ঢাকা ০৯:১০ অপরাহ্ন, রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫, ২২ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
এক রিকশাচালকের আত্মদানের গল্প

বাঁচলে গাজী, মরলে শহীদ

আল আমীন মাহমুদ অর্ণব
  • আপডেট সময় : ০২:১২:১৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ৬ জুলাই ২০২৫
  • / ১৫ জন পড়েছেন

“দেশের এই অবস্থায় আমি কেমনে ঘরে বসে থাকতে পারি? চিন্তা কইরো না। বেঁচে থাকলে গাজী, মরে গেলে শহীদ হব।” — এই কথাগুলো বলে ২০২৪ সালের ২০ জুলাই সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন মোহাম্মদ তুহিন হোসেন। ওই দিনের বিকেলে নারায়ণগঞ্জের চিটাগাং রোড এলাকায় পুলিশের গুলিতে কপালে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন তিনি।
২০ জুলাই তৃতীয় দিনের মতো সারা বাংলাদেশ ইন্টারনেটবিহীন ছিল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের ডাকা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ (সর্বাত্মক অবরোধ)ও চলছিল তৃতীয় দিনের মতো। কর্মসূচিতে সারাদেশে আন্দোলনরত লাখো ছাত্র-জনতার একজন হয়ে পথে নেমেছিলেন তুহিন। তিনিও হয়তো জানতেন, ফিরবেন না। কিন্তু অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর দায় থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারেননি।
শহীদ মোঃ তুহিন হোসেন। জন্ম ২৯ ডিসেম্বর ১৯৮৮। এক ভাই আর এক বোনের মধ্যে তুহিন বড়। পেশায় ছিলেন একজন অটোরিকশা চালক। জীবিকার প্রয়োজনে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঢাকার ১৬৪/এ খিলগাঁও থেকে নারায়ণগঞ্জ চলে আসেন। সিদ্ধিরগঞ্জের পাইনাদির উত্তর রসূলবাগ এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন স্ত্রী আলেয়া আক্তার ও ১০ বছর বয়সী একমাত্র কন্যাসন্তান নুসরাত ফাতেমাকে নিয়ে।
মাঝারি উচ্চতার, গা শালীন, শান্ত স্বভাবের এই মানুষটি ছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ও অত্যন্ত মানবিক মনের অধিকারী। জীবনের অনেক ধাক্কা খেয়ে হলেও সম্মানের রুটিতে সন্তুষ্ট ছিলেন। একমাত্র সন্তানকে ঘিরে ছিল তার সব স্বপ্ন।
আলেয়া জানান, “করোনার সময় শ্বশুর মারা গেলে সব এলোমেলো হয়ে যায়। বাড়িঘর হারিয়ে ঢাকার জীবন ছেড়ে নারায়ণগঞ্জ চলে আসি। অনেক কষ্টে শুরু করি নতুন করে। তুহিন অটোরিকশা চালাত। ভালোই চলছিল, কিন্তু সব ভেঙে গেল সেদিন বিকেলে…”
২০ জুলাই শনিবার, সকালে আলেয়া তাকে বারবার অনুরোধ করেছিলেন, যেন আন্দোলনে না যায়। বলেছিলেন, “দেখ, সব জায়গায় ঝামেলা হচ্ছে। মানুষ মাইরা ফেলতাছে, তুমি যাইও না। আমাদের একটা ছোট মাইয়া আছে।”
কিন্তু তুহিনের জবাব ছিল বুক কাঁপানো: “আল্লাহ যার মরণ যেমনে লিখছে ওইভাবেই হইব। মাইয়ারে আল্লাহ দেখব। আর আজকে ছাত্র ভাইগো সাথে না দাড়াইলে, সারাজীবন আফসোস করব। যদি গুলিতে আহত কাউরে বাঁচাইতে পারি, বাঁচাব।” এই কথাই ছিল তার শেষ কথা।
বিকাল ৩টা, শহীদ তুহিন যাত্রী নিয়ে চিটাগাং রোডে যান। কারফিউ চলছিলো তৃতীয় দিনের মতো। ছাত্র-জনতার উপর পুলিশ ও বিজিবি এলোপাথাড়ি গুলি করতে থাকে। পুলিশ টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে চলতে থাকে পুলিশ-বিজিবির মুহুর্মুহু গুলি। হঠাৎ একটা গুলি এসে আঘাত করে তুহিনে কপালে। সাথে সাথে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সাথে থাকা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা তুহিনিকে হাসপাতাল নেয়ার চেষ্টা করে কিন্তু হাসপাতাল পৌঁছানোর আগেই শহীদের সারিতে নাম লেখান তুহিন। এক গরিব অটোরিকশা চালক রাষ্ট্রের গোলাবর্ষণে শহীদ হয়ে যান, রেখে যান স্বপ্নভঙ্গের ধ্বংসস্তূপ।
তুহিনের কন্যা নুসরাত ফাতেমা তখন ৮ বছরের শিশু। এখন সে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। বাবার মৃত্যু যেন তার শৈশবটাই কেড়ে নিয়েছে। মায়ের কোলে বসে ফাতেমা বলে, “আব্বু যাওয়ার সময় বলছিল, চিপস আনব। কিন্তু বাবা যখন আসছে, তখন আমার সঙ্গে আর কোনো কথাই বলে নাই।”
তার মা বলেন, “মাইয়াটা এখনও বাবার কথা ভুলে থাকতে পারে না। স্বপ্নে দেখে ঘুম থেকে উঠে কাঁদে। বাবার কবরস্থানে গেলে বলে, ‘আব্বু, আমার মজা লাগবে না, তুমি আসো’।”
মেয়েকে কোলে নিয়ে আলেয়া বলেন, “ও বাঁইচা থাকতে আমায় চাকরি করতে দেয় নাই। বলত, ‘তুমি ঘরে থাকো, আমি খাটব।’ এখন তার মেয়ের মুখ চেয়ে গার্মেন্টসে চাকরি করতে হচ্ছে। মাসে ৯ হাজার টাকা পাই। ওভারটাইম করলে কিছু বাড়ে। ওই দিয়াই চলতাছি কোনোভাবে।”
তুহিনের মা ময়না বেগম একসময় জীবিকার তাগিদে মালয়েশিয়া গিয়েছিলেন। বলেন, “ঘরে টাকা-পয়সার অভাব আছিল। তাই কাজ করতে বিদেশে গেছি। মহিলা মানুষ তো, তেমন আয় নাই। ছেলেরে টাকা পাঠাইতে পারতাম না।”
তুহিনের মৃত্যুর খবর শুনে দেশে ফিরে আসেন। কিন্তু কোনো শেষ কথা বলা হয়নি। তিনি বলেন, “কারফিউয়ের কারণে ইন্টারনেট বন্ধ আছিল। শেষবার ছেলেরে ফোন দিবার চেষ্টা করছিলাম শত শত বার। ভাবছিলাম হয়তো এবার ঢুকবে, কিন্তু হইল না।”
ময়না বলেন, “আমার ছেলে যখন অটোরিকশা চালাতে চাইছিল, আমি বলছিলাম, তোর বংশে কেউ রিকশা চালায় নাই। কিন্তু সে বলছিল, কাজে লজ্জা নাই। আমি তো চুরি করতাছি না।”
তার গলার স্বর থেমে যায় কান্নায়। বলেন, “মানুষের জীবন বাঁচাইতে গিয়া আমার তুহিন মারা গেছে। সে আমার গর্ব, আমার অহংকার। এখন সেই ছেলেই নাই — টাকা দিয়া কি করব?”
তুহিনের মৃত্যুর পর থেকেই পরিবারটি ধীরে ধীরে আর্থিক সংকটে পড়ে। জীবিকার একমাত্র ভরসা ছিলেন তিনি। এখন স্ত্রী আলেয়ার সীমিত বেতনের চাকরি, বৃদ্ধা মা, আর ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।
সরকার থেকে এককালীন সহায়তা দেওয়া হলেও, দীর্ঘমেয়াদি সহায়তা বা পুনর্বাসনের কোনো কার্যকর ব্যবস্থা হয়নি। এক শহীদের পরিবারের জন্য এটা কি যথেষ্ট?
সরকার ওই দিন থেকে সারাদেশে কারফিউ জারি করে। মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবুও ঘরে বসে থাকতে পারেননি অনেকেই। কারণ তারা জানতেন— নেতার জন্য নয়, এই আন্দোলন তাদেরই বাঁচার আন্দোলন।
আলেয়া বলেন, “আমরা চাই না রাষ্ট্র আমাদের দয়ার ভিখারি ভাবুক। ওর (তুহিন) জন্য আমরা গর্ব করি। কিন্তু রাষ্ট্র যদি দায়িত্ব না নেয়, তাহলে শহীদরা শুধু নামের শহীদ হয়ে থাকবে।”
মোহাম্মদ তুহিন হোসেন একজন নাম না জানা সাধারণ মানুষ ছিলেন, যার জীবন সংগ্রামে ভরা ছিল। কিন্তু যেদিন তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন, সেদিনই তিনি অসাধারণ হয়ে গেলেন।
২০২৪ সালের আন্দোলনের সময় সরকার দেশজুড়ে কারফিউ জারি করে। তখন হাজারো তুহিন ঘর ছেড়ে পথে নেমেছিল। কেউ শহীদ হয়েছে, কেউ পঙ্গু, কেউ গুম। কিন্তু এই শহীদ পরিবারগুলো আজও কাঁদে একটিই প্রশ্নে — “এই দেশের জন্য এত ত্যাগ, তবুও কেন আজ আমরা এত অসহায়?”
এই প্রতিবেদন কোনো অভিযোগ নয়— একটি দেশের শহীদকে, তার স্ত্রী ও সন্তানের কাছে আমরা কীভাবে ঋণী, সেই কথার স্মরণ।

ট্যাগ :

সংবাদটি সোস্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন

এক রিকশাচালকের আত্মদানের গল্প

বাঁচলে গাজী, মরলে শহীদ

আপডেট সময় : ০২:১২:১৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ৬ জুলাই ২০২৫

“দেশের এই অবস্থায় আমি কেমনে ঘরে বসে থাকতে পারি? চিন্তা কইরো না। বেঁচে থাকলে গাজী, মরে গেলে শহীদ হব।” — এই কথাগুলো বলে ২০২৪ সালের ২০ জুলাই সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন মোহাম্মদ তুহিন হোসেন। ওই দিনের বিকেলে নারায়ণগঞ্জের চিটাগাং রোড এলাকায় পুলিশের গুলিতে কপালে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন তিনি।
২০ জুলাই তৃতীয় দিনের মতো সারা বাংলাদেশ ইন্টারনেটবিহীন ছিল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের ডাকা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ (সর্বাত্মক অবরোধ)ও চলছিল তৃতীয় দিনের মতো। কর্মসূচিতে সারাদেশে আন্দোলনরত লাখো ছাত্র-জনতার একজন হয়ে পথে নেমেছিলেন তুহিন। তিনিও হয়তো জানতেন, ফিরবেন না। কিন্তু অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর দায় থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারেননি।
শহীদ মোঃ তুহিন হোসেন। জন্ম ২৯ ডিসেম্বর ১৯৮৮। এক ভাই আর এক বোনের মধ্যে তুহিন বড়। পেশায় ছিলেন একজন অটোরিকশা চালক। জীবিকার প্রয়োজনে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঢাকার ১৬৪/এ খিলগাঁও থেকে নারায়ণগঞ্জ চলে আসেন। সিদ্ধিরগঞ্জের পাইনাদির উত্তর রসূলবাগ এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন স্ত্রী আলেয়া আক্তার ও ১০ বছর বয়সী একমাত্র কন্যাসন্তান নুসরাত ফাতেমাকে নিয়ে।
মাঝারি উচ্চতার, গা শালীন, শান্ত স্বভাবের এই মানুষটি ছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ও অত্যন্ত মানবিক মনের অধিকারী। জীবনের অনেক ধাক্কা খেয়ে হলেও সম্মানের রুটিতে সন্তুষ্ট ছিলেন। একমাত্র সন্তানকে ঘিরে ছিল তার সব স্বপ্ন।
আলেয়া জানান, “করোনার সময় শ্বশুর মারা গেলে সব এলোমেলো হয়ে যায়। বাড়িঘর হারিয়ে ঢাকার জীবন ছেড়ে নারায়ণগঞ্জ চলে আসি। অনেক কষ্টে শুরু করি নতুন করে। তুহিন অটোরিকশা চালাত। ভালোই চলছিল, কিন্তু সব ভেঙে গেল সেদিন বিকেলে…”
২০ জুলাই শনিবার, সকালে আলেয়া তাকে বারবার অনুরোধ করেছিলেন, যেন আন্দোলনে না যায়। বলেছিলেন, “দেখ, সব জায়গায় ঝামেলা হচ্ছে। মানুষ মাইরা ফেলতাছে, তুমি যাইও না। আমাদের একটা ছোট মাইয়া আছে।”
কিন্তু তুহিনের জবাব ছিল বুক কাঁপানো: “আল্লাহ যার মরণ যেমনে লিখছে ওইভাবেই হইব। মাইয়ারে আল্লাহ দেখব। আর আজকে ছাত্র ভাইগো সাথে না দাড়াইলে, সারাজীবন আফসোস করব। যদি গুলিতে আহত কাউরে বাঁচাইতে পারি, বাঁচাব।” এই কথাই ছিল তার শেষ কথা।
বিকাল ৩টা, শহীদ তুহিন যাত্রী নিয়ে চিটাগাং রোডে যান। কারফিউ চলছিলো তৃতীয় দিনের মতো। ছাত্র-জনতার উপর পুলিশ ও বিজিবি এলোপাথাড়ি গুলি করতে থাকে। পুলিশ টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে চলতে থাকে পুলিশ-বিজিবির মুহুর্মুহু গুলি। হঠাৎ একটা গুলি এসে আঘাত করে তুহিনে কপালে। সাথে সাথে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সাথে থাকা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা তুহিনিকে হাসপাতাল নেয়ার চেষ্টা করে কিন্তু হাসপাতাল পৌঁছানোর আগেই শহীদের সারিতে নাম লেখান তুহিন। এক গরিব অটোরিকশা চালক রাষ্ট্রের গোলাবর্ষণে শহীদ হয়ে যান, রেখে যান স্বপ্নভঙ্গের ধ্বংসস্তূপ।
তুহিনের কন্যা নুসরাত ফাতেমা তখন ৮ বছরের শিশু। এখন সে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। বাবার মৃত্যু যেন তার শৈশবটাই কেড়ে নিয়েছে। মায়ের কোলে বসে ফাতেমা বলে, “আব্বু যাওয়ার সময় বলছিল, চিপস আনব। কিন্তু বাবা যখন আসছে, তখন আমার সঙ্গে আর কোনো কথাই বলে নাই।”
তার মা বলেন, “মাইয়াটা এখনও বাবার কথা ভুলে থাকতে পারে না। স্বপ্নে দেখে ঘুম থেকে উঠে কাঁদে। বাবার কবরস্থানে গেলে বলে, ‘আব্বু, আমার মজা লাগবে না, তুমি আসো’।”
মেয়েকে কোলে নিয়ে আলেয়া বলেন, “ও বাঁইচা থাকতে আমায় চাকরি করতে দেয় নাই। বলত, ‘তুমি ঘরে থাকো, আমি খাটব।’ এখন তার মেয়ের মুখ চেয়ে গার্মেন্টসে চাকরি করতে হচ্ছে। মাসে ৯ হাজার টাকা পাই। ওভারটাইম করলে কিছু বাড়ে। ওই দিয়াই চলতাছি কোনোভাবে।”
তুহিনের মা ময়না বেগম একসময় জীবিকার তাগিদে মালয়েশিয়া গিয়েছিলেন। বলেন, “ঘরে টাকা-পয়সার অভাব আছিল। তাই কাজ করতে বিদেশে গেছি। মহিলা মানুষ তো, তেমন আয় নাই। ছেলেরে টাকা পাঠাইতে পারতাম না।”
তুহিনের মৃত্যুর খবর শুনে দেশে ফিরে আসেন। কিন্তু কোনো শেষ কথা বলা হয়নি। তিনি বলেন, “কারফিউয়ের কারণে ইন্টারনেট বন্ধ আছিল। শেষবার ছেলেরে ফোন দিবার চেষ্টা করছিলাম শত শত বার। ভাবছিলাম হয়তো এবার ঢুকবে, কিন্তু হইল না।”
ময়না বলেন, “আমার ছেলে যখন অটোরিকশা চালাতে চাইছিল, আমি বলছিলাম, তোর বংশে কেউ রিকশা চালায় নাই। কিন্তু সে বলছিল, কাজে লজ্জা নাই। আমি তো চুরি করতাছি না।”
তার গলার স্বর থেমে যায় কান্নায়। বলেন, “মানুষের জীবন বাঁচাইতে গিয়া আমার তুহিন মারা গেছে। সে আমার গর্ব, আমার অহংকার। এখন সেই ছেলেই নাই — টাকা দিয়া কি করব?”
তুহিনের মৃত্যুর পর থেকেই পরিবারটি ধীরে ধীরে আর্থিক সংকটে পড়ে। জীবিকার একমাত্র ভরসা ছিলেন তিনি। এখন স্ত্রী আলেয়ার সীমিত বেতনের চাকরি, বৃদ্ধা মা, আর ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।
সরকার থেকে এককালীন সহায়তা দেওয়া হলেও, দীর্ঘমেয়াদি সহায়তা বা পুনর্বাসনের কোনো কার্যকর ব্যবস্থা হয়নি। এক শহীদের পরিবারের জন্য এটা কি যথেষ্ট?
সরকার ওই দিন থেকে সারাদেশে কারফিউ জারি করে। মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবুও ঘরে বসে থাকতে পারেননি অনেকেই। কারণ তারা জানতেন— নেতার জন্য নয়, এই আন্দোলন তাদেরই বাঁচার আন্দোলন।
আলেয়া বলেন, “আমরা চাই না রাষ্ট্র আমাদের দয়ার ভিখারি ভাবুক। ওর (তুহিন) জন্য আমরা গর্ব করি। কিন্তু রাষ্ট্র যদি দায়িত্ব না নেয়, তাহলে শহীদরা শুধু নামের শহীদ হয়ে থাকবে।”
মোহাম্মদ তুহিন হোসেন একজন নাম না জানা সাধারণ মানুষ ছিলেন, যার জীবন সংগ্রামে ভরা ছিল। কিন্তু যেদিন তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন, সেদিনই তিনি অসাধারণ হয়ে গেলেন।
২০২৪ সালের আন্দোলনের সময় সরকার দেশজুড়ে কারফিউ জারি করে। তখন হাজারো তুহিন ঘর ছেড়ে পথে নেমেছিল। কেউ শহীদ হয়েছে, কেউ পঙ্গু, কেউ গুম। কিন্তু এই শহীদ পরিবারগুলো আজও কাঁদে একটিই প্রশ্নে — “এই দেশের জন্য এত ত্যাগ, তবুও কেন আজ আমরা এত অসহায়?”
এই প্রতিবেদন কোনো অভিযোগ নয়— একটি দেশের শহীদকে, তার স্ত্রী ও সন্তানের কাছে আমরা কীভাবে ঋণী, সেই কথার স্মরণ।