ঢাকা ১১:২০ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৭ জুলাই ২০২৫, ১২ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
ভেলপুরি বিক্রেতা থেকে মুক্তির আন্দোলনের শহীদ

ভেলপুরি বিক্রেতা থেকে মুক্তির আন্দোলনের শহীদ

প্রতিবেদকের নাম :
  • আপডেট সময় : ০৪:৩৭:৪১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই ২০২৫
  • / ২৯ জন পড়েছেন

সোজাসাপটা রিপোর্ট
নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁ উপজেলার জামপুর ইউনিয়নের কলতাপাড়া গ্রামের এক নিঃস্ব পরিবারে ২০০৪ সালের ৮ মে জন্মগ্রহণ করেন হযরত বিল্লাল। দরিদ্র বাবার সংসারে তার শৈশব কখনোই ছিল না খেলাধুলা আর নির্ভার হাসির। পরিবারের পেট চালানোর দায় মাথায় নিয়ে কিশোর বয়স থেকেই বাবার সাথে নারায়ণগঞ্জ শহরের ফুটপাতে ঝালমুড়ি ও ভেলপুরি বিক্রি করতেন। শহরের কোনো এক গলির কোণায় বসা সেই ছেলে স্বপ্ন দেখেছিলেন নিজের ভাগ্য বদলানোর। পাসপোর্ট করেছিলেন, দালালের খোঁজে ঘুরেছেন বিদেশ যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে। নভেম্বর মাসে ফ্লাইট হওয়ার সম্ভাবনাও ছিল। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর বাস্তবে ধরা পড়েনি। কারণ, তার আগেই ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট তিনি শহীদ হয়ে যান।
বিল্লালের এই মৃত্যু কোনো দুর্ঘটনা নয়। এটি ছিল একটি গণতান্ত্রিক স্বপ্নের বিনিময়ে দেওয়া আত্মত্যাগ। এক বিশাল রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন যন্ত্রের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একজন ভেলপুরি বিক্রেতার কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল মুক্তির আহ্বান। পতিত স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে যখন ছাত্র ও সাধারণ জনগণ রুখে দাঁড়ায়, তখন হযরত বিল্লালও নিজের ক্ষুধার্ত ভবিষ্যতের হিসেব পেছনে রেখে রাস্তায় নেমে আসেন।
৫ আগস্ট ছিল সেই দিন, যেদিন বাংলাদেশের ইতিহাস নতুন করে লেখা হয়েছিল সাধারণ মানুষের রক্ত দিয়ে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির ডাক দেয়। লাখ লাখ মানুষ, বিশেষত তরুণ প্রজন্ম এই কর্মসূচিতে অংশ নেয়। যাত্রাবাড়ী এলাকার মেয়র হানিফ টোল প্লাজা ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান। সেখানেই অবস্থান নিয়েছিলেন হযরত বিল্লাল, নারায়ণগঞ্জ থেকে গিয়ে অংশগ্রহণ করেন তিনি।
বেলা ১টার দিকে রাষ্ট্রীয় বাহিনী পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগ ও ছাত্রলীগ মিলে এই নিরস্ত্র জনতার ওপর অতর্কিত সশস্ত্র হামলা চালায়। গুলিবর্ষণ শুরু হয়। শত শত মানুষ আহত হন, বহুজন নিহত। একটি গুলি এসে হযরত বিল্লালের কপালে বিদ্ধ হয়। তিনি সাথে সাথেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করান। কিন্তু চিকিৎসকরা তাকে আর বাঁচাতে পারেননি। রাত ১২টার দিকে হযরত বিল্লাল শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
যে পরিবারের কিছুই ছিল না, তারা আজ এক শহীদকে বুকে নিয়ে বেঁচে আছে
হযরত বিল্লালের পরিবারটি আজও নিঃস্ব। তার বাবা মোহাম্মদ হোসেনের নিজস্ব কোনো জমি নেই, নেই মাথা গোঁজার জায়গাও। নারায়ণগঞ্জ শহরের একটি ছোট্ট ভাড়া বাসায় দুই ছেলেকে নিয়ে কোনো রকমে বসবাস করতেন। বড় ছেলে আল মামুন (২৪) ফুটপাতে বসে ব্যবসা চালান, আর ছোট ছেলে চাঁন মানিক (১৬) এখনো বেকার। হযরত বিল্লালই ছিল একমাত্র সন্তান, যাকে ঘিরে পরিবারের স্বপ্ন ছিল একটু স্বস্তির জীবনের। কিন্তু সে স্বপ্ন রক্তে ভেসে গেছে যাত্রাবাড়ীর রাস্তায়। দেশের স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে প্রাণ দিয়ে গেছেন তিনি।
এই পরিবারটিকে যদি বাসস্থান ও জীবিকার ব্যবস্থা করে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক উদ্যোগ নেওয়া হতো, তবে তা হতো শহীদের প্রতি প্রাপ্য সম্মান প্রদর্শনের অন্যতম পথ।
নারায়ণগঞ্জ শহরে নির্মিত হয়েছে প্রথম “জুলাই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ”, যেখানে খোদাই করে লেখা আছে ২১ জন শহীদের নাম। যারা গতবছরের জুলাই ও আগস্ট মাসের ছাত্র আন্দোলন থেকে গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়া আন্দোলনে শাহাদাত বরণ করেন। শহীদ হযরত বিল্লাল এই ২১ জনের একজন। তার নাম আজ ইতিহাসের পাতায়, স্মৃতির ফলকে, আর সাধারণ মানুষের বুকের গভীরে অমর হয়ে আছে।
এই শহীদদের সম্মানে স্মৃতিস্তম্ভ গড়া হলেও তাদের পরিবারের জন্য কোনো স্থায়ী সরকারি সহায়তা এখনো দৃশ্যমান নয়। শহীদের রক্তে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের নতুন ভোর ফুটেছে, কিন্তু তাদের পরিবারের কপালে জোটেনি সুরক্ষা বা মর্যাদা।
হযরত বিল্লাল কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মী ছিলেন না। তিনি ছিলেন এই দেশের মাটি, মানুষের প্রতিনিধি। ফুটপাতের একজন কিশোর বিক্রেতা হয়েও অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। অস্ত্র হাতে নয়, বুক চিতিয়ে। শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে, ভবিষ্যতের দুঃস্বপ্ন জেনেও তিনি ছিলেন হাজারো সাধারণ মানুষের কাতারে। তার রক্ত বাংলাদেশের গাঢ় লাল সূর্য হয়ে উঠেছে। শহীদ হযরত বিল্লাল এই প্রজন্মের কাছে এক অনুপ্রেরণার নাম, সাহসের প্রতীক।

ট্যাগ :

সংবাদটি সোস্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন

ভেলপুরি বিক্রেতা থেকে মুক্তির আন্দোলনের শহীদ

ভেলপুরি বিক্রেতা থেকে মুক্তির আন্দোলনের শহীদ

আপডেট সময় : ০৪:৩৭:৪১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই ২০২৫

সোজাসাপটা রিপোর্ট
নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁ উপজেলার জামপুর ইউনিয়নের কলতাপাড়া গ্রামের এক নিঃস্ব পরিবারে ২০০৪ সালের ৮ মে জন্মগ্রহণ করেন হযরত বিল্লাল। দরিদ্র বাবার সংসারে তার শৈশব কখনোই ছিল না খেলাধুলা আর নির্ভার হাসির। পরিবারের পেট চালানোর দায় মাথায় নিয়ে কিশোর বয়স থেকেই বাবার সাথে নারায়ণগঞ্জ শহরের ফুটপাতে ঝালমুড়ি ও ভেলপুরি বিক্রি করতেন। শহরের কোনো এক গলির কোণায় বসা সেই ছেলে স্বপ্ন দেখেছিলেন নিজের ভাগ্য বদলানোর। পাসপোর্ট করেছিলেন, দালালের খোঁজে ঘুরেছেন বিদেশ যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে। নভেম্বর মাসে ফ্লাইট হওয়ার সম্ভাবনাও ছিল। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর বাস্তবে ধরা পড়েনি। কারণ, তার আগেই ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট তিনি শহীদ হয়ে যান।
বিল্লালের এই মৃত্যু কোনো দুর্ঘটনা নয়। এটি ছিল একটি গণতান্ত্রিক স্বপ্নের বিনিময়ে দেওয়া আত্মত্যাগ। এক বিশাল রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন যন্ত্রের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একজন ভেলপুরি বিক্রেতার কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল মুক্তির আহ্বান। পতিত স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে যখন ছাত্র ও সাধারণ জনগণ রুখে দাঁড়ায়, তখন হযরত বিল্লালও নিজের ক্ষুধার্ত ভবিষ্যতের হিসেব পেছনে রেখে রাস্তায় নেমে আসেন।
৫ আগস্ট ছিল সেই দিন, যেদিন বাংলাদেশের ইতিহাস নতুন করে লেখা হয়েছিল সাধারণ মানুষের রক্ত দিয়ে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির ডাক দেয়। লাখ লাখ মানুষ, বিশেষত তরুণ প্রজন্ম এই কর্মসূচিতে অংশ নেয়। যাত্রাবাড়ী এলাকার মেয়র হানিফ টোল প্লাজা ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান। সেখানেই অবস্থান নিয়েছিলেন হযরত বিল্লাল, নারায়ণগঞ্জ থেকে গিয়ে অংশগ্রহণ করেন তিনি।
বেলা ১টার দিকে রাষ্ট্রীয় বাহিনী পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগ ও ছাত্রলীগ মিলে এই নিরস্ত্র জনতার ওপর অতর্কিত সশস্ত্র হামলা চালায়। গুলিবর্ষণ শুরু হয়। শত শত মানুষ আহত হন, বহুজন নিহত। একটি গুলি এসে হযরত বিল্লালের কপালে বিদ্ধ হয়। তিনি সাথে সাথেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করান। কিন্তু চিকিৎসকরা তাকে আর বাঁচাতে পারেননি। রাত ১২টার দিকে হযরত বিল্লাল শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
যে পরিবারের কিছুই ছিল না, তারা আজ এক শহীদকে বুকে নিয়ে বেঁচে আছে
হযরত বিল্লালের পরিবারটি আজও নিঃস্ব। তার বাবা মোহাম্মদ হোসেনের নিজস্ব কোনো জমি নেই, নেই মাথা গোঁজার জায়গাও। নারায়ণগঞ্জ শহরের একটি ছোট্ট ভাড়া বাসায় দুই ছেলেকে নিয়ে কোনো রকমে বসবাস করতেন। বড় ছেলে আল মামুন (২৪) ফুটপাতে বসে ব্যবসা চালান, আর ছোট ছেলে চাঁন মানিক (১৬) এখনো বেকার। হযরত বিল্লালই ছিল একমাত্র সন্তান, যাকে ঘিরে পরিবারের স্বপ্ন ছিল একটু স্বস্তির জীবনের। কিন্তু সে স্বপ্ন রক্তে ভেসে গেছে যাত্রাবাড়ীর রাস্তায়। দেশের স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে প্রাণ দিয়ে গেছেন তিনি।
এই পরিবারটিকে যদি বাসস্থান ও জীবিকার ব্যবস্থা করে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক উদ্যোগ নেওয়া হতো, তবে তা হতো শহীদের প্রতি প্রাপ্য সম্মান প্রদর্শনের অন্যতম পথ।
নারায়ণগঞ্জ শহরে নির্মিত হয়েছে প্রথম “জুলাই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ”, যেখানে খোদাই করে লেখা আছে ২১ জন শহীদের নাম। যারা গতবছরের জুলাই ও আগস্ট মাসের ছাত্র আন্দোলন থেকে গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়া আন্দোলনে শাহাদাত বরণ করেন। শহীদ হযরত বিল্লাল এই ২১ জনের একজন। তার নাম আজ ইতিহাসের পাতায়, স্মৃতির ফলকে, আর সাধারণ মানুষের বুকের গভীরে অমর হয়ে আছে।
এই শহীদদের সম্মানে স্মৃতিস্তম্ভ গড়া হলেও তাদের পরিবারের জন্য কোনো স্থায়ী সরকারি সহায়তা এখনো দৃশ্যমান নয়। শহীদের রক্তে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের নতুন ভোর ফুটেছে, কিন্তু তাদের পরিবারের কপালে জোটেনি সুরক্ষা বা মর্যাদা।
হযরত বিল্লাল কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মী ছিলেন না। তিনি ছিলেন এই দেশের মাটি, মানুষের প্রতিনিধি। ফুটপাতের একজন কিশোর বিক্রেতা হয়েও অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। অস্ত্র হাতে নয়, বুক চিতিয়ে। শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে, ভবিষ্যতের দুঃস্বপ্ন জেনেও তিনি ছিলেন হাজারো সাধারণ মানুষের কাতারে। তার রক্ত বাংলাদেশের গাঢ় লাল সূর্য হয়ে উঠেছে। শহীদ হযরত বিল্লাল এই প্রজন্মের কাছে এক অনুপ্রেরণার নাম, সাহসের প্রতীক।