ঢাকা ০৪:১৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ০১ জুলাই ২০২৫, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :

আড়াইহাজার দুই মাসে অর্ধশতাধিক কিশোরী উধাও

সোজাসাপটা রিপোর্ট
  • আপডেট সময় : ১২:২৭:১৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫
  • / ২০ জন পড়েছেন

নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলায় কিশোরীদের ঘরছাড়া হওয়ার প্রবণতা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। প্রেমের ফাঁদে এসব কিশোরী ঘর ছাড়ছেন বলে জানিয়েছেন পরিবার ও সংশ্লিষ্টরা। যাদের অনেকের বয়স মাত্র ১২ থেকে থেকে ১৬ বছর।
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানিয়েছে, গত দুই মাসে উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে অন্তত ৫০ জনেরও অধিক কিশোরী নিখোঁজ হয়েছে। যাদের অনেকের বয়স ১২ থেকে ১৬ বছর। নিখোঁজের পর এদের কেউ কেউ পুলিশের সহায়তায় উদ্ধার হলেও অনেকেই এখনো নিখোঁজ। গড়ে প্রতিদিন একজন করে প্রেমের ফাঁদে পড়ে নিখোজের খবর মিলছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
পরিবার ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশিরভাগ কিশোরী ফেসবুক বা মেসেঞ্জার ভিত্তিক প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে। আবার কিছু কিশোরী স্থানীয়ভাবে প্রেমের ফাঁদে পা দিচ্ছেন। এক পর্যায়ে তারা পরিবারের অজান্তে নিরুদ্দেশ হচ্ছে। উদ্দেশ্য প্রেমিকের সঙ্গে থাকা বা পালিয়ে যাওয়া। ভয়ংকর ব্যাপার হলো, যাদের সঙ্গে পালিয়ে যাচ্ছে তারা প্রায় সবাই বিবাহিত কিংবা বয়সে অনেক বড়। এদের কেউ কেউ মিথ্যা পরিচয় দেয়, কেউ প্রলোভন দেখায়, আবার কেউ ভিডিও কলের মাধ্যমে কিশোরীদের মানসিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ভুক্তভোগী অভিভাবক বলেন, আমার মেয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ে। সে স্কুলে যাওয়ার কথা বলে আর ফিরে আসেনি। পরে খোঁজ নিয়ে দেখি সে এক ৩৫ বছরের লোকের সঙ্গে পালিয়েছে। সেই লোক বিবাহিত এবং নিজের পরিচয় গোপন করেছিল।
পুলিশ বলছে, পরিবার থেকে লিখিত অভিযোগ এলে তদন্ত করে কয়েকজন কিশোরীকে উদ্ধার করা হয়েছে। কিন্তু অনেকে সামাজিক লোকলজ্জার কারণে থানায়ই আসেন না। আবার অনেকে মামলা না করে মেয়েকে চুপচাপ খুঁজতে থাকেন। এতে সময় নষ্ট হয়, অপরাধীরা আরও শক্ত অবস্থানে চলে যায়।
আড়াইহাজার থানার ওসি (তদন্ত) সাইফ উদ্দিন জানান, এই ধরণের ঘটনার পেছনে মূলত মোবাইল আসক্তি, ফেসবুকের অপব্যবহার এবং পরিবারে নজরদারির অভাব কাজ করছে। বেশ কিছু ঘটনায় দেখা গেছে, মেয়েরা না বুঝেই প্রতারিত হয়ে ঘর ছেড়েছে। পরে অনেকেই বুঝতে পেরে কান্নাকাটি করছে, কিন্তু তখন ক্ষতি হয়ে গেছে। প্রতিদিন গড়ে ১জন করে নিখোঁজের খবর মিলছে। গত দুই মাসে অন্তত ৫০টি এমন ঘটনা ঘটে।
সদাসদী বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা নারগিস আক্তার বলছেন, শিক্ষার্থীদের মধ্যে মোবাইল ফোনের ব্যবহার অভিভাবকদের নিয়ন্ত্রণে নেই। অনেক অভিভাবক নিজের অজান্তেই স্মার্টফোন কিনে দিচ্ছেন। মেয়েরা নিজের কক্ষেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটায়, কেউ জানে না কী করছে, কার সঙ্গে কথা বলছে। এ সুযোগেই অপরিচিত পুরুষেরা ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে গল্প শুরু করে, পরে প্রেমে রূপ নেয়।
রোকন উদ্দিন মোল্লা গার্লস ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হক বলেন, আমরা প্রতিদিন ক্লাসে দেখি কিছু মেয়ের আচরণ বদলে যাচ্ছে। মনোযোগ নেই, চট করে কান্না পায়, কারও সঙ্গে কথা বলে না। পরে শুনি, সে প্রেমে পড়েছে। কেউ কেউ আবার পালিয়ে গেছে। এসব ঘটনা এখন নিয়মিত।
উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা নাজমা আক্তার বলেন, মেয়েদের চোখে এখন প্রেমের নামে একটা ফাঁদ ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যারা দিচ্ছে, তারা অনেকটা পেশাদার প্রতারকের মতো কাজ করছে। তারা জানে কীভাবে মন জয় করতে হয়। ভয়াবহ বিষয় হলো, এসব সম্পর্কের পরিণতি প্রায় সবসময়ই দুঃখজনক।
আড়াইহাজার উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. সাজ্জাত হোসেন বলেন, এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে প্রয়োজন পারিবারিক সচেতনতা, স্কুলে কিশোর-কিশোরীদের মানসিক কাউন্সেলিং, অনলাইন নিরাপত্তা শিক্ষার ব্যবস্থা এবং পুলিশের সক্রিয় নজরদারি। অনেকে বলছেন, এখনই প্রতিরোধ না করা গেলে আগামী দিনগুলোতে এই সংকট আরও জটিল আকার ধারন করবে।
আড়াইহাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খন্দকার নাসির উদ্দিন বলেন, শুধু পুলিশি অভিযান বা উদ্ধারে দায়িত্ব শেষ নয়। প্রতিটি পরিবারেরই প্রয়োজন নিজ সন্তানদের দিকে নতুন করে মনোযোগ দেওয়া, মোবাইল ব্যবহারে সীমা টানা, খোলামেলা যোগাযোগ স্থাপন এবং অনলাইনে কী করছে তা জানা। কিশোরী নিখোঁজ সংক্রান্ত ঘটনায় দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

ট্যাগ :

সংবাদটি সোস্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন

আড়াইহাজার দুই মাসে অর্ধশতাধিক কিশোরী উধাও

আপডেট সময় : ১২:২৭:১৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫

নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলায় কিশোরীদের ঘরছাড়া হওয়ার প্রবণতা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। প্রেমের ফাঁদে এসব কিশোরী ঘর ছাড়ছেন বলে জানিয়েছেন পরিবার ও সংশ্লিষ্টরা। যাদের অনেকের বয়স মাত্র ১২ থেকে থেকে ১৬ বছর।
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানিয়েছে, গত দুই মাসে উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে অন্তত ৫০ জনেরও অধিক কিশোরী নিখোঁজ হয়েছে। যাদের অনেকের বয়স ১২ থেকে ১৬ বছর। নিখোঁজের পর এদের কেউ কেউ পুলিশের সহায়তায় উদ্ধার হলেও অনেকেই এখনো নিখোঁজ। গড়ে প্রতিদিন একজন করে প্রেমের ফাঁদে পড়ে নিখোজের খবর মিলছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
পরিবার ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশিরভাগ কিশোরী ফেসবুক বা মেসেঞ্জার ভিত্তিক প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে। আবার কিছু কিশোরী স্থানীয়ভাবে প্রেমের ফাঁদে পা দিচ্ছেন। এক পর্যায়ে তারা পরিবারের অজান্তে নিরুদ্দেশ হচ্ছে। উদ্দেশ্য প্রেমিকের সঙ্গে থাকা বা পালিয়ে যাওয়া। ভয়ংকর ব্যাপার হলো, যাদের সঙ্গে পালিয়ে যাচ্ছে তারা প্রায় সবাই বিবাহিত কিংবা বয়সে অনেক বড়। এদের কেউ কেউ মিথ্যা পরিচয় দেয়, কেউ প্রলোভন দেখায়, আবার কেউ ভিডিও কলের মাধ্যমে কিশোরীদের মানসিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ভুক্তভোগী অভিভাবক বলেন, আমার মেয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ে। সে স্কুলে যাওয়ার কথা বলে আর ফিরে আসেনি। পরে খোঁজ নিয়ে দেখি সে এক ৩৫ বছরের লোকের সঙ্গে পালিয়েছে। সেই লোক বিবাহিত এবং নিজের পরিচয় গোপন করেছিল।
পুলিশ বলছে, পরিবার থেকে লিখিত অভিযোগ এলে তদন্ত করে কয়েকজন কিশোরীকে উদ্ধার করা হয়েছে। কিন্তু অনেকে সামাজিক লোকলজ্জার কারণে থানায়ই আসেন না। আবার অনেকে মামলা না করে মেয়েকে চুপচাপ খুঁজতে থাকেন। এতে সময় নষ্ট হয়, অপরাধীরা আরও শক্ত অবস্থানে চলে যায়।
আড়াইহাজার থানার ওসি (তদন্ত) সাইফ উদ্দিন জানান, এই ধরণের ঘটনার পেছনে মূলত মোবাইল আসক্তি, ফেসবুকের অপব্যবহার এবং পরিবারে নজরদারির অভাব কাজ করছে। বেশ কিছু ঘটনায় দেখা গেছে, মেয়েরা না বুঝেই প্রতারিত হয়ে ঘর ছেড়েছে। পরে অনেকেই বুঝতে পেরে কান্নাকাটি করছে, কিন্তু তখন ক্ষতি হয়ে গেছে। প্রতিদিন গড়ে ১জন করে নিখোঁজের খবর মিলছে। গত দুই মাসে অন্তত ৫০টি এমন ঘটনা ঘটে।
সদাসদী বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা নারগিস আক্তার বলছেন, শিক্ষার্থীদের মধ্যে মোবাইল ফোনের ব্যবহার অভিভাবকদের নিয়ন্ত্রণে নেই। অনেক অভিভাবক নিজের অজান্তেই স্মার্টফোন কিনে দিচ্ছেন। মেয়েরা নিজের কক্ষেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটায়, কেউ জানে না কী করছে, কার সঙ্গে কথা বলছে। এ সুযোগেই অপরিচিত পুরুষেরা ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে গল্প শুরু করে, পরে প্রেমে রূপ নেয়।
রোকন উদ্দিন মোল্লা গার্লস ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হক বলেন, আমরা প্রতিদিন ক্লাসে দেখি কিছু মেয়ের আচরণ বদলে যাচ্ছে। মনোযোগ নেই, চট করে কান্না পায়, কারও সঙ্গে কথা বলে না। পরে শুনি, সে প্রেমে পড়েছে। কেউ কেউ আবার পালিয়ে গেছে। এসব ঘটনা এখন নিয়মিত।
উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা নাজমা আক্তার বলেন, মেয়েদের চোখে এখন প্রেমের নামে একটা ফাঁদ ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যারা দিচ্ছে, তারা অনেকটা পেশাদার প্রতারকের মতো কাজ করছে। তারা জানে কীভাবে মন জয় করতে হয়। ভয়াবহ বিষয় হলো, এসব সম্পর্কের পরিণতি প্রায় সবসময়ই দুঃখজনক।
আড়াইহাজার উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. সাজ্জাত হোসেন বলেন, এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে প্রয়োজন পারিবারিক সচেতনতা, স্কুলে কিশোর-কিশোরীদের মানসিক কাউন্সেলিং, অনলাইন নিরাপত্তা শিক্ষার ব্যবস্থা এবং পুলিশের সক্রিয় নজরদারি। অনেকে বলছেন, এখনই প্রতিরোধ না করা গেলে আগামী দিনগুলোতে এই সংকট আরও জটিল আকার ধারন করবে।
আড়াইহাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খন্দকার নাসির উদ্দিন বলেন, শুধু পুলিশি অভিযান বা উদ্ধারে দায়িত্ব শেষ নয়। প্রতিটি পরিবারেরই প্রয়োজন নিজ সন্তানদের দিকে নতুন করে মনোযোগ দেওয়া, মোবাইল ব্যবহারে সীমা টানা, খোলামেলা যোগাযোগ স্থাপন এবং অনলাইনে কী করছে তা জানা। কিশোরী নিখোঁজ সংক্রান্ত ঘটনায় দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।