ঢাকা ০৩:০৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ০১ জুলাই ২০২৫, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :

রাইফেল ক্লাবের লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার হয়নি এখনও

আল আমীন মাহমুদ অর্ণব
  • আপডেট সময় : ০১:২৮:৫৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫
  • / ২৯ জন পড়েছেন

নারায়ণগঞ্জ শহরের প্রানকেন্দ্রে অবস্থিত রাইফেল ক্লাব। সরকারি স্থাপনা হলেও রাইফেল ক্লাব ছিল গডফাদার শামীম ওসমানের অঘোষিত অফিস ও টর্চার সেল। এখানে বসেই নারায়ণগঞ্জ শহরের রাজনীতি ও নানা অপকর্ম নিয়ন্ত্রণ করতেন শামীম ওসমান।
২০২৪ সালের ১৯ জুলাই শুক্রবার সকাল থেকেই ছাত্র-জনতা চাষাড়া মোড়ে তাদের কর্মসূচি পালনে জড়ো হতে থাকে। খবর পেয়ে বেলা ১২টার দিকে গডফাদার শামীম ওসমান চাষাড়ার রাইফেল ক্লাবে অবস্থান করে। আন্দোলনের ফলে শহরের বিভিন্ন বিক্রয়কেন্দ্র, শপিংমল, দোকানপাট বন্ধ থাকে। এসময় শামীম ওসমান তাঁর নিজ সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে দোকান মালিকদের এক প্রকার জোরপূর্বক দোকান খোলতে বাধ্য করে এবং নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের দিকে অবস্থান নেয়।
আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা পরবর্তীতে আবার এসে দোকান বন্ধ করার অনুরোধ করলে দোকান মালিকরা আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে দোকান বন্ধ করে দেয়। এসময় আন্দোলনকারীদের অবস্থান বাড়তে থাকায় গডফাদার শামীম ওসমান ও তাঁর সন্ত্রাসী বাহিনী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে তানভীর আহমেদ টিটুর নেতৃত্বে নারায়ণগঞ্জ রাইফেল ক্লাব থেকে অত্যাধুনিক ১৪২টি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে বিবি রোডের নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সামনে জড়ো করে। উপস্থিত থাকা সকলকে রাইফেল ক্লাবের অস্ত্র দিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর গুলিবর্ষণ করার নির্দেশ দেয় শামীম ওসমান। ছাত্র আন্দোলন দমনে ১৯ জুলাই শামীম ওসমানের নেতৃত্বে তার নেতাকর্মীরা আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে শহরের চাষাড়া ও জালকুড়ি এলাকায় ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করে তান্ডব চালায়। এমন দুটি ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরালও হয়। তাতে দেখা যায়, শামীম ওসমানের ছেলে জালকুড়ি এলাকায় এবং শ্যালক তানভীর আহমেদ টিটু চাষাড়ায় গুলি ছুড়তে। এসব ঘটনায় শামীম ওসমানের আত্মীয় (অয়ন ওসমানের শ্বশুর) ফয়েজ উদ্দিন (লাভলু), তার ছেলে মিনহাজুল ইসলাম ও শীতল পরিবহনের বাসের পরিচালক অনুপ কুমার সাহা, ১২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি নিয়াজুল ইসলাম (২০১৮ সালে মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর ওপর অস্ত্র উঁচিয়ে ধরে আলোচিত) প্রমুখকে দেখা যায়। তারা আন্দোলনকারীদের ধাওয়া দিয়ে শহরের ম-লপাড়া পর্যন্ত হটিয়ে দিয়েছিলেন। ওই দিনের মহড়ায় শামীম ওসমানের ভাতিজা আজমেরী ওসমান, মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শাহ নিজাম, মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি হাবিবুর রহমান রিয়াদ, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি রাফেল, নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র ও আবদুল করিম (বাবু) ও তার ছেলে এম আর কে রিয়েন, ছাত্রলীগ নেতা কাউসার আহমেদও উপস্থিত ছিলেন।
১৯ জুলাই শহরের নয়ামাটি এলাকায় চারতলার বাড়ির ছাদে খেলার সময় ছয় বছরের শিশু রিয়া গোপ মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। তখন অভিযোগ উঠে, শামীম ওসমান ও তার সহযোগীদের গুলিতে রিয়া গোপের মৃত্যু হয়।
শামীম ওসমানের সকল অপকর্মের প্রতীক ছিলো এই রাইফেল ক্লাব। রাইফেল ক্লাবের ভেতরে ছিল শামীম ওসমানের টর্চারসেল। শামীম ওসমানের মতের বিরোধীতা করলেই রাইফেল ক্লাবে ডেকে নিয়ে টর্চার করা হত। ২০১১ সালের পর থেকেই নারায়ণগঞ্জ শহর গুম ও খুনের শহর হিসেবে দেশব্যাপী সমালোচিত হতে থাকে। আশিক, চঞ্চল, বুলু, ত্বকী, সাত খুনসহ একের পর এক হাইপ্রোফাইল হত্যাকান্ডের ঘটনায় সন্ত্রাসের জনপদে পরিনত হয় নারায়ণগঞ্জ। এসকল ঘটনার প্রতিটিতেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল রাইফেল ক্লাব।
এছাড়াও নারায়ণগঞ্জ শহরের ঝুট সেক্টরের নিয়ন্ত্রণ, ব্যাবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়, ফুটপাতের হকার নিয়ন্ত্রণ, সরকারি বিভিন্ন টেন্ডারসহ পুরো শহর এই রাইফেল ক্লাব থেকেই নিয়ন্ত্রণ করা হত।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ২৭ জুলাই ও ৩০ জুলাই শামীম ওসমান তার অনুসারী দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে মিটিং করেন। এর আগে ১৯ জুলাই খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, ছাত্র-জনতাকে প্রতিহত করতে যেসব অস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলো রাইফেল ক্লাব থেকে সরবরাহ করা হয়েছে। এরপর থেকেই রাইফেল ক্লাবের ওপর নজর পড়ে একটি পক্ষের। প্রথমে রাইফেল ক্লাব বাইরে থেকে ঢিল ছুড়ে এর কাঁচ ভাঙচুর করা হয়। কিন্তু ৪ আগস্ট হামলাকারীরা রাইফেল ক্লাবে স্টিলের গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে ভাঙচুর শেষে আগুন ধরিয়ে দেয়। ওই সময়ই ভল্ট ভেঙে লুট করে নেয়া হয় অস্ত্র ও গোলাবারুদ।
এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাইফেল ক্লাবের একাধিক সদস্য জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে মূলত ১৯ জুলাই রাইফেল ক্লাবের ভল্টে থাকা অস্ত্র তৎকালীন সরকার দলীয়দের হাতে তুলে দেয়া হয়। সেগুলো আর ফেরত নেয়া হয়নি। রাইফেল ক্লাব পরিচালনার সঙ্গে জড়িত একটি গ্রুপ চাইছিল যেন ক্লাবে হামলা হয় এবং ক্লাবের ভল্ট ভেঙে ফেলা হয়। এতে তারা প্রচার করতে পারবে যে অস্ত্র ও গুলি লুট হয়ে গেছে। ফলে ক্লাবের অস্ত্রগুলো গায়েব করে দেয়া সহজ হবে। বাস্তবে হয়েছেও তাই।
ওই সূত্রটি আরও জানায়, গত ৪ ও ৫ই আগস্ট দিনব্যাপী যারা রাইফেল ক্লাবে হামলা ও লুটপাট চালিয়েছে তারা কেউ ছাত্র নয়। তাদের বেশির ভাগই ছিল নগরের চানমারি ও এর আশপাশের এলাকার বাসিন্দা। তারা এক আওয়ামী লীগ নেতার অনুসারী হিসেবেও পরিচিত। ঘটনার সময় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ক্লাব লুটপাটের সেই ঘটনার ভিডিও ও স্থির চিত্র ধারণ করে রেখেছে। ভবিষ্যতে সেগুলো প্রকাশ পাবে। তখনই পরিষ্কার হয়ে যাবে যে, ক্লাবে হামলা ও লুটপাটের সঙ্গে কারা জড়িত ছিল।
ঘটনার প্রায় এক মাস পর ৭ সেপ্টেম্বর ফতুল্লা মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন ক্লাবের শুটিং সম্পাদক কাজী ইমরুল কায়েস। তবে মামলাটির তদন্তে কোনো গতি দেখা যায়নি। ক্লাব কর্তৃপক্ষের হিসেব অনুযায়ী ৮৩টি অস্ত্র ও সাড়ে ১০ হাজার গুলি লুট হয়েছে ক্লাব থেকে।
ক্লাবের ভল্ট ভেঙে অস্ত্র লুটের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিলে তারা থানাসহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠান থেকে লুট করা অস্ত্র ফেরত দিতে সময় বেঁধে দেন। ওই সময় নগরের নবীগঞ্জ খেয়াঘাটের পাশের ঝোঁপ থেকে পয়েন্ট ১৭৭ বোরের ২টি এয়ার পিস্তল এবং পয়েন্ট ২২ বোরের ২টি পিস্তল উদ্ধার করা হয়। এর কিছুদিন পর খানপুর এলাকাবাসীর কাছ থেকে খবর পেয়ে এলাকার কচুখেত থেকে পয়েন্ট ১৭৭ বোরের ৩টি এয়ার রাইফেল এবং পয়েন্ট ২২ বোরের একটি রাইফেল উদ্ধার করে সেনাবাহিনী এবং র‌্যাবের হেফাজতে দিয়ে দেয়। পরবর্তীকালে নারায়ণগঞ্জ, ফতুল্লা ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় লুট হওয়া অস্ত্র জমা দিলে সেখানে রাইফেল ক্লাব থেকে লুট হওয়া আরও ৭-৮টি অস্ত্র দেখা রাইফেল ক্লাবের বলে জানা যায়। তবে কোনো গুলি উদ্ধার হয়েছে এমনটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
তবে এখন পর্যন্ত অস্ত্র লুটের ১০ মাস পার হলেও অধিকাংশ অস্ত্র এখনও উদ্ধার করতে সক্ষম হয়নি প্রশাসন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ ও অপারেশন) তারেক আল মেহেদী জানান, নারায়ণগঞ্জ রাইফেল ক্লাবের কিছু অস্ত্র উদ্ধার হলেও এখন পর্যন্ত অধিকাংশ অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তবে অস্ত্র উদ্ধারে এখনও অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

ট্যাগ :

সংবাদটি সোস্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন

রাইফেল ক্লাবের লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার হয়নি এখনও

আপডেট সময় : ০১:২৮:৫৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫

নারায়ণগঞ্জ শহরের প্রানকেন্দ্রে অবস্থিত রাইফেল ক্লাব। সরকারি স্থাপনা হলেও রাইফেল ক্লাব ছিল গডফাদার শামীম ওসমানের অঘোষিত অফিস ও টর্চার সেল। এখানে বসেই নারায়ণগঞ্জ শহরের রাজনীতি ও নানা অপকর্ম নিয়ন্ত্রণ করতেন শামীম ওসমান।
২০২৪ সালের ১৯ জুলাই শুক্রবার সকাল থেকেই ছাত্র-জনতা চাষাড়া মোড়ে তাদের কর্মসূচি পালনে জড়ো হতে থাকে। খবর পেয়ে বেলা ১২টার দিকে গডফাদার শামীম ওসমান চাষাড়ার রাইফেল ক্লাবে অবস্থান করে। আন্দোলনের ফলে শহরের বিভিন্ন বিক্রয়কেন্দ্র, শপিংমল, দোকানপাট বন্ধ থাকে। এসময় শামীম ওসমান তাঁর নিজ সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে দোকান মালিকদের এক প্রকার জোরপূর্বক দোকান খোলতে বাধ্য করে এবং নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের দিকে অবস্থান নেয়।
আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা পরবর্তীতে আবার এসে দোকান বন্ধ করার অনুরোধ করলে দোকান মালিকরা আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে দোকান বন্ধ করে দেয়। এসময় আন্দোলনকারীদের অবস্থান বাড়তে থাকায় গডফাদার শামীম ওসমান ও তাঁর সন্ত্রাসী বাহিনী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে তানভীর আহমেদ টিটুর নেতৃত্বে নারায়ণগঞ্জ রাইফেল ক্লাব থেকে অত্যাধুনিক ১৪২টি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে বিবি রোডের নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সামনে জড়ো করে। উপস্থিত থাকা সকলকে রাইফেল ক্লাবের অস্ত্র দিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর গুলিবর্ষণ করার নির্দেশ দেয় শামীম ওসমান। ছাত্র আন্দোলন দমনে ১৯ জুলাই শামীম ওসমানের নেতৃত্বে তার নেতাকর্মীরা আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে শহরের চাষাড়া ও জালকুড়ি এলাকায় ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করে তান্ডব চালায়। এমন দুটি ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরালও হয়। তাতে দেখা যায়, শামীম ওসমানের ছেলে জালকুড়ি এলাকায় এবং শ্যালক তানভীর আহমেদ টিটু চাষাড়ায় গুলি ছুড়তে। এসব ঘটনায় শামীম ওসমানের আত্মীয় (অয়ন ওসমানের শ্বশুর) ফয়েজ উদ্দিন (লাভলু), তার ছেলে মিনহাজুল ইসলাম ও শীতল পরিবহনের বাসের পরিচালক অনুপ কুমার সাহা, ১২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি নিয়াজুল ইসলাম (২০১৮ সালে মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর ওপর অস্ত্র উঁচিয়ে ধরে আলোচিত) প্রমুখকে দেখা যায়। তারা আন্দোলনকারীদের ধাওয়া দিয়ে শহরের ম-লপাড়া পর্যন্ত হটিয়ে দিয়েছিলেন। ওই দিনের মহড়ায় শামীম ওসমানের ভাতিজা আজমেরী ওসমান, মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শাহ নিজাম, মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি হাবিবুর রহমান রিয়াদ, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি রাফেল, নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র ও আবদুল করিম (বাবু) ও তার ছেলে এম আর কে রিয়েন, ছাত্রলীগ নেতা কাউসার আহমেদও উপস্থিত ছিলেন।
১৯ জুলাই শহরের নয়ামাটি এলাকায় চারতলার বাড়ির ছাদে খেলার সময় ছয় বছরের শিশু রিয়া গোপ মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। তখন অভিযোগ উঠে, শামীম ওসমান ও তার সহযোগীদের গুলিতে রিয়া গোপের মৃত্যু হয়।
শামীম ওসমানের সকল অপকর্মের প্রতীক ছিলো এই রাইফেল ক্লাব। রাইফেল ক্লাবের ভেতরে ছিল শামীম ওসমানের টর্চারসেল। শামীম ওসমানের মতের বিরোধীতা করলেই রাইফেল ক্লাবে ডেকে নিয়ে টর্চার করা হত। ২০১১ সালের পর থেকেই নারায়ণগঞ্জ শহর গুম ও খুনের শহর হিসেবে দেশব্যাপী সমালোচিত হতে থাকে। আশিক, চঞ্চল, বুলু, ত্বকী, সাত খুনসহ একের পর এক হাইপ্রোফাইল হত্যাকান্ডের ঘটনায় সন্ত্রাসের জনপদে পরিনত হয় নারায়ণগঞ্জ। এসকল ঘটনার প্রতিটিতেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল রাইফেল ক্লাব।
এছাড়াও নারায়ণগঞ্জ শহরের ঝুট সেক্টরের নিয়ন্ত্রণ, ব্যাবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়, ফুটপাতের হকার নিয়ন্ত্রণ, সরকারি বিভিন্ন টেন্ডারসহ পুরো শহর এই রাইফেল ক্লাব থেকেই নিয়ন্ত্রণ করা হত।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ২৭ জুলাই ও ৩০ জুলাই শামীম ওসমান তার অনুসারী দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে মিটিং করেন। এর আগে ১৯ জুলাই খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, ছাত্র-জনতাকে প্রতিহত করতে যেসব অস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলো রাইফেল ক্লাব থেকে সরবরাহ করা হয়েছে। এরপর থেকেই রাইফেল ক্লাবের ওপর নজর পড়ে একটি পক্ষের। প্রথমে রাইফেল ক্লাব বাইরে থেকে ঢিল ছুড়ে এর কাঁচ ভাঙচুর করা হয়। কিন্তু ৪ আগস্ট হামলাকারীরা রাইফেল ক্লাবে স্টিলের গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে ভাঙচুর শেষে আগুন ধরিয়ে দেয়। ওই সময়ই ভল্ট ভেঙে লুট করে নেয়া হয় অস্ত্র ও গোলাবারুদ।
এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাইফেল ক্লাবের একাধিক সদস্য জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে মূলত ১৯ জুলাই রাইফেল ক্লাবের ভল্টে থাকা অস্ত্র তৎকালীন সরকার দলীয়দের হাতে তুলে দেয়া হয়। সেগুলো আর ফেরত নেয়া হয়নি। রাইফেল ক্লাব পরিচালনার সঙ্গে জড়িত একটি গ্রুপ চাইছিল যেন ক্লাবে হামলা হয় এবং ক্লাবের ভল্ট ভেঙে ফেলা হয়। এতে তারা প্রচার করতে পারবে যে অস্ত্র ও গুলি লুট হয়ে গেছে। ফলে ক্লাবের অস্ত্রগুলো গায়েব করে দেয়া সহজ হবে। বাস্তবে হয়েছেও তাই।
ওই সূত্রটি আরও জানায়, গত ৪ ও ৫ই আগস্ট দিনব্যাপী যারা রাইফেল ক্লাবে হামলা ও লুটপাট চালিয়েছে তারা কেউ ছাত্র নয়। তাদের বেশির ভাগই ছিল নগরের চানমারি ও এর আশপাশের এলাকার বাসিন্দা। তারা এক আওয়ামী লীগ নেতার অনুসারী হিসেবেও পরিচিত। ঘটনার সময় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ক্লাব লুটপাটের সেই ঘটনার ভিডিও ও স্থির চিত্র ধারণ করে রেখেছে। ভবিষ্যতে সেগুলো প্রকাশ পাবে। তখনই পরিষ্কার হয়ে যাবে যে, ক্লাবে হামলা ও লুটপাটের সঙ্গে কারা জড়িত ছিল।
ঘটনার প্রায় এক মাস পর ৭ সেপ্টেম্বর ফতুল্লা মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন ক্লাবের শুটিং সম্পাদক কাজী ইমরুল কায়েস। তবে মামলাটির তদন্তে কোনো গতি দেখা যায়নি। ক্লাব কর্তৃপক্ষের হিসেব অনুযায়ী ৮৩টি অস্ত্র ও সাড়ে ১০ হাজার গুলি লুট হয়েছে ক্লাব থেকে।
ক্লাবের ভল্ট ভেঙে অস্ত্র লুটের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিলে তারা থানাসহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠান থেকে লুট করা অস্ত্র ফেরত দিতে সময় বেঁধে দেন। ওই সময় নগরের নবীগঞ্জ খেয়াঘাটের পাশের ঝোঁপ থেকে পয়েন্ট ১৭৭ বোরের ২টি এয়ার পিস্তল এবং পয়েন্ট ২২ বোরের ২টি পিস্তল উদ্ধার করা হয়। এর কিছুদিন পর খানপুর এলাকাবাসীর কাছ থেকে খবর পেয়ে এলাকার কচুখেত থেকে পয়েন্ট ১৭৭ বোরের ৩টি এয়ার রাইফেল এবং পয়েন্ট ২২ বোরের একটি রাইফেল উদ্ধার করে সেনাবাহিনী এবং র‌্যাবের হেফাজতে দিয়ে দেয়। পরবর্তীকালে নারায়ণগঞ্জ, ফতুল্লা ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় লুট হওয়া অস্ত্র জমা দিলে সেখানে রাইফেল ক্লাব থেকে লুট হওয়া আরও ৭-৮টি অস্ত্র দেখা রাইফেল ক্লাবের বলে জানা যায়। তবে কোনো গুলি উদ্ধার হয়েছে এমনটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
তবে এখন পর্যন্ত অস্ত্র লুটের ১০ মাস পার হলেও অধিকাংশ অস্ত্র এখনও উদ্ধার করতে সক্ষম হয়নি প্রশাসন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ ও অপারেশন) তারেক আল মেহেদী জানান, নারায়ণগঞ্জ রাইফেল ক্লাবের কিছু অস্ত্র উদ্ধার হলেও এখন পর্যন্ত অধিকাংশ অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তবে অস্ত্র উদ্ধারে এখনও অভিযান অব্যাহত রয়েছে।