ঢাকা ০৬:৫৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৭ জুলাই ২০২৫, ১২ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

না.গঞ্জে ছিনতাই আতঙ্ক, ৮ স্পটে বেড়েছে অপরাধ!

সাব্বির হোসেন
  • আপডেট সময় : ০১:১৬:১১ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৬ জুলাই ২০২৫
  • / ৪৭ জন পড়েছেন

নারায়ণগঞ্জ শহর এখন আর আগের মতো নিরাপদ নয় এমন অভিযোগ উঠছে নগরবাসীর কাছ থেকে। বিশেষ করে সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত নগরীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও অলিগলিতে ছিনতাইয়ের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। একটি মোবাইল, কিছু টাকা তাতেই জীবন যায়। এমন ভীতিকর অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন সাধারণ পথচারী, শিক্ষার্থী, গার্মেন্টস কর্মী ও মধ্যরাতের শ্রমজীবী মানুষজন।
নিরাপত্তাহীনতার এই বাস্তবতা এখন শহরের ওপেন সিক্রেট। সিটি কর্পোরেশনের আলো ঝলমলে শহরেও যেখানে মানুষ ঘরে ফিরতে ভয় পাচ্ছে, সেখানে প্রশ্ন উঠেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কতটা কার্যকরভাবে কাজ করছে?
স্থানীয় সাংবাদিক ও নাগরিক অধিকার কর্মীদের তথ্যে উঠে এসেছে এমন ৮টি ডেঞ্জার জোন যেখানে প্রতিনিয়ত হচ্ছে ছিনতাই। উল্লেখযোগ্যে এলাকাগুলোর মধ্যে হচ্ছে, চাষাড়া কেন্দ্রীয় শহর এলাকা, উকিলপাড়া–জিমখানা মোড়, বোয়ালিয়া খালপাড় ও আশপাশ এলাকা, জামতলা থেকে পঞ্চবটি সংযোগ সড়ক, শীতলক্ষ্যা নদীর তীরবর্তী রাস্তাঘাট, চাষাড়া–দেওভোগ সড়ক, ফতুল্লা চুনকা রোড, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড।
এই সব জায়গায় ছিনতাইকারীরা সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই সক্রিয় হয়ে ওঠে। তাদের কেউ মটরসাইকেলযোগে, কেউবা হেঁটে পথচারীদের ঘিরে ফেলে, অস্ত্র ঠেকিয়ে ছিনিয়ে নেয় মোবাইল, মানিব্যাগ, গয়না কিংবা ব্যাগ। অনেক সময় ক্ষতিগ্রস্তরা মুখ খোলেন না, কারণ আইনের আশ্রয়ে গেলে সময়, টাকাপয়সা আর হয়রানি বাড়ে এমন ভীতি তাদের মনে গেঁথে গেছে।
চাষাড়া এলাকায় রাতে খাবার ডেলিভারির কাজ করেন আরিফ নামের এক যুবক জানান, আমার মোবাইল ও নগদ ৪৫০০ টাকা ছিনিয়ে নিয়েছে ৩ জন। থানায় গিয়েছিলাম, অভিযোগ নিতেই চায়নি। পরে বলল, সিসিটিভি ফুটেজ আনো। ফুটেজ কে দেবে?
শুধু আরিফ নন, এক মাসে অন্তত ১০-১৫ জন এমন ঘটনার শিকার হয়েছেন বলে জানা গেছে। তার মধ্যে কয়েকজন শিক্ষার্থী ও নারী গার্মেন্টস কর্মীও আছেন, যারা নিরবে অপমান সহ্য করে শুধু বাঁচতে চেয়েছেন।
নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নাসির উদ্দিন জানান, আমরা প্রতিদিন রাত ৮টা থেকে ২টা পর্যন্ত টহল দিচ্ছি। কিছু গ্যাং আছে যারা ঢাকার দিক থেকে এসে নারায়ণগঞ্জে ঘটনা ঘটিয়ে আবার পালিয়ে যায়। তবে তাদের ধরার চেষ্টা চলছে।
অপরাধীদের বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপ না নেওয়া, মামলা নিতে গড়িমসি করা, ও তদন্তে ধীরগতি এসব কারণে পুলিশের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা কমেছে। কেউ কেউ বলেন, পুলিশের অনেক সদস্য স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের চাপে তদন্তে আগ্রহ দেখান না।
বিশেষ করে নারী ও শিক্ষার্থীরা ছিনতাইয়ের শিকার হলেও লজ্জা বা ভয়েই চুপ থাকেন। গার্মেন্টস কর্মী লিজা (ছদ্মনাম) বলেন, রাতে কাজ শেষে বাড়ি ফেরার সময় মোবাইল কেড়ে নেয়। আমি ভয় পেয়েছি, তাই কিছু বলিনি।
নগরবাসীর অভিযোগ, নগর পুলিশ ব্যবস্থা বা সিসিটিভি মনিটরিং কার্যকর নয়। চাষাড়া, দেওভোগ, পঞ্চবটি এসব এলাকায় সিসিটিভি থাকলেও ফুটেজ ব্যবহার করে অপরাধী শনাক্তের নজির খুব কম।
তারা চান, নাইট পুলিশিং বাড়াতে হবে, সিসিটিভি মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে, পথচারী নিরাপত্তা মোবাইল ইউনিট চালু করা, ভুক্তভোগীদের নিরাপদে মামলা করার সুযোগ নিশ্চিত করা, কমিউনিটি পুলিশিং ও স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করা।
সামাজিক গবেষক ও অপরাধ বিশ্লেষক ড. রফিকুল ইসলাম বলেন,নারায়ণগঞ্জ শহরের জনসংখ্যা ও আর্থিক গতিশীলতা বাড়লেও আইনশৃঙ্খলার অনুপাতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাড়েনি। ফলে অপরাধীরা সহজেই সুযোগ নিচ্ছে। তিনি আরও বলেন, প্রতিটি সড়কের মুখে সিসিটিভি থাকলেও সেগুলোর কার্যকর ব্যবহার নেই। ছিনতাই যদি চিহ্নিত অপরাধ হয়, তবে প্রতিটি ঘটনায় মামলা নিতে পুলিশ বাধ্য—এই আইনি মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ সদস্য জানান, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছায়াতলে থাকা অপরাধীরা অনেক সময় ধরা পড়েও ছাড়া পেয়ে যায়। এতে করে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ নিরুৎসাহিত হয়।
ছিনতাই ,খুন , অপরাধ নিয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুমদার বলেন, শহরের স্পর্শকাতর এলাকাগুলোতে রাতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। ছিনতাইকারীদের ধরতে সোর্সের মাধ্যমে অভিযান চলছে। তবে অনেক ভুক্তভোগী অভিযোগই করেন না।
নগরীর সচেতন নাগরীকরা মনে করেন, নারায়ণগঞ্জ শহর আজ এক অনিরাপদ বাস্তবতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যা নামলেই শহরের প্রধান রাস্তাগুলোতে যেন ভয় ছড়িয়ে পড়ে। একটি আধুনিক শহরের এমন নিরাপত্তাহীনতা শুধু পুলিশ নয়, প্রশাসনের ব্যর্থতাও তুলে ধরে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি জনপ্রতিনিধি, নাগরিক সমাজ ও মিডিয়ার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া এ সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। মানুষের মৌলিক অধিকার নিরাপদে চলাফেরা যদি নিশ্চিত না হয়, তাহলে উন্নয়নের সৌন্দর্য শুধু কাগজেই থাকবে, বাস্তবতা হবে ভিন্ন।

ট্যাগ :

সংবাদটি সোস্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন

না.গঞ্জে ছিনতাই আতঙ্ক, ৮ স্পটে বেড়েছে অপরাধ!

আপডেট সময় : ০১:১৬:১১ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৬ জুলাই ২০২৫

নারায়ণগঞ্জ শহর এখন আর আগের মতো নিরাপদ নয় এমন অভিযোগ উঠছে নগরবাসীর কাছ থেকে। বিশেষ করে সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত নগরীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও অলিগলিতে ছিনতাইয়ের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। একটি মোবাইল, কিছু টাকা তাতেই জীবন যায়। এমন ভীতিকর অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন সাধারণ পথচারী, শিক্ষার্থী, গার্মেন্টস কর্মী ও মধ্যরাতের শ্রমজীবী মানুষজন।
নিরাপত্তাহীনতার এই বাস্তবতা এখন শহরের ওপেন সিক্রেট। সিটি কর্পোরেশনের আলো ঝলমলে শহরেও যেখানে মানুষ ঘরে ফিরতে ভয় পাচ্ছে, সেখানে প্রশ্ন উঠেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কতটা কার্যকরভাবে কাজ করছে?
স্থানীয় সাংবাদিক ও নাগরিক অধিকার কর্মীদের তথ্যে উঠে এসেছে এমন ৮টি ডেঞ্জার জোন যেখানে প্রতিনিয়ত হচ্ছে ছিনতাই। উল্লেখযোগ্যে এলাকাগুলোর মধ্যে হচ্ছে, চাষাড়া কেন্দ্রীয় শহর এলাকা, উকিলপাড়া–জিমখানা মোড়, বোয়ালিয়া খালপাড় ও আশপাশ এলাকা, জামতলা থেকে পঞ্চবটি সংযোগ সড়ক, শীতলক্ষ্যা নদীর তীরবর্তী রাস্তাঘাট, চাষাড়া–দেওভোগ সড়ক, ফতুল্লা চুনকা রোড, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড।
এই সব জায়গায় ছিনতাইকারীরা সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই সক্রিয় হয়ে ওঠে। তাদের কেউ মটরসাইকেলযোগে, কেউবা হেঁটে পথচারীদের ঘিরে ফেলে, অস্ত্র ঠেকিয়ে ছিনিয়ে নেয় মোবাইল, মানিব্যাগ, গয়না কিংবা ব্যাগ। অনেক সময় ক্ষতিগ্রস্তরা মুখ খোলেন না, কারণ আইনের আশ্রয়ে গেলে সময়, টাকাপয়সা আর হয়রানি বাড়ে এমন ভীতি তাদের মনে গেঁথে গেছে।
চাষাড়া এলাকায় রাতে খাবার ডেলিভারির কাজ করেন আরিফ নামের এক যুবক জানান, আমার মোবাইল ও নগদ ৪৫০০ টাকা ছিনিয়ে নিয়েছে ৩ জন। থানায় গিয়েছিলাম, অভিযোগ নিতেই চায়নি। পরে বলল, সিসিটিভি ফুটেজ আনো। ফুটেজ কে দেবে?
শুধু আরিফ নন, এক মাসে অন্তত ১০-১৫ জন এমন ঘটনার শিকার হয়েছেন বলে জানা গেছে। তার মধ্যে কয়েকজন শিক্ষার্থী ও নারী গার্মেন্টস কর্মীও আছেন, যারা নিরবে অপমান সহ্য করে শুধু বাঁচতে চেয়েছেন।
নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নাসির উদ্দিন জানান, আমরা প্রতিদিন রাত ৮টা থেকে ২টা পর্যন্ত টহল দিচ্ছি। কিছু গ্যাং আছে যারা ঢাকার দিক থেকে এসে নারায়ণগঞ্জে ঘটনা ঘটিয়ে আবার পালিয়ে যায়। তবে তাদের ধরার চেষ্টা চলছে।
অপরাধীদের বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপ না নেওয়া, মামলা নিতে গড়িমসি করা, ও তদন্তে ধীরগতি এসব কারণে পুলিশের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা কমেছে। কেউ কেউ বলেন, পুলিশের অনেক সদস্য স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের চাপে তদন্তে আগ্রহ দেখান না।
বিশেষ করে নারী ও শিক্ষার্থীরা ছিনতাইয়ের শিকার হলেও লজ্জা বা ভয়েই চুপ থাকেন। গার্মেন্টস কর্মী লিজা (ছদ্মনাম) বলেন, রাতে কাজ শেষে বাড়ি ফেরার সময় মোবাইল কেড়ে নেয়। আমি ভয় পেয়েছি, তাই কিছু বলিনি।
নগরবাসীর অভিযোগ, নগর পুলিশ ব্যবস্থা বা সিসিটিভি মনিটরিং কার্যকর নয়। চাষাড়া, দেওভোগ, পঞ্চবটি এসব এলাকায় সিসিটিভি থাকলেও ফুটেজ ব্যবহার করে অপরাধী শনাক্তের নজির খুব কম।
তারা চান, নাইট পুলিশিং বাড়াতে হবে, সিসিটিভি মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে, পথচারী নিরাপত্তা মোবাইল ইউনিট চালু করা, ভুক্তভোগীদের নিরাপদে মামলা করার সুযোগ নিশ্চিত করা, কমিউনিটি পুলিশিং ও স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করা।
সামাজিক গবেষক ও অপরাধ বিশ্লেষক ড. রফিকুল ইসলাম বলেন,নারায়ণগঞ্জ শহরের জনসংখ্যা ও আর্থিক গতিশীলতা বাড়লেও আইনশৃঙ্খলার অনুপাতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাড়েনি। ফলে অপরাধীরা সহজেই সুযোগ নিচ্ছে। তিনি আরও বলেন, প্রতিটি সড়কের মুখে সিসিটিভি থাকলেও সেগুলোর কার্যকর ব্যবহার নেই। ছিনতাই যদি চিহ্নিত অপরাধ হয়, তবে প্রতিটি ঘটনায় মামলা নিতে পুলিশ বাধ্য—এই আইনি মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ সদস্য জানান, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছায়াতলে থাকা অপরাধীরা অনেক সময় ধরা পড়েও ছাড়া পেয়ে যায়। এতে করে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ নিরুৎসাহিত হয়।
ছিনতাই ,খুন , অপরাধ নিয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুমদার বলেন, শহরের স্পর্শকাতর এলাকাগুলোতে রাতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। ছিনতাইকারীদের ধরতে সোর্সের মাধ্যমে অভিযান চলছে। তবে অনেক ভুক্তভোগী অভিযোগই করেন না।
নগরীর সচেতন নাগরীকরা মনে করেন, নারায়ণগঞ্জ শহর আজ এক অনিরাপদ বাস্তবতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যা নামলেই শহরের প্রধান রাস্তাগুলোতে যেন ভয় ছড়িয়ে পড়ে। একটি আধুনিক শহরের এমন নিরাপত্তাহীনতা শুধু পুলিশ নয়, প্রশাসনের ব্যর্থতাও তুলে ধরে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি জনপ্রতিনিধি, নাগরিক সমাজ ও মিডিয়ার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া এ সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। মানুষের মৌলিক অধিকার নিরাপদে চলাফেরা যদি নিশ্চিত না হয়, তাহলে উন্নয়নের সৌন্দর্য শুধু কাগজেই থাকবে, বাস্তবতা হবে ভিন্ন।