চাষাড়ার যানজট নিরসনে প্রশাসনের নতুন উদ্যোগ
চাষাড়ার যানজট নিরসনে প্রশাসনের নতুন উদ্যোগ

- আপডেট সময় : ০৩:২৭:২১ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৬ জুলাই ২০২৫
- / ২৭ জন পড়েছেন
সোজাসাপটা রিপোর্ট
নারায়ণগঞ্জে দায়িত্ব পালনের ছয় মাস পূর্তি উপলক্ষে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা আয়োজিত ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানটি পরিণত হলো এক ব্যতিক্রমধর্মী সমাবেশে। সোমবার (১৫ জুলাই) দুপুরে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে জেলার শীর্ষস্থানীয় সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন। প্রশাসনের সঙ্গে গণমাধ্যমের সম্পর্ক, নারায়ণগঞ্জের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা ও চলমান সংকট নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হয়। সেই আলোচনায় নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাব এর সভাপতি আবু সাউদ মাসুদ ও সাধারণ সম্পাদক আফজাল হোসেন পন্টিসহ উপস্থিত সাংবাদিকের বক্তব্য, মতামত ও সমস্যার কথা শুণে জেলা প্রশাসক বিশেষ ভাবে চাষাড়ার যানজট পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তাঁর বিশেষ পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, চাষাড়াকে যানজটমুক্ত করে ফ্রি রাখতে আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। ১২ টি পয়েন্টে অটো ঘুরিয়ে দেয়া হবে। তাহলেই চাষাড়া ফ্রি থাকবে।
সভায় জেলা প্রশাসক বলেন, ‘আমি নিজেকে জনগণের সেবক হিসেবে দেখি, আমলা হিসেবে নয়। নারায়ণগঞ্জ একটি ঐতিহাসিক জেলা, যার প্রতিটি ইঞ্চিতে গল্প আছে, স্মৃতি আছে, সম্ভাবনা আছে। আমি চাই, এই শহর আবার তার প্রাচ্যের ডান্ডির অবস্থানে ফিরে যাক।’
ডিসি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর জাহিদুল ইসলাম মিঞা নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সবচেয়ে আলোচিত কর্মসূচি ছিল ‘গ্রিন অ্যান্ড ক্লিন নারায়ণগঞ্জ’-মাত্র ৬০ দিনে এক লাখ গাছ রোপণের কাজ শেষ করেছেন তিনি। এ নিয়ে সভায় তিনি বলেন, ‘সবকিছু সম্ভব যদি সদিচ্ছা থেকে। আমার টার্গেট ছিল নারায়ণগঞ্জ শহরে গাছের সংখ্যা বাড়ানো, আর সেই টার্গেট আমরা ছাড়িয়ে গেছি। তবে শুধু গাছ লাগালেই হবে না, সংরক্ষণও করতে হবে।’
পরিবেশ রক্ষা নিয়ে জেলা প্রশাসনের পরিকল্পনায় আরও রয়েছে- শহরের ড্রেন ও খালগুলো পুনরুদ্ধার। শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গার পানি দূষণ রোধে সম্মিলিত অভিযান। পার্ক, মাঠ ও খেলার জায়গা পুনর্গঠন।
তিনি বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জে মাদক, দখল ও যানজট এই তিনটি বড় সমস্যা। এর প্রতিটি ইস্যুতে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনিটর করছি।’‘মিট দ্য প্রেস’-এ অংশ নেওয়া সাংবাদিকদের অনেকেই জেলা শহরের বেহাল ট্রাফিক, হাসপাতালের চিকিৎসা সংকট ও ভূমি অফিসে দুর্নীতির বিষয়টি তুলে ধরেন।
জেলা প্রশাসক বলেন, “আমি দায়িত্ব নিয়েছি একটি স্পষ্ট লক্ষ্য নিয়ে-নতুন ধারার প্রশাসন। যেখানে মানুষ সেবা নিতে এসে হয়রানির শিকার হবে না, বরং শ্রদ্ধার সঙ্গে সেবা পাবে।” তিনি জানান, গত ছয় মাসে নারায়ণগঞ্জের ৭টি উপজেলায় ৩৬৮টি জনসেবা কার্যক্রম সরেজমিনে ঘুরে দেখেছেন। প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে স্কুল, হাট-বাজার, হাসপাতাল ও ইউনিয়ন পরিষদ পর্যায়ের কাজের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করেছেন।
পূর্বে অনুমোদিত কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা ১৪টি উন্নয়ন প্রকল্পকে অগ্রাধিকার দিয়ে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে। এর মধ্যে রয়েছে শীতলক্ষা নদীর পারের সৌন্দর্যবর্ধন, খানপুর হাসপাতালের আধুনিকীকরণ ও রেলস্টেশন এলাকার উন্নয়ন। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার মানোন্নয়ন ও ঝরে পড়া শিক্ষার্থী রোধে মাসে অন্তত একটি বিদ্যালয়ে অভিভাবকদের নিয়ে মতবিনিময় সভা করা হবে।
অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসক সাংবাদিকদের বলেন, “আমি ফাইল দেখে নয়, মাঠে গিয়ে কাজ বুঝি। এই শহরকে আমি শুধু প্রশাসনিকভাবে চালাতে চাই না, চাই একটি জীবন্ত, মানবিক শহরে রূপ দিতে।” তিনি আরও বলেন, নারায়ণগঞ্জকে ঘিরে একটি সমন্বিত মাস্টারপ্ল্যান তৈরি হচ্ছে, যেখানে নগরায়ণ, পরিবেশ, শিল্প ও মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা হবে।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত সাংবাদিকরা জেলার যানজট, দখলদারিত্ব, মাদকের বিস্তার ও স্বাস্থ্যসেবার দুর্দশা নিয়ে নানা প্রশ্ন ও প্রস্তাব উত্থাপন করেন। জেলা প্রশাসক সেসব শুনে তাৎক্ষণিকভাবে কয়েকটি বিষয় সমাধানে নির্দেশনা দেন।
উদাহরণস্বরূপ, শহরের প্রাণকেন্দ্র চাষাঢ়ায় ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তনের প্রস্তাব গ্রহণ করে তিনি বলেন, “পরীক্ষামূলকভাবে আগামী সপ্তাহ থেকে নতুন নিয়ম চালু করা হবে।” জেলা প্রশাসক তার বক্তব্যে বলেন, “আমার স্বপ্ন, নারায়ণগঞ্জ হবে এমন একটি জেলা, যেখানে প্রযুক্তি ও মানবিক মূল্যবোধ একসাথে এগিয়ে যাবে। নাগরিক সেবা হবে সবার নাগালে, আর শিশুরা শিখবে পরিচ্ছন্নতা, শৃঙ্খলা ও নৈতিকতা।”
নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে আয়োজিত ‘মিট দ্যা প্রেস’ অনুষ্ঠানে যখন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা তার ছয় মাসের অভিজ্ঞতা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার খসড়া তুলে ধরেন, তখনই বক্তৃতায় একটি ভিন্নমাত্রা যোগ করেন নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি ও দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার আবু সাউদ মাসুদ। তিনি সরলভাষায় বলেন, “আমাদের সাংবাদিকদের আচরণে পরিবর্তন আনতেই হবে। পেশার সম্মান টিকিয়ে রাখতে হলে নিজেকেই আগে সম্মান করতে হবে।”
আবু সাউদ মাসুদ বলেন, “সকালে ঘুম থেকে উঠে আমরা অনেকেই খবর খুঁজি কার কী স্ক্যান্ডাল হলো, কে কোথায় ধরা পড়লো, কে কার বিরুদ্ধে বললো। এসবের পেছনে ছোটার আগে আমরা যদি একবার আল্লাহর নাম নেই, নিজের বিবেককে প্রশ্ন করি-তাহলে হয়তো লিখনিতে ভারসাম্য আসবে, পজিটিভিটিও আসবে।”তার বক্তব্যে উঠে আসে সাংবাদিকদের নৈতিক দায়বদ্ধতার প্রশ্নও। তিনি বলেন, “আজকাল পত্রিকা মানেই যেন নেতিবাচক খবরে ভরা। আমরা কি ইতিবাচক বিষয়গুলো তুলে ধরতে পারি না?
তিনি আরও বলেন, “আমরা দাবি করি-আমরা সমাজের দর্পণ। কিন্তু সেই দর্পণের গায়ে যদি ধুলো জমে থাকে, তাহলে প্রতিবিম্ব তো বিকৃত হবেই। নিজেদের ভাবমূর্তি রক্ষায় আমাদের নিজেদের মধ্যেই শুদ্ধি আনতে হবে।”এ সময় উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মীরা তাঁর বক্তব্যে সম্মতি জানান এবং পরস্পরের মধ্যে পেশাদারিত্ব বজায় রাখার বিষয়ে একমত পোষণ করেন।
নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাব সভাপতি আবু সাউদ মাসুদের বক্তব্যের পরে জেলা প্রশাসক বলেন, “আমি প্রেসক্লাব সভাপতির কথার সঙ্গে একমত। একজন সাংবাদিক কেবল প্রশ্ন তুলবে না, সমাজের চোখে চোখ রেখে দায়িত্বও পালন করবে। আমি চাই, জেলা প্রশাসন ও মিডিয়া একসঙ্গে কাজ করুক, যাতে সত্যিকারের জনগণের সেবা নিশ্চিত হয়।” মিট দ্যা প্রেস অনুষ্ঠানটি শুধু সরকারি কর্মকর্তার পক্ষ থেকে পরিকল্পনা ঘোষণার জায়গা ছিল না, বরং সেটি রূপ নিয়েছিল পারস্পরিক আত্মসমালোচনার একটি দায়িত্বশীল সভায়। প্রেসক্লাব সভাপতির অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য যেন এদিনের সভায় আত্মশুদ্ধির ঘণ্টা বাজিয়ে গেল।
সভার শেষের দিকে নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আফজাল হোসেন পন্টি বলেন, ৬ মাসের কর্মজীবনে মিট দ্যা প্রেস অনুষ্ঠান করা সাহসীকতার ব্যাপার। বিষয়টা ফাইন। আপনাকে ধন্যবাদ। আপনি জবাবদিহিতার মধ্যে আসতে চাচ্ছেন। আমাদের নারায়ণগঞ্জে প্রধান সমস্যা ‘যানজট’। এটা নারায়ণগঞ্জের ক্যান্সার। এই ক্যান্সার সারিয়ে চাষাড়া চত্বরটাকে ফ্রি রাখতে হবে।
সিনিয়র ফটোসাংবাদিক হাবিবুর রহমান শ্যামল বলেন, ‘জেলা শহরে যানজট এমন পর্যায়ে গেছে যে রিকশা এখন রাস্তা নয়, ফুটপাত দিয়ে চলে।’জবাবে ডিসি মিঞা জানান, ‘আমি ইতোমধ্যে সড়ক ও জনপথ বিভাগ, পৌরসভা ও ট্রাফিক বিভাগকে নিয়ে যৌথভাবে সমন্বিত পরিকল্পনা করেছি। শহরে নির্ধারিত স্থানে পার্কিং ও রিকশার চলাচলের নতুন নীতিমালা প্রস্তুত হচ্ছে। খুব শিগগির পরীক্ষামূলকভাবে বাস্তবায়ন শুরু করব।’
একজন সিনিয়র ফটোসাংবাদিক জানতে চান, ‘ভূমি অফিসে এখনো দালালদের দাপট চলছে, আপনি কি এতে হস্তক্ষেপ করবেন?’ জবাবে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘আমি আপনাদের সবার সহায়তা চাই। কেউ যেন ভূমি অফিসে গিয়ে হয়রানির শিকার না হয়, এটা নিশ্চিত করতে চাই। আমি ইতিমধ্যে একাধিক সারপ্রাইজ পরিদর্শন করেছি এবং দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি।’
জেলা প্রশাসক অনুষ্ঠানে নারায়ণগঞ্জের জন্য আগামী এক বছরের মধ্যে বাস্তবায়নযোগ্য কয়েকটি পরিকল্পনার কথা জানান-নারায়ণগঞ্জের ইতিহাস ও নদীমাতৃক সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে শীতলক্ষ্যা নদীঘেঁষা ঐতিহাসিক স্থানগুলো নিয়ে ভ্রমণ প্যাকেজ চালু করা হবে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে এটি পরিচালিত হবে। সাধারণ নাগরিক যাতে ঘরে বসে অনলাইনে জেলা প্রশাসকের অফিসে আবেদন ও অভিযোগ করতে পারে, সেই ব্যবস্থা চালু করা হবে। আগামী মাস থেকেই পরীক্ষামূলকভাবে এটি চালু হবে।জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সরাসরি অভিযোগ জানাতে নারীদের জন্য পৃথক সেল খোলা হবে। নির্যাতন বা হয়রানির ঘটনায় দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করা হবে। শহরের ধ্বংসপ্রায় লাইব্রেরি ও নাট্যশালাগুলোকে আধুনিক করে নতুন প্রজন্মের জন্য ব্যবহার উপযোগী করা হবে। ডিসি মিঞা বলেন, ‘শুধু উন্নয়ন নয়, সংস্কৃতি বাঁচলে শহর বাঁচে।’
অনুষ্ঠানে কয়েকজন তরুণ সাংবাদিক বলেন, ‘এতদিনে একজন জেলা প্রশাসককে আমরা পেয়েছি যিনি মানুষের কথা শোনেন। তবে ভালো উদ্যোগগুলোর যেন ধারাবাহিকতা থাকে, সেটাই আমাদের চাওয়া।’
অনলাইন নিউজপোর্টাল এর একজন সাংবাদিক বলেন, ‘জেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইটে নিয়মিত আপডেট নেই, নাগরিকদের অংশগ্রহণে ওপেন ডেটা চালু হলে ভালো হবে।’প্রতিক্রিয়ায় জেলা প্রশাসক জানান, ‘আমার কার্যালয়ের প্রত্যেকটি বিভাগে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হচ্ছে। ওয়েবসাইট সংস্কারের কাজ চলমান।’
প্রেস ব্রিফিংয়ের শেষভাগে জেলা প্রশাসক বলেন, *‘আমি একজন সাধারণ মানুষ। আমার দরজা সবার জন্য খোলা। আপনাদের কেউ যেন মনে না করেন, প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করা কঠিন। আমি চাই, আমরা একসঙ্গে নারায়ণগঞ্জকে গড়ি-এই শহর হবে সবার।’
অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে জেলা প্রশাসক চা ও নাস্তার সময় দীর্ঘসময় কথা বলেন। কেউ তার ডেস্কে সরাসরি ঢুকতে পারার অভিজ্ঞতা, কেউবা মোবাইলে রাত দশটায় পাওয়া ফোনের উত্তরের কথা উল্লেখ করেন।
নারায়ণগঞ্জে প্রশাসনের দায়িত্ব নিয়ে মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা নতুন মাত্রা এনেছেন-পরিবেশবান্ধবতা, নাগরিক অংশগ্রহণ এবং গণমাধ্যমের সঙ্গে সহমর্মিতার সেতুবন্ধনে। ‘মিট দ্য প্রেস’ শুধু একটি আনুষ্ঠানিকতা ছিল না, বরং হয়ে উঠেছিল নাগরিক প্রশাসনের এক প্রাণবন্ত দৃষ্টান্ত।