ঢাকা ১২:১৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ০১ জুলাই ২০২৫, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :

রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হতে চান ডন সেলিম

অর্ণব আল আমীন
  • আপডেট সময় : ০৭:৪৩:৫৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫
  • / ৪৫ জন পড়েছেন

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে জন্ম নেওয়া এক সাধারণ কিশোর সেলিম প্রধান। যিনি জাপানে প্রবাসজীবন শুরু করে এক সময় হয়ে উঠেন ক্যাসিনো সম্রাট। বর্তমানে তাকে ডন সেলিম নামেই সকলে চেনে। তিনি নিজেও নিজেকে গরিবের ডন বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন। পাঁচ আগষ্টের পট পরিবর্তনের পর ডন সেলিম এখন রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হতে চাইছেন। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ রিপাবলিক পার্টি নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন সেলিম।
ক্যাসিনো ব্যাবসা ও অপরাধ জগত থেকে রাজনীতি, সেলিম প্রধানের উত্থান-পতনের এই গল্প যেন রূপকথার গল্প। ১৯৭৩ সালে রূপগঞ্জের ভুলতা মর্তুজাবাদ এলাকার কাপর ব্যবসায়ী নান্নু মিয়ার ঘরে জন্ম নেয়া সেলিম প্রধান ৩ ভাই ও ৩ বোনের মধ্যে ছিলেন অন্যতম ডানপিঠে স্বভাবের। সেলিম ভাইদের মধ্যে দ্বিতীয়। ভুলতায় একসময় কাপড়ের ব্যবসা করতেন নান্নু মিয়া। সেলিম পরিবারের একজন সাধারণ সদস্য হিসেবে বেড়ে ওঠেন। লেখা পড়ায় অমনোযোগী হওয়ায় কাজের তাগিতে ১৯৮৮ সালে মাত্র ১২-১৩ বছর বয়সে পাড়ি জমান জাপানে বড় ভাইয়ের সহায়তায়।
শুরু করেন হোটেল ও দোকানে চাকরি, পরে জড়িয়ে পড়েন জাপানের কিক-বক্সিং ক্লাব ‘কে-১’-এর সঙ্গে। কিন্তু শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে জাপানের অভিবাসন কর্মকর্তার ওপর চড়াও হন তিনি। গ্রেপ্তার হন, জেল খাটেন, পরে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হয় ডন সেলিমকে।
এরপরই শুরু হয় তার অপরাধমূলক সাম্রাজ্যের নির্মাণ। থাইল্যান্ডে বসেই গড়ে তোলেন বিলাসবহুল স্পা, রিসোর্ট, জুয়াখানা এবং অনলাইন ক্যাসিনো। ঢাকায় ফিরে প্রতিষ্ঠা করেন ‘প্রধান গ্রুপ’। এর অধীনেই পি২৪ গেমিং, ওয়েল ট্রান্সফার কোম্পানি ও বিভিন্ন ব্যাংকিং এজেন্সির মাধ্যমে শুরু হয় আন্তর্জাতিক মানের অনলাইন জুয়া, ডলার পাচার ও মানি লন্ডারিং।
তবে শুধু অপরাধ জগতেই নয়, নারী সংক্রান্ত কেলেঙ্কারি ও বহুবিবাহ তার জীবনের আরেকটি বিস্ময়কর অধ্যায়। সেলিম প্রধানের একাধিক বিয়ের কথা উঠে এসেছে আদালতের নথি ও গোয়েন্দা তদন্তে। জানা গেছে, তিনি ছয় বার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন, যাদের মধ্যে কয়েকজন এখনো জীবিত এবং আইনি স্বীকৃতি থাকা সত্ত্বেও তাদের কারো সঙ্গেই সম্পর্ক নেই।
প্রথম স্ত্রী ছিলেন তার জাপান প্রবাসজীবনের সময়কার পরিচিত একজন বাংলাদেশি নারী। ওই সংসারে একটি সন্তান থাকলেও পরবর্তীতে সেই সম্পর্ক ভেঙে যায়। দ্বিতীয় বিয়ে করেন মালয়েশিয়ায় এক ব্যবসায়ী নারীর সঙ্গে। সেই স্ত্রী এখনো মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছেন এবং সেলিমের বিরুদ্ধে যৌতুক ও নির্যাতনের অভিযোগ তুলেছিলেন বলে জানা যায়।
তৃতীয় ও চতুর্থ স্ত্রী ছিলেন ঢাকার দুটি ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান, যাদের একজন রাজধানীর একটি বিখ্যাত নার্সিং হোমের মালিকের মেয়ে। এই সম্পর্কগুলো দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। পঞ্চম বিয়ে হয় এক বিদেশি নারী—রাশিয়ান মডেলের সঙ্গে, যিনি সেলিমের ‘পি২৪ গেমিং’-এর বিজ্ঞাপনের মুখপাত্র ছিলেন। এই বিয়েটিও ভেঙে যায় ২০২২ সালে।
সবচেয়ে আলোচিত ষষ্ঠ বিয়েটি হয় ২০২৩ সালে, জেল থেকে বের হওয়ার আগেই। কারাগারে থাকাকালীন এক নারী আইনজীবীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন সেলিম প্রধান। সেই নারী পরবর্তীতে তাকে আইনি সহায়তা দিয়ে বিয়ে করেন। বর্তমানে সেই স্ত্রী তার রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকা-ে পাশে রয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়—এই সব বিয়ের আইনি বৈধতা, পারিবারিক অবস্থান ও সন্তানের দায়িত্ব কে নিচ্ছে?
নারীদের নিয়ে তার আচরণ বরাবরই বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। তদন্তে উঠে এসেছে, বিভিন্ন সময়ে তার অনলাইন ক্যাসিনোর প্রমোশনে তরুণীদের ব্যবহার করা হতো, এবং অনেক সময় তাদের ব্যক্তিগতভাবে শারীরিক ও মানসিক হয়রানি করা হতো। এসব ঘটনায় কেউ মামলা না করলেও, গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে।
২০১৯ সালে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সময় সেলিম প্রধানের নাম আসে প্রধান অভিযুক্তদের মধ্যে। একই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর থাই এয়ারওয়েজের ফ্লাইটে ব্যাংকক যাওয়ার সময় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সেলিম প্রধানকে আটক করে র‌্যাব-১। তার বনানী ও গুলশানের বাসা ও অফিসে চলে দীর্ঘ অভিযান। উদ্ধার হয় হরিণের চামড়া, বিপুল পরিমাণ মদ, ৩৩টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, জাল টাকা, ক্যাসিনোর সার্ভার এবং আন্তর্জাতিক অর্থ লেনদেনের ডিভাইস। অভিযোগপত্রে বলা হয়, মাসে অন্তত ৫০ কোটি টাকার লেনদেন হতো তার প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে।
এছাড়া তার বিরুদ্ধে রয়েছে চোরাচালান, বন্যপশু পাচার, মাদক ব্যবসা, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে মামলা এবং বিশাল অংকের টাকার ব্যাংক ঋণ খেলাপির অভিযোগ। ২০২৩ সালে আদালত তাকে ৮ বছরের কারাদ- দেয়। সেই সাজা ভোগ করে ২০২৪ সালের শেষ দিকে তিনি কারামুক্ত হন।
কিন্তু ঘটনা সেখানেই থেমে থাকেনি। কারাগার থেকে বের হয়েই তিনি আবার ফিরে আসেন রূপগঞ্জে। স্থানীয়ভাবে আবারও প্রভাব বিস্তার শুরু করেন। পূজা ম-প থেকে শুরু করে ব্যবসায়ীদের জমি প্রকল্পে হস্তক্ষেপ, আবারো শুরু হয় ‘ডন সেলিম’ এর রাজত্ব। অভিযোগ রয়েছে, রূপগঞ্জের ভুলতাসহ একাধিক এলাকায় নতুন নতুন ব্যবসায়িক প্রকল্পে বিনিয়োগের নাম করে চাঁদাবাজি এবং জমি দখলের চেষ্টা চালিয়েছেন তিনি।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, তারা ১৬ বিঘা জমিতে গড়ে তুলেছিলেন একটি আড়ত প্রকল্প। সেখানে এক সময় উপস্থিত হয়ে নিজেকে ‘সিকিউরিটি প্রধান’ হিসেবে দাবি করেন সেলিম প্রধান। এরপরই শুরু হয় চাঁদার চাপ। বিষয়টি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের জানালেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা মেলেনি। বরং এলাকা জুড়ে আতঙ্ক ও চুপচাপ পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয়, চলতি বছরের ২৩ জুন শুক্রবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সাবেক সামরিক কর্মকর্তা, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষক, আইনজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নাগরিকদের সমন্বয়ে আত্মপ্রকাশ করে ‘বাংলাদেশ রিপাবলিক পার্টি’। সেলিম প্রধান এই নতুন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত হন। ‘বাংলাদেশ রিপাবলিক পার্টি’ নামের ওই দলের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে তাকে দেখা যায়। দলটির পোস্টার, ব্যানার, প্রচারপত্রে তার ছবিই সবচেয়ে বড়। এলাকায় নানা সভা-সমাবেশে তাকে ঘিরেই চলছে দলীয় তৎপরতা।
এখানেই প্রশ্ন উঠেছে—একজন দ-প্রাপ্ত অপরাধী, যিনি মানি লন্ডারিং ও ক্যাসিনোর মতো অপরাধে আদালতে সাজাপ্রাপ্ত, তিনি কীভাবে এত সহজে রাজনৈতিক পরিচয় ও সামাজিক প্রভাব ফিরে পেলেন? কারা তাঁকে সহায়তা দিচ্ছে? প্রশাসন কি নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করছে?
জানা গেছে, সেলিম প্রধান এখনো একাধিক মামলার মুখোমুখি। রয়েছে এনবিআর ও দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্ত। দেশের বাইরে—বিশেষ করে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, দুবাই ও নিউইয়র্কে তার নামে বিভিন্ন সম্পত্তির খোঁজ মিলেছে। তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকার লেনদেনের রেকর্ড এখনো তদন্তাধীন।
রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জন রয়েছে, তার পেছনে আছে ক্ষমতাসীন দলের একটি অংশ এবং বিতর্কিত ব্যবসায়ী মহল। এমনকি একজন প্রভাবশালী নেতার মাধ্যমে তাকে রাজনীতির ছাতার নিচে নিয়ে আসা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। যদিও সরকারিভাবে এসবের কিছুই স্বীকার করা হয়নি।
স্থানীয় বাসিন্দাদের কেউ মুখ খুলতে চায় না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ব্যবসায়ী বলেন, “তিনি জেল থেকে ফিরেই আবারো প্রভাব বিস্তার শুরু করেছেন। সবাই চুপ থাকে, কারণ তার সঙ্গে এখন আবার বড় বড় লোকের নাম জড়িয়ে গেছে।”
এই পরিস্থিতি স্থানীয় প্রশাসনকেও প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। কেন এত অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না? কেন ব্যবসায়ীদের অভিযোগে কোনো অগ্রগতি নেই?
সেলিম প্রধান নিজে অবশ্য দাবী করেছেন, তিনি নতুন জীবন শুরু করতে চান। এক সময় ভুল করেছিলেন, এখন সমাজের জন্য কাজ করতে চান। তবে বাস্তবতা হলো তার ঘুরে দাঁড়ানো সমাজে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। কারণ, তাকে কেন্দ্র করেই আবারো জমছে পুরনো অপরাধের জাল। অনেকে বলছেন, এটা তার নিজস্ব ব্যবসা ও অপরাধ ঢাকার একটি কৌশল।
এক সময়ের কুখ্যাত অপরাধী কীভাবে আবার সমাজে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছেন? কেন প্রশাসন নীরব? কারা তাকে রাজনৈতিক ছত্রছায়া দিচ্ছে? এসব প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে রূপগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ জুড়ে।
অনুসুন্ধানে আরও জানা গেছে, তার নামে এখনো বিভিন্ন দেশে ১০টির বেশি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। মালয়েশিয়া, দুবাই, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও নিউইয়র্কে আছে প্রপার্টি। তার প্রতিষ্ঠানগুলোতে কোটি কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছে, যার উৎস অজানা।
ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ মুখ খুলতে ভয় পান। এক গোপন সূত্রে একজন জানান, “সে এখন আবার ফিরে এসেছে, অথচ তার বিচার হয়নি। তার স্ত্রীদের কেউ এখনো বিচারের জন্য আবেদন করতেও সাহস পান না।”
এই পরিস্থিতি আমাদের রাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থা, রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা এবং প্রশাসনিক দুর্বলতার বড় উদাহরণ। একজন দ-িত, বহুবিবাহকারী, নারী হয়রানিকারী, অর্থ পাচারকারী ব্যক্তির যদি আবার রাজনীতি ও সমাজে স্থান হয়, তাহলে সেটি কেবল ব্যক্তির দায় নয়—সমগ্র ব্যবস্থার ব্যর্থতা।

ট্যাগ :

সংবাদটি সোস্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন

রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হতে চান ডন সেলিম

আপডেট সময় : ০৭:৪৩:৫৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে জন্ম নেওয়া এক সাধারণ কিশোর সেলিম প্রধান। যিনি জাপানে প্রবাসজীবন শুরু করে এক সময় হয়ে উঠেন ক্যাসিনো সম্রাট। বর্তমানে তাকে ডন সেলিম নামেই সকলে চেনে। তিনি নিজেও নিজেকে গরিবের ডন বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন। পাঁচ আগষ্টের পট পরিবর্তনের পর ডন সেলিম এখন রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হতে চাইছেন। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ রিপাবলিক পার্টি নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন সেলিম।
ক্যাসিনো ব্যাবসা ও অপরাধ জগত থেকে রাজনীতি, সেলিম প্রধানের উত্থান-পতনের এই গল্প যেন রূপকথার গল্প। ১৯৭৩ সালে রূপগঞ্জের ভুলতা মর্তুজাবাদ এলাকার কাপর ব্যবসায়ী নান্নু মিয়ার ঘরে জন্ম নেয়া সেলিম প্রধান ৩ ভাই ও ৩ বোনের মধ্যে ছিলেন অন্যতম ডানপিঠে স্বভাবের। সেলিম ভাইদের মধ্যে দ্বিতীয়। ভুলতায় একসময় কাপড়ের ব্যবসা করতেন নান্নু মিয়া। সেলিম পরিবারের একজন সাধারণ সদস্য হিসেবে বেড়ে ওঠেন। লেখা পড়ায় অমনোযোগী হওয়ায় কাজের তাগিতে ১৯৮৮ সালে মাত্র ১২-১৩ বছর বয়সে পাড়ি জমান জাপানে বড় ভাইয়ের সহায়তায়।
শুরু করেন হোটেল ও দোকানে চাকরি, পরে জড়িয়ে পড়েন জাপানের কিক-বক্সিং ক্লাব ‘কে-১’-এর সঙ্গে। কিন্তু শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে জাপানের অভিবাসন কর্মকর্তার ওপর চড়াও হন তিনি। গ্রেপ্তার হন, জেল খাটেন, পরে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হয় ডন সেলিমকে।
এরপরই শুরু হয় তার অপরাধমূলক সাম্রাজ্যের নির্মাণ। থাইল্যান্ডে বসেই গড়ে তোলেন বিলাসবহুল স্পা, রিসোর্ট, জুয়াখানা এবং অনলাইন ক্যাসিনো। ঢাকায় ফিরে প্রতিষ্ঠা করেন ‘প্রধান গ্রুপ’। এর অধীনেই পি২৪ গেমিং, ওয়েল ট্রান্সফার কোম্পানি ও বিভিন্ন ব্যাংকিং এজেন্সির মাধ্যমে শুরু হয় আন্তর্জাতিক মানের অনলাইন জুয়া, ডলার পাচার ও মানি লন্ডারিং।
তবে শুধু অপরাধ জগতেই নয়, নারী সংক্রান্ত কেলেঙ্কারি ও বহুবিবাহ তার জীবনের আরেকটি বিস্ময়কর অধ্যায়। সেলিম প্রধানের একাধিক বিয়ের কথা উঠে এসেছে আদালতের নথি ও গোয়েন্দা তদন্তে। জানা গেছে, তিনি ছয় বার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন, যাদের মধ্যে কয়েকজন এখনো জীবিত এবং আইনি স্বীকৃতি থাকা সত্ত্বেও তাদের কারো সঙ্গেই সম্পর্ক নেই।
প্রথম স্ত্রী ছিলেন তার জাপান প্রবাসজীবনের সময়কার পরিচিত একজন বাংলাদেশি নারী। ওই সংসারে একটি সন্তান থাকলেও পরবর্তীতে সেই সম্পর্ক ভেঙে যায়। দ্বিতীয় বিয়ে করেন মালয়েশিয়ায় এক ব্যবসায়ী নারীর সঙ্গে। সেই স্ত্রী এখনো মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছেন এবং সেলিমের বিরুদ্ধে যৌতুক ও নির্যাতনের অভিযোগ তুলেছিলেন বলে জানা যায়।
তৃতীয় ও চতুর্থ স্ত্রী ছিলেন ঢাকার দুটি ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান, যাদের একজন রাজধানীর একটি বিখ্যাত নার্সিং হোমের মালিকের মেয়ে। এই সম্পর্কগুলো দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। পঞ্চম বিয়ে হয় এক বিদেশি নারী—রাশিয়ান মডেলের সঙ্গে, যিনি সেলিমের ‘পি২৪ গেমিং’-এর বিজ্ঞাপনের মুখপাত্র ছিলেন। এই বিয়েটিও ভেঙে যায় ২০২২ সালে।
সবচেয়ে আলোচিত ষষ্ঠ বিয়েটি হয় ২০২৩ সালে, জেল থেকে বের হওয়ার আগেই। কারাগারে থাকাকালীন এক নারী আইনজীবীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন সেলিম প্রধান। সেই নারী পরবর্তীতে তাকে আইনি সহায়তা দিয়ে বিয়ে করেন। বর্তমানে সেই স্ত্রী তার রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকা-ে পাশে রয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়—এই সব বিয়ের আইনি বৈধতা, পারিবারিক অবস্থান ও সন্তানের দায়িত্ব কে নিচ্ছে?
নারীদের নিয়ে তার আচরণ বরাবরই বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। তদন্তে উঠে এসেছে, বিভিন্ন সময়ে তার অনলাইন ক্যাসিনোর প্রমোশনে তরুণীদের ব্যবহার করা হতো, এবং অনেক সময় তাদের ব্যক্তিগতভাবে শারীরিক ও মানসিক হয়রানি করা হতো। এসব ঘটনায় কেউ মামলা না করলেও, গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে।
২০১৯ সালে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সময় সেলিম প্রধানের নাম আসে প্রধান অভিযুক্তদের মধ্যে। একই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর থাই এয়ারওয়েজের ফ্লাইটে ব্যাংকক যাওয়ার সময় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সেলিম প্রধানকে আটক করে র‌্যাব-১। তার বনানী ও গুলশানের বাসা ও অফিসে চলে দীর্ঘ অভিযান। উদ্ধার হয় হরিণের চামড়া, বিপুল পরিমাণ মদ, ৩৩টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, জাল টাকা, ক্যাসিনোর সার্ভার এবং আন্তর্জাতিক অর্থ লেনদেনের ডিভাইস। অভিযোগপত্রে বলা হয়, মাসে অন্তত ৫০ কোটি টাকার লেনদেন হতো তার প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে।
এছাড়া তার বিরুদ্ধে রয়েছে চোরাচালান, বন্যপশু পাচার, মাদক ব্যবসা, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে মামলা এবং বিশাল অংকের টাকার ব্যাংক ঋণ খেলাপির অভিযোগ। ২০২৩ সালে আদালত তাকে ৮ বছরের কারাদ- দেয়। সেই সাজা ভোগ করে ২০২৪ সালের শেষ দিকে তিনি কারামুক্ত হন।
কিন্তু ঘটনা সেখানেই থেমে থাকেনি। কারাগার থেকে বের হয়েই তিনি আবার ফিরে আসেন রূপগঞ্জে। স্থানীয়ভাবে আবারও প্রভাব বিস্তার শুরু করেন। পূজা ম-প থেকে শুরু করে ব্যবসায়ীদের জমি প্রকল্পে হস্তক্ষেপ, আবারো শুরু হয় ‘ডন সেলিম’ এর রাজত্ব। অভিযোগ রয়েছে, রূপগঞ্জের ভুলতাসহ একাধিক এলাকায় নতুন নতুন ব্যবসায়িক প্রকল্পে বিনিয়োগের নাম করে চাঁদাবাজি এবং জমি দখলের চেষ্টা চালিয়েছেন তিনি।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, তারা ১৬ বিঘা জমিতে গড়ে তুলেছিলেন একটি আড়ত প্রকল্প। সেখানে এক সময় উপস্থিত হয়ে নিজেকে ‘সিকিউরিটি প্রধান’ হিসেবে দাবি করেন সেলিম প্রধান। এরপরই শুরু হয় চাঁদার চাপ। বিষয়টি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের জানালেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা মেলেনি। বরং এলাকা জুড়ে আতঙ্ক ও চুপচাপ পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয়, চলতি বছরের ২৩ জুন শুক্রবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সাবেক সামরিক কর্মকর্তা, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষক, আইনজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নাগরিকদের সমন্বয়ে আত্মপ্রকাশ করে ‘বাংলাদেশ রিপাবলিক পার্টি’। সেলিম প্রধান এই নতুন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত হন। ‘বাংলাদেশ রিপাবলিক পার্টি’ নামের ওই দলের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে তাকে দেখা যায়। দলটির পোস্টার, ব্যানার, প্রচারপত্রে তার ছবিই সবচেয়ে বড়। এলাকায় নানা সভা-সমাবেশে তাকে ঘিরেই চলছে দলীয় তৎপরতা।
এখানেই প্রশ্ন উঠেছে—একজন দ-প্রাপ্ত অপরাধী, যিনি মানি লন্ডারিং ও ক্যাসিনোর মতো অপরাধে আদালতে সাজাপ্রাপ্ত, তিনি কীভাবে এত সহজে রাজনৈতিক পরিচয় ও সামাজিক প্রভাব ফিরে পেলেন? কারা তাঁকে সহায়তা দিচ্ছে? প্রশাসন কি নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করছে?
জানা গেছে, সেলিম প্রধান এখনো একাধিক মামলার মুখোমুখি। রয়েছে এনবিআর ও দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্ত। দেশের বাইরে—বিশেষ করে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, দুবাই ও নিউইয়র্কে তার নামে বিভিন্ন সম্পত্তির খোঁজ মিলেছে। তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকার লেনদেনের রেকর্ড এখনো তদন্তাধীন।
রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জন রয়েছে, তার পেছনে আছে ক্ষমতাসীন দলের একটি অংশ এবং বিতর্কিত ব্যবসায়ী মহল। এমনকি একজন প্রভাবশালী নেতার মাধ্যমে তাকে রাজনীতির ছাতার নিচে নিয়ে আসা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। যদিও সরকারিভাবে এসবের কিছুই স্বীকার করা হয়নি।
স্থানীয় বাসিন্দাদের কেউ মুখ খুলতে চায় না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ব্যবসায়ী বলেন, “তিনি জেল থেকে ফিরেই আবারো প্রভাব বিস্তার শুরু করেছেন। সবাই চুপ থাকে, কারণ তার সঙ্গে এখন আবার বড় বড় লোকের নাম জড়িয়ে গেছে।”
এই পরিস্থিতি স্থানীয় প্রশাসনকেও প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। কেন এত অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না? কেন ব্যবসায়ীদের অভিযোগে কোনো অগ্রগতি নেই?
সেলিম প্রধান নিজে অবশ্য দাবী করেছেন, তিনি নতুন জীবন শুরু করতে চান। এক সময় ভুল করেছিলেন, এখন সমাজের জন্য কাজ করতে চান। তবে বাস্তবতা হলো তার ঘুরে দাঁড়ানো সমাজে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। কারণ, তাকে কেন্দ্র করেই আবারো জমছে পুরনো অপরাধের জাল। অনেকে বলছেন, এটা তার নিজস্ব ব্যবসা ও অপরাধ ঢাকার একটি কৌশল।
এক সময়ের কুখ্যাত অপরাধী কীভাবে আবার সমাজে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছেন? কেন প্রশাসন নীরব? কারা তাকে রাজনৈতিক ছত্রছায়া দিচ্ছে? এসব প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে রূপগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ জুড়ে।
অনুসুন্ধানে আরও জানা গেছে, তার নামে এখনো বিভিন্ন দেশে ১০টির বেশি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। মালয়েশিয়া, দুবাই, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও নিউইয়র্কে আছে প্রপার্টি। তার প্রতিষ্ঠানগুলোতে কোটি কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছে, যার উৎস অজানা।
ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ মুখ খুলতে ভয় পান। এক গোপন সূত্রে একজন জানান, “সে এখন আবার ফিরে এসেছে, অথচ তার বিচার হয়নি। তার স্ত্রীদের কেউ এখনো বিচারের জন্য আবেদন করতেও সাহস পান না।”
এই পরিস্থিতি আমাদের রাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থা, রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা এবং প্রশাসনিক দুর্বলতার বড় উদাহরণ। একজন দ-িত, বহুবিবাহকারী, নারী হয়রানিকারী, অর্থ পাচারকারী ব্যক্তির যদি আবার রাজনীতি ও সমাজে স্থান হয়, তাহলে সেটি কেবল ব্যক্তির দায় নয়—সমগ্র ব্যবস্থার ব্যর্থতা।