সংবাদ শিরোনাম :
ব্যবসায়ীরা বলছেন 'অপরিকল্পিত উন্নয়ন'
কালির বাজারে রাস্তা সংস্কারের নামে ধুঁকছে ওষুধের পাইকারি বাজার

চীফ রিপোর্টার
- আপডেট সময় : ০৭:৫৭:৩৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ১ জুন ২০২৫
- / ৫৮ জন পড়েছেন

{"remix_data":[],"remix_entry_point":"challenges","source_tags":[],"origin":"unknown","total_draw_time":0,"total_draw_actions":0,"layers_used":0,"brushes_used":0,"photos_added":0,"total_editor_actions":{},"tools_used":{},"is_sticker":false,"edited_since_last_sticker_save":false,"containsFTESticker":false}
নারায়ণগঞ্জের কালির বাজার জেলার অন্যতম বৃহৎ ওষুধের পাইকারি বাজার। প্রতিদিন এখান থেকে হাজারো খুচরা বিক্রেতা, পশু খামারি, ক্লিনিক এবং হাসপাতাল প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সামগ্রী ও পশুখাদ্য সংগ্রহ করে থাকেন। এখানে রয়েছে ফলের পাইকারি বাজারও। কিন্তু চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া রাস্তা সংস্কার কাজের কারণে গত চার মাস ধরে এই বাজারে নেমে এসেছে ভয়াবহ বিপর্যয়। খোঁড়া রাস্তা, পানি জমে থাকা, ধুলাবালি এবং কাদা-পানির কারণে ক্রেতা ও পণ্যবাহী যানবাহন উভয়েরই চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে ব্যবসায়ীরা পড়েছেন চরম ক্ষতির মুখে।
এই এলাকাটি মূলত ওষুধ, পোল্ট্রি ও গবাদিপশুর খাদ্য, অক্সিজেন সিলিন্ডার, সার্জিক্যাল আইটেম সহ নানা চিকিৎসা সামগ্রীর জন্য পরিচিত। রাস্তার দুরবস্থার কারণে এখন এসব সামগ্রীর সরবরাহ চেইন ভেঙে পড়েছে। দৈনিক পাইকারি বেচাকেনার পরিমাণ কয়েক কোটি টাকা হলেও চলমান পরিস্থিতিতে তা নেমে এসেছে একেবারে তলানিতে। দোকানে পণ্য আছে, কিন্তু ক্রেতা নেই। বাইরে থেকে গাড়ি ঢুকছে না, এমনকি হেঁটে দোকানে যেতেও মানুষ অনীহা দেখাচ্ছে।
বাজারের বহু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মাসিক লক্ষ লক্ষ টাকা লোকসানে পড়েছে। অনেক ব্যবসায়ী বাধ্য হয়ে দোকান আংশিক বন্ধ করে দিয়েছেন, কেউবা কর্মচারী ছাঁটাই করেছেন। অনেকে আবার ঋণ নিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন, যার ফলে মূলধন হারিয়ে ফেলার আশঙ্কায় রয়েছেন তারা। চলতি বছরের দুটি ঈদের মাঝামাঝি সময়ে এই রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য এলাকায় রাস্তার কাজ শুরু করায় প্রশ্ন উঠেছে প্রকল্প পরিকল্পনার যৌক্তিকতা নিয়েও।
এমনিতেই ব্যবসা মন্দা থাকা অবস্থায় এভাবে রাস্তা খুঁড়ে ফেলে রেখে কাজ ঝুলিয়ে রাখায় ক্ষতির পরিমাণ বেড়েছে কয়েক গুণ। রাস্তার পাশে দোকানগুলোর সামনে ইট, বালু ও খোয়া ফেলে রাখায় প্রবেশদ্বার বন্ধ হয়ে গেছে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের। পণ্য আনা-নেওয়ার জন্য যে ধরনের পরিবহন প্রয়োজন, সেই যানবাহন ঢুকতেই পারছে না বাজার এলাকায়। ফলে অনেকেই সময়মতো পণ্য ডেলিভারি দিতে পারছেন না, বিশেষ করে যেসব ব্যবসা জরুরি স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে জড়িত—তাদের সমস্যা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
রাস্তা সংস্কার কাজে ব্যবহৃত নির্মাণ সামগ্রীর মান নিয়েও স্থানীয়দের মাঝে ক্ষোভ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, নিম্নমানের ইটের খোয়া ও অপরিষ্কার বালু ব্যবহারের ফলে সংস্কারকাজের স্থায়িত্ব নিয়েও আশঙ্কা রয়েছে। রাস্তার কিছু অংশে পানি জমে দীর্ঘ সময় পড়ে থাকার ফলে নতুন করে রাস্তার ভেঙে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
যেসব দোকান স্বাস্থ্যসেবা, যেমন অক্সিজেন সিলিন্ডার সরবরাহ করে, তাদের কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ায় রোগী পরিবহন ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার ওপরও প্রভাব পড়ছে। খামারিদের প্রয়োজনীয় ওষুধ ও খাদ্য যথাসময়ে পৌঁছাতে না পারায় কৃষি খাতেও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে এই পরিস্থিতি।
বাজারের ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই ক্ষতি আর শুধুই ব্যক্তি ক্ষতি নয়—এটি জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা ও কৃষি পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থার বিপর্যয়। দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়বে আরও।
নবাব সিরাজদ্দৌলা রোডের ওয়ার্ল্ড সাইন-এর স্বত্বাধিকারী মাহবুবুর রহমান বলেন, “এই বাজারে ব্যবসা করছি প্রায় ১২ বছর। কিন্তু এমন পরিস্থিতি কোনোদিন দেখিনি। আমার দোকানের সামনে খোঁড়া রাস্তা, পানি জমে থাকায় কেউ আর দোকানে আসতে চায় না। গত কয়েক মাসেই আমার প্রায় ৪-৫ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। মাস শেষে কর্মচারীদের বেতন, অফিস ভাড়া, ইউটিলিটি বিল—সব কিছুর চাপ সামলে রাখা এখন দুরূহ হয়ে পড়েছে।”
তিনি আরও জানান, “যারা দূরদূরান্ত থেকে মাল কিনতে আসতেন, তারাও এখন বিকল্প উৎস খুঁজছেন। আমাদের প্রতি মাসে যে আয়ের প্রত্যাশা ছিল, সেটা এখন এক-চতুর্থাংশেও পৌঁছায় না।”
আলম ফার্মেসির কর্ণধার মোঃ আসিফ আলম বলেন, “আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বয়স ৮ বছর। আগে প্রতি সপ্তাহে দেড় টন পোল্ট্রি খাবার বিক্রি হত, যার বাজার মূল্য প্রায় দুই লক্ষ টাকা। এখন সেটা মাসে এক টনে এসে ঠেকেছে। গবাদিপশুর ওষুধের চাহিদাও প্রায় নেই বললেই চলে। লোকজন আসতে পারছে না, গাড়ি ঢুকছে না। ফলাফল—দিন শেষে শূন্য হেঁসেল।”
তিনি বলেন, “এই বাজার শুধু আমাদের ব্যক্তিগত উপার্জনের কেন্দ্র নয়, জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ পশু ও কৃষি স্বাস্থ্যসেবা চেইনের অংশ। এখানে সমস্যা মানে পশু খামারিদের বিশাল একটা অংশের জন্য সমস্যা।”
ফারুক মোল্লা, যিনি অক্সিজেন সিলিন্ডারের পাইকারি ব্যবসা করেন, বলেন, “গত চার মাসে আমার ক্ষতির পরিমাণ ৩ লক্ষ টাকারও বেশি। আমাদের ব্যবসা মূলত হাসপাতাল, ক্লিনিক ও অ্যাম্বুলেন্স সেবাদানকারীদের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু রাস্তাঘাটের অবস্থার কারণে ডেলিভারি দিতে সমস্যা হচ্ছে। এমনকি ইমারজেন্সি কাস্টমারদের সময়মতো সেবা দিতে না পারলে রোগীর জীবনহানিও হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে।”
তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, “এই ধরনের স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে রাস্তা কেটে রেখে, দীর্ঘ সময় কার্যক্রম বন্ধ রাখা শুধু ব্যবসার ক্ষতি নয়, মানুষের জীবনের ঝুঁকি তৈরি করা হচ্ছে।”
স্থানীয় একাধিক ব্যবসায়ী জানান, তারা ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে ব্যাংক ঋণ, এনজিও ঋণ ও ব্যক্তি পর্যায়ের ধারদেনা করে চলছেন। কিন্তু প্রতিদিন ক্রেতা কমে যাওয়ায় সেই ঋণ শোধের উপায়ও এখন নেই। অনেকেই মূলধন খুইয়ে দিয়েছেন, কেউ কেউ নতুন করে মাল কিনতে পারছেন না।
একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দোকান মালিক বলেন, “দুই ঈদের মাঝামাঝি এমন সময়ে রাস্তা কাটার সিদ্ধান্ত একেবারেই অযৌক্তিক। বছরের এমন সময়ে বিক্রির মৌসুম থাকে। এর পরিবর্তে বর্ষা শেষে বা বছরের শুরুর দিকেই কাজ শুরু করা যেত। এমনটা হলে আমরা ক্ষতির মুখে পড়তাম না।”
রাস্তা সংস্কারের দায়িত্বে থাকা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই প্রকল্পের সময়সীমা দেড় বছর। তবে তারা আশ্বাস দিয়েছে যে, ব্যবসায়ীদের ভোগান্তির বিষয় বিবেচনায় তারা আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই রাস্তা চলাচলের উপযোগী করে তুলবে। যদিও এ পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো দ্রুত অগ্রগতি চোখে পড়েনি।
স্থানীয়দের দাবি, উন্নয়ন কাজে পরিকল্পনার অভাব এবং সমন্বয়ের ঘাটতি এখন যেন এক নিত্যকার দৃশ্য। যেখানে উন্নয়ন মানেই হয়েছে জনভোগান্তি, সেখানে সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীরা কেবল অপেক্ষা ছাড়া আর কিছুই করতে পারছেন না।
ট্যাগ :