ী। দীর্ঘদিন ধরে জামায়াতের নেতৃত্বে থাকার ফলে জেলা পর্যায়ে তার পরিচিতি ও প্রভাব গভীর। বিগত কয়েক দশক ধরে রাজনৈতিক প্রতিকূলতা, মামলা-হামলার মধ্যেও তিনি সংগঠন ধরে রেখেছেন। এবার নির্বাচনে তিনি তৃণমূল পর্যায়ে ঘরে ঘরে প্রচারণা চালাচ্ছেন এবং স্থানীয় ব্যবসায়ী ও শিক্ষিত শ্রেণির সমর্থন পাচ্ছেন। মঈনুদ্দিন আহমাদ প্রচারণায় ‘নৈতিক অর্থনীতি, জনগণের মালিকানা ও ন্যায্য বণ্টন ব্যবস্থা’ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করছেন। স্থানীয় বাজার, হাট, গলিপথ ও ধর্মীয় স্থানে তার উপস্থিতি প্রতিদিনই নজরে পড়ছে।
জামায়াতে ইসলামী এবার নির্বাচনে যে সাংগঠনিক প্রস্তুতি দেখাচ্ছে, তা তাদের আগের অবস্থানের তুলনায় অনেক বেশি পরিপক্ব ও পরিকল্পিত। বিভিন্ন আসনে তারা দলীয় প্রার্থীদের সঙ্গে সমন্বিতভাবে কেন্দ্রীয় নীতি ও নির্বাচনী ইশতেহার প্রচার করছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের ডিজিটাল প্রচারণাও সক্রিয়, যেখানে তরুণরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। স্থানীয় পর্যায়ে জামায়াতের কর্মীরা প্রচলিত পোস্টার-লিফলেট ছাড়াও দরজায় দরজায় গিয়ে সরাসরি ভোটারদের সঙ্গে কথা বলছেন, যা অন্য দলগুলোর প্রচারণা কৌশল থেকে কিছুটা আলাদা।
স্থানীয়রা বলছেন, জামায়াতে ইসলামী এখন আর কেবল একটি ধর্মভিত্তিক দল হিসেবে নয়, বরং সামাজিক পরিবর্তনের শক্তি হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করতে সচেষ্ট। তারা এখন ভোটারদের সামনে ধর্মীয় নৈতিকতার পাশাপাশি সুশাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনের প্রশ্নও তুলছে। এতে করে শহুরে ভোটারদের পাশাপাশি গ্রামের ভোটারদের মধ্যেও দলটির গ্রহণযোগ্যতা অনেকটা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
নারায়ণগঞ্জে জামায়াতের রাজনীতি সবসময়ই বিতর্ক মুক্ত। তারা সংঘাত নয়, সুষ্ঠু রাজনীতিতে পরিবর্তন চান। দলের এক কর্মপরিষদ সদস্য বলেন, “আমরা জনগণের মধ্যে ইসলামি মূল্যবোধ, সুশাসন এবং জবাবদিহিমূলক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে চাই। মানুষের ভোটই আমাদের শক্তি।”
তৃণমূল পর্যায়ে জামায়াতের প্রচারণায় দেখা যাচ্ছে দলীয় প্রতীক ছাড়াও প্রার্থীর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার ওপর বিশেষ জোর দেয়া হচ্ছে। রূপগঞ্জ থেকে বন্দর সব আসনেই দেখা যাচ্ছে মসজিদভিত্তিক দোয়া মাহফিল, স্বাস্থ্যসেবা ক্যাম্প, শিক্ষাসামগ্রী বিতরণ, রক্তদান কর্মসূচি, দরিদ্র পরিবারের সহায়তা, সামাজিক যেকোন সমস্যায় জনগণের পাশে দাঁড়ানোসহ নানা দৃষ্টিকাড়া আয়োজন। এইসব কার্যক্রমের মাধ্যমে দলটি সাধারণ মানুষের নিকটে নিজেদের সামাজিক ভূমিকা তুলে ধরে এগিয়ে চলেছে।
নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনী মাঠে এখন জামায়াতের ব্যানার, লিফলেট, স্লোগান ও র‌্যালিতে নতুন প্রাণচাঞ্চল্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শহরের রাস্তাঘাট, বাজার ও হাটে সাধারণ মানুষ এখন খোলামেলাভাবে জামায়াতের প্রার্থীদের নিয়ে আলোচনা করছে। তাদের প্রচারণায় দেখা যাচ্ছে পরিবারের সদস্যদের সক্রিয় অংশগ্রহণ, বিশেষ করে নারী ও তরুণ ভোটারদের মাঝে আগ্রহ।
সার্বিকভাবে বলা যায়, নারায়ণগঞ্জে জামায়াতে ইসলামী এবার এক নতুন রাজনীতির বার্তা নিয়ে মাঠে নেমেছে। দীর্ঘ নীরবতা শেষে তৃণমূল থেকে উঠে আসা তাদের এই প্রচারণা স্থানীয় রাজনৈতিক ভারসাম্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ভোটের দিন ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে দেখা যাচ্ছে—যে দলটিকে অনেকে নিষ্ক্রিয় ভাবছিল, তারা এখন ধীরে ধীরে জনসমর্থনের নতুন রূপ দেখাচ্ছে। আর সেই কারণেই বলা যায়, নারায়ণগঞ্জে জামায়াতের প্রচারণা এখন সত্যিই ব্যাপক সাড়া ফেলছে।