‘ব্যারিস্টারের হাত লম্বা, চাপ আপনাকেও পোহাতে হবে’
‘ব্যারিস্টারের হাত লম্বা, চাপ আপনাকেও পোহাতে হবে’

- আপডেট সময় : ০৫:৪৮:০১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৫ জুলাই ২০২৫
- / ১৫ জন পড়েছেন
স্টাফ রিপোর্টার
কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তির (ব্যারিস্টারের) বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করায় একজন সাংবাদিককে সরাসরি হুমকি দিয়েছেন নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শরিফুল ইসলাম। এক আইনজীবীর পক্ষ নিয়ে তিনি ওই সাংবাদিককে ফোনে হুমকি দিয়ে বলেন, “উনার (ব্যারিস্টারের) হাত কিন্তু অনেক লম্বা… এই চাপ আমাকেও পোহাতে হচ্ছে, আপনাকেও পোহাতে হবে।”
এই হুমকির বিষয়ে জানতে চেয়ে পুনরায় ফোন করা হলে ওসি তার অবস্থান থেকে একচুলও সরে আসেননি, বরং আরও ঔদ্ধত্যপূর্ণ ভাষায় কথা বলেন। ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পর থেকে স্থানীয় সাংবাদিক মহলে তীব্র ক্ষোভ ও নিন্দার ঝড় উঠেছে। এটি স্বাধীন সাংবাদিকতার উপর সরাসরি হস্তক্ষেপ এবং ক্ষমতার অপব্যবহার বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সম্প্রতি ফতুল্লা এলাকার এক প্রভাবশালী ব্যারিস্টারের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ নিয়ে দৈনিক সোজাসাপটায় তথ্য-প্রমাণসহ একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেন ভুক্তভোগী সাংবাদিক। সংবাদ প্রকাশের পরদিন ফতুল্লা মডেল থানার ওসি শরিফুল ইসলাম ওই সাংবাদিকের ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে ফোন করেন।
ফোনালাপের শুরুতে ওসি বলেন, “ইসদাইরে ভাই-বোনের একটা নিউজ মনে হয় সোজা সাপটায় আসছে। পারিবারিক বিষয় নিয়ে নিউজ করলে অসুবিধা হবে না আবার।
জবাবে প্রতিনিধি বলেন, বোনের বিরুদ্ধে ভাই এসে নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবে অভিযোগ করেছে।
ওসি বলেন, মহিলা ব্যারিস্টার তো, উনার হাত তো অনেক বড়, কার বিরুদ্ধে কি লিখতে হবে, একটু চিন্তা-ভাবনা করে লিখতে হবে তো। উনি ঢাকা এসবি (পুলিশের বিশেষ শাখা) তে নক করেছে, এখন আপনাদের পত্রিকা এবং আপনাদের বিরুদ্ধে গোপন প্রতিবেদন যাচ্ছে এসবি (পুলিশের বিশেষ শাখা)তে।
এই কথায় স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে, ওসি ওই প্রভাবশালী ব্যারিস্টারের পক্ষ হয়ে সাংবাদিককে সতর্ক করার নামে ভয় দেখাচ্ছেন এবং তার ক্ষমতার বলয় সম্পর্কে ইঙ্গিত দিচ্ছেন।
একজন পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে তার এমন আচরণের কারণ জানতে এবং এটি হুমকি কি না, তা নিশ্চিত হতে ভুক্তভোগী সাংবাদিক কিছুক্ষণ পর ওসি শরিফুল ইসলাম ফোন করলে, এবার ওসি আরও আক্রমণাত্মক ও তাচ্ছিল্যের সুরে কথা বলেন।
ফোনালাপটি নীচে তুলে ধরা হলো:
সাংবাদিক: আসসালামু আলাইকুম। দৈনিক শীতলক্ষা পত্রিকা থেকে সাংবাদিক সায়েম বলছি ভাই, ভালো আছেন?
ওসি: ওয়ালাইকুম আসসালাম। সাংবাদিক সায়েম কোন পত্রিকা?
সাংবাদিক: দৈনিক শীতলক্ষা পত্রিকা এবং দৈনিক ভোরের কাগজ, দুইটাই আমি আছি।
ওসি: বলেন।
সাংবাদিক: ভাই ফোন দিলাম এই জন্য যে আপনি সোজা সাপটা পত্রিকা একজন সাংবাদিককে ফোন দিয়েছেন। একটা নিউজের বিষয়ে। আপনি নাকি তাকে বলেছেন যে ব্যারিস্টারের হাত অনেক বড় অনেক লম্বা। বিষয়টা কি ভাই?
ওসি: ব্যারিস্টারের হাত তো অনেক ক্ষমতা তাই না, একটা ব্যারিস্টার যদি বিভিন্ন জায়গায় নক টক করে তাদের পারিবারিক বিষয় নিয়ে, রিপোর্ট করা ঠিক হইছে কিনা বলেন। এটা পারিবারিক বিষয় তাদের ভাই বোনের বিষয়
সাংবাদিক: পারিবারিক বিষয় বুঝলাম, কিন্তু সাংবাদিক কি পরিবারের বাসায় গিয়ে নিউজ করেছে নাকি ওই সাংবাদিকের কাছে পরিবারের লোক আসছে তাকি আপনি জানতে চেয়েছেন?
ওসি: পারিবারিক বিষয় নিয়ে রিপোর্ট করার কি দরকার আছে?
সাংবাদিক: পারিবারিক বিষয় আপনি বললে হবে নাকি আমি বললে হবে আমি কি পরিবারের কাছে গেছি নাকি পরিবারের আসছি, আপনি জানছেন? সেটা কি খবর নিছেন?
ওসি: না, সেটা অবশ্য বলে নাই।
সাংবাদিক:তাহলে আপনি খবর না নিয়ে একজন সাংবাদিককে হুমকি দিলেন ইনডাইরেক্টলি যে তার হাত লম্বা।
ওসি: হুমকি দিলাম কই, তারা তো বিষয়টা নিয়ে আমাদের কাছে এসেছে, অনেক জিনিস আমাদেরকে মেনে চলতে হয় আমরা তো পাবলিক নিয়ে কাজ করি তাই না? সবাইকে নিয়ে কাজ করি।
ওসি: এখন এই এই চাপটা তো আমাকে পোহাতে হবে, আপনাকেও পোহাতে হবে। সেটা বলছি আমি।
সাংবাদিক: আপনি পুলিশ কি আইনের উদ্ধে নাকি আমি সাংবাদিক আইনের নাকি ব্যারিস্টার আইনের উর্ধে সেটা বলেন?
ওসি: কেউ আইনের উর্ধে না?
সাংবাদিক:উনার ভাই যদি উনার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে এখানে সাংবাদিকের দোষটা কি? সেটা বলেন আমাকে।
ওসি: না উনি বলতে পারতো ঠিক আছে আ….আ
সাংবাদিক: মানে কি? মানে পাঁচ আগস্টের আগে যেভাবে আপনারা চলছেন, এখনও কি সেভাবে চলবেন বিষয়টা কি এরকম?
ওসি: ওরকম না।
সাংবাদিক: তাহলে আপনি একজন পুলিশ সদস্য হয়ে এই বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের পরে এখনো বৈষম্য করেন যে ব্যারিস্টারের হাত লম্বা, উনার হাত লম্বা, উনার হাত কত লম্বা, উনার হাত কি ৫২,০০০ বর্গ মাইলের বাংলাদেশের এর চেয়েও বেশি লম্বা?
ওসি: এটা আপনিও ভালো করে জানেন, আমিও ভালো করে জানি।
সাংবাদিক: ভাই আমি জানি না আপনি আমাকে বলেন। আপনি একজন থানার অফিসার ইনচার্জ হয়ে আপনি বলতে ব্যারিস্টারের হাত লম্বা এটা কোন যুক্তিতে বললেন আপনি? আপনি কি চাকরি করতে আসছেন নাকি ব্যারিস্টারের হাত লম্বা সেটা দেখাতে আসছেন আমাদের বলেন।
ওসি: ভাই আমি ওভাবে বলিনি। মানে পারিবারিকভাবে শেষ করতে উনারা থানায় আসছিল এখন যদি আপনারা এইটা নিয়ে খোচাখোচি করে পেপার পত্রিকা এনে তাদের সম্মান ক্ষুন্ন বিষয়গুলো যদি চলে আসে চলে আসে তাহলে তো তারা তো আমাদের কাছে আসছিল বলছে, স্যার আমরা তো ভাইবোন মিলাই আপনাদের কাছে গিয়ে ছিলাম, যে আমরা বিষয়টা পারিবারিক ভাবে শেষ করবো হ্যাঁ তো এরপরে তাহলে বিষয়টা কেমন হলো ওই যে পেপার পত্রিকা থেকে আমাদের পারিবারিক সম্মান ক্ষতিগ্রস্থ হলো, এটা কেমন হলো?
সাংবাদিক: সাংবাদিক কি তার বাড়িতে গিয়ে ছিল নাকি তার ভাই সাংবাদিকের কাছে আসলো সেটা কি খবর নিছেন?
ওসি: আচ্ছা এখন যদি তার পরিবার আপনার কাছে গিয়ে থাকে বিচার প্রার্থী হয়ে থাকে তাহলে আপনি বিচার করবেন।
সাংবাদিক: না না বিচার করবো না, আমি তো বিচার করার অধিকার রাখি না, আপনার মতো আমার তো বিচার করার অধিকার নাই। আমার কাজ হলো নিউজ করা, শোনেন একজন মানুষ যখন আমার কাছে কোনো অভিযোগ নিয়ে আসবে, তখন আমার কাজ হলো তার কথা শুনে তার নিউজটা করা। আমি তো বিচার করতে বসি নাই। আপনি বসছেন বিচার করতে, আপনি মনে হয় সম্ভবত আদালত বসিয়েছেন থানায়। আপনি যে একজন সাংবাদিক কে হুমকি দিছেন গোপন প্রতিবেদন যাবে এসবিতে (পুলিশের বিশেষ শাখায়) এই ধরনের হুমকি দিয়ে কি আপনি আমাদের সাংবাদিকদের দাবায়া রাখতে পারবেন বলেন? কি বুঝাতে চাচ্ছেন বলেন? সাংবাদিকরা কি লিখবে না? লেখা বন্ধ করে রাখবেন বলেন? কি করবে সাংবাদিকরা বলেন?
ওসি: আচ্ছা লেখেন আপনার যেভাবে লেখা লাগবে, লেখেন।
সাংবাদিক: না আমরা তো লেখবো আপনি কেন এই হুমকিটা দিলেন সেটা বলেন। আপনার কি হুমকিটা দেয়া ঠিক হইছে? বলেন।
ওসি: আমি হুমকি দেই নাই, আপনি ভালো করে শুনে দেখেন এখানে কোনো হুমকির বিষয় আছে?
সাংবাদিক: আমি শুনছি আপনি বলছেন ইনডাইরেক্টলি আপনি বলছেন তার হাত অনেক লম্বা।
ওসি: যদি ইনডাইরেক্ট হয়ে থাকে তাহলে এটা ইনডাইরেক্টে রাখেন।
সাংবাদিক: না কেন ইনডাইরেক্ট আপনি বলছেন তার হাত অনেক লম্বা, হাত লম্বার কি আছে এখানে?
ওসি: একটা ব্যারিস্টার কে আপনি ছোট মনে করছেন?
সাংবাদিক: ব্যারিস্টার কি আইনের উর্দ্ধে তা বলেন?
এই কথোপকথনের মাধ্যমে ওসি শরিফুল ইসলাম কার্যত তার হুমকির কথা স্বীকার করে নেন এবং বিষয়টিকে হালকা করার চেষ্টা করেন। তার কথায় পেশাদারিত্বের চেয়ে ক্ষমতার দম্ভই বেশি প্রকাশ পেয়েছে।
এই ঘটনা গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় নগ্ন হস্তক্ষেপ বলে মনে করছেন সাংবাদিক নেতারা। তাদের মতে, পুলিশের দায়িত্ব সকল নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, কোনো প্রভাবশালীর ব্যক্তিগত পাহারাদার হিসেবে কাজ করা নয়। একজন ওসির কাজ সত্য উদঘাটনে গণমাধ্যমকে সহযোগিতা করা, অথচ তিনি সত্য প্রকাশে বাধা দিচ্ছেন।
নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সিনিয়র সদস্যরা বলেন, “এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।
প্রায়শই দেখা যায় যে পুলিশ অফিসাররা ক্ষমতাবানদের দাবার গুন্ডা হয়ে ওঠেন। ওসি শরিফুল ইসলামের এই ফোনালাপ প্রমাণ করে যে, তিনি আইনের রক্ষকের ভূমিকা পালন না করে একজন ব্যক্তির ক্ষমতার পাহারাদার হয়েছেন। আমরা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে এর সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করছি।”
ভুক্তভোগী সাংবাদিক তার পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “আইনের রক্ষকই যদি ভক্ষকের ভূমিকা পালন করে, তাহলে আমরা কোথায় যাব? আমি শুধু আমার দায়িত্ব পালন করেছি।
এই ঘটনায় পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন গণমাধ্যমকর্মীরা। তারা বলছেন, যদি এই ধরনের আচরণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে ভবিষ্যতে সৎ ও সাহসী সাংবাদিকতা মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। এ বিষয়ে পুলিশ সুপার বলেন, বিষয়টি আমি শুনেছি, খতিয়ে দেখা হচ্ছে।