আমার সন্তানদের জন্য এই রাষ্ট্র কি কিছু করবে?

- আপডেট সময় : ০৪:০১:০৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৭ জুলাই ২০২৫
- / ৬৬ জন পড়েছেন
২০ জুলাই ২০২৪, বিকাল পাঁচটা। নারায়ণগঞ্জের ভূমি পাম্প গেট এলাকায় তখন ভীড় জমিয়েছে শত শত ছাত্র ও জনতা। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে তারা অবস্থান নিচ্ছিল। সেই সময়েই বিজিবি ও পুলিশের যৌথ বাহিনী কোনো ধরনের পূর্ব হুঁশিয়ারি ছাড়াই শুরু করে এলোপাথাড়ি গুলিবর্ষণ। মুহূর্তেই চারদিক আতঙ্কে ভরে যায়। শক্ত ধাতব বুলেট ছুটে এসে বিদ্ধ করে মোঃ হৃদয়ের কপাল। সেখানেই লুটিয়ে পড়েন এবং ঘটনাস্থলেই শহীদ হন হৃদয়। ।
মোঃ হৃদয়ের জন্ম হয়েছিল ১৯৯৭ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি, ভোলা জেলার এক দরিদ্র পরিবারে। কিন্তু জন্মের মাত্র তিন বছর পরেই পিতা সফেদ আলী অন্যত্র বিয়ে করে স্ত্রী-সন্তান রেখে চলে যান। এরপর যখন হৃদয়ের বয়স পাঁচ, তখন মা মনোয়ারা বেগমও আরেকজনকে বিয়ে করে সংসার ত্যাগ করেন। এতটুকু শিশুকে আশ্রয় দেন তার নানী-নানা, যারা অন্যের বাড়িতে কাজ করে কোনওমতে বেঁচে ছিলেন। সেই সংকটে, অবহেলায়, প্রতিদিন নতুন যুদ্ধের মধ্যে বড় হয়ে উঠতে থাকেন হৃদয়।
কৈশোরেই জীবিকার তাগিদে পেশা হিসেবে বেছে নেন কাঠমিস্ত্রির কাজ। নিজেই উপার্জন করে নিজের সংসার গড়ে তুলেন। স্ত্রী শিরিনা আক্তার এবং দুটি ছোট সন্তান। চার বছরের আব্দুল্লাহ ও এক বছরের নুসরাতকে নিয়ে গড়ে ওঠে একটি ক্ষুদ্র সুখের ঘর। কিন্তু সে সুখ ছিল দারিদ্র্যসঙ্কুল। পরিবারের ভরণপোষণের একমাত্র আশ্রয় ছিলেন হৃদয়। ভিটেবাড়ি ছাড়া আর কোনো জমিজমা, অর্থ কিংবা ভবিষ্যতের সঞ্চয় ছিল না তার। তবুও জীবনটা চলছিল কষ্টের মধ্যেও মাথা উঁচু করেই।
এমন একজন শ্রমজীবী মানুষ কেন আন্দোলনে গেলেন? কারণ ছিল স্বপ্নের মতো একটি দেশ। যে দেশে সাম্য থাকবে, বৈষম্য থাকবে না, গুম-খুনের ভয় থাকবে না। তাই ছাত্র-জনতার সঙ্গে তিনিও রাস্তায় নেমেছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্র তাকে সহ্য করতে পারেনি। গুলি চালিয়েছে কপালের মাঝখানে। এখন আর কেউ তার শিশুপুত্র আব্দুল্লাহকে কোলে তুলে নেয় না, কেউ এক বছরের নুসরাতের কান্নায় চুপ করায় না, আর কেউ রাত শেষে ঘরে ফিরে বলে না, “তোমাদের জন্য কাঠের খাট বানিয়ে আনবো।”
স্ত্রী শিরিনা আক্তার এখন দিশেহারা। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছেন, “ও যা কামাই করত তাই দিয়া চাল ডাল কিনতাম। এখন তো একটা টাকাও নাই। বাচ্চাগুলারে কিভাবে মানুষ করবো?” হৃদয়ের মা-বাবা আলাদা সংসার নিয়ে ব্যস্ত, তাদের কারো সাহায্য বা সহানুভূতির ছায়া নেই এই পরিবারটির ওপর। এমন অবস্থায় শহীদের স্ত্রী ও সন্তানদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন ন্যূনতম মাসিক আর্থিক সহায়তা, মাথা গোঁজার একটি নিরাপদ বাড়ি এবং শিশুদের শিক্ষার নিশ্চয়তা।
শহীদ মোঃ হৃদয় ছিলেন নিঃস্ব, অভাগা, কিন্তু সাহসী। একজন কাঠমিস্ত্রি হয়েও রাষ্ট্রের গুলির সামনে বুক পেতে দিয়েছিলেন। এই রাষ্ট্র কি তাকে মনে রাখবে? নাকি রক্তের দাগ শুকিয়ে গেলে আর কেউ খোঁজ রাখবে না তার স্ত্রী ও সন্তানের?
মোঃ হৃদয়ের রক্ত মিশে আছে নারায়ণগঞ্জের রাস্তায়। ইতিহাস তাকে ভুলে গেলেও তার নিস্পৃহ চোখ এখনো যেন প্রশ্ন করে, “আমার সন্তানদের জন্য এই রাষ্ট্র কি কিছু করবে?”