ঢাকা ০২:৫৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৯ জুলাই ২০২৫, ৪ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার, চুপ প্রশাসন

ইজিবাইক চার্জিং গ্যারেজে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের

সোজাসাপটা রিপোর্ট
  • আপডেট সময় : ০৪:৩৭:৪০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ জুন ২০২৫
  • / ৪৫ জন পড়েছেন

নারায়ণগঞ্জ শহরের কাশিপুর, ফতুল্লা, লালপুর, শিবু মার্কেট, চাঁনমারি, খানপুর, মাসদাইর ও ইসদাইর এলাকায় গজিয়ে উঠেছে অসংখ্য ইজিবাইক চার্জিং গ্যারেজ। এসব গ্যারেজের বড় একটি অংশই দিনের পর দিন আবাসিক বিদ্যুৎ লাইনের মাধ্যমে অবৈধভাবে গাড়ি চার্জ করছে। বৈধ মিটার না থাকায় এবং বিদ্যুৎ বিভাগের নিরবতা ও যোগসাজশে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকার বিদ্যুৎ চুরি হচ্ছে—যার ফলে সরকার যেমন রাজস্ব হারাচ্ছে, তেমনি নাগরিকরাও পড়ছেন চরম দুর্ভোগে।
এলাকার প্রায় প্রতিটি গলিতে এখন ছোট ছোট গ্যারেজ। দিনের বেলায় দরজা বন্ধ, আর রাত নামলেই শুরু হয় চার্জিং কার্যক্রম। রাস্তার পাশে বা আবাসিক ভবনের নিচতলায় বানানো এসব গ্যারেজে দিনের পর দিন সরকারি অনুমোদন ছাড়া মিটারবিহীন বিদ্যুৎ লাইন টেনে চার্জ দেওয়া হচ্ছে শত শত ইজিবাইকে।
একাধিক গ্যারেজ ঘুরে দেখা গেছে, বাইরে থেকে সাধারণ ঘরের মতো হলেও ভিতরে লাইন টানা আছে ৮–১০টি চার্জিং পয়েন্টে। সরাসরি বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে তার এনে চালানো হচ্ছে চার্জিং বোর্ড। কোথাও আবার আবাসিক মিটার থেকে বাইপাস লাইন টেনে ব্যবহার করা হচ্ছে বিদ্যুৎ।
কাশিপুর, ফতুল্লা, লালপুর, শিবু মার্কেট, চাঁনমারি, খানপুর, মাসদাইর ও ইসদাইর মিলিয়ে কমপক্ষে ৫০০টি ছোট-বড় গ্যারেজ চালু রয়েছে। গড়ে প্রতিটি গ্যারেজে দিনে অন্তত ২০–৪০টি ইজিবাইক চার্জ হয়। প্রতিটি ব্যাটারি চার্জে ৮–১০ ইউনিট বিদ্যুৎ খরচ হয়। এ হিসাবে প্রতিদিন হাজার হাজার ইউনিট বিদ্যুৎ চুরি হচ্ছে শুধুমাত্র এই আটটি এলাকা থেকেই।
গড়ে প্রতিদিন ২০ হাজার ইউনিট বিদ্যুৎ চুরি হলে, প্রতি মাসে তা দাঁড়ায় ৬ লক্ষ ইউনিট। বিদ্যুতের বর্তমান খুচরা দাম অনুযায়ী এর বাজারমূল্য প্রায় ৫০–৬০ লাখ টাকা। অথচ এই অর্থের প্রায় পুরোটাই হারিয়ে যাচ্ছে অবৈধ ব্যবস্থার কারণে।
এই গ্যারেজগুলোতে প্রতিটি ইজিবাইক চার্জ দিতে ৮০–১২০ টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়। প্রতিদিন ৩০টি গাড়ি চার্জ করলে, একটি গ্যারেজের আয় দাঁড়ায় গড়ে ৩ হাজার টাকা। শুধু খানপুর ও ফতুল্লা এলাকার ১০০টি গ্যারেজে প্রতিদিন আয় হয় প্রায় ৩ লাখ টাকা, যা মাসে প্রায় ১ কোটি টাকা ছুঁয়ে যায়।
এই বিপুল অর্থের কোনো অংশই সরকার পাচ্ছে না—বরং বৈধ গ্রাহকদের চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিদ্যুৎ বিল, যা বিদ্যুৎ বিভাগের ভুতুড়ে বিল হিসেবেও পরিচিত।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বিদ্যুৎ বিভাগ, প্রশাসন ও রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় দীর্ঘদিন ধরেই চলছে এই অবৈধ সংযোগ। কেউ প্রতিবাদ করলেও কোনো লাভ হয় না।
খানপুর এলাকার বাসিন্দা আবুল হোসেন বলেন, “রাতভর চার্জিং চললেও বিদ্যুৎ অফিস কিছুই দেখে না। মাঝে মাঝে নাটক করে সংযোগ কাটে, তারপর আবার লাইন চলে আসে।”
ফতুল্লার বাসিন্দা শারমিন আক্তার বলেন, “আমরা তো সামান্য ফ্যান-লাইট চালাই। মাসে বিল আসে ৩ হাজার টাকা। অথচ পাশের গ্যারেজে ২০টা গাড়ি চার্জ হয়—তাদের বিল মাত্র ১৫০০ টাকা।”
একাধিক বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী অভিযোগ করেছেন, মিটার রিডারদের ‘ম্যানেজ’ করেই এই কাজ চলে। মাসে মাসে নির্দিষ্ট হারে টাকা দিয়ে দেওয়া হয়, বিনিময়ে তারা কিছুই দেখে না।
ডিপিডিসির নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমরা মাঝে মাঝে অভিযান চালাই। অনেক সময় সংযোগ কেটে দেই। তবে লোকবল ও প্রযুক্তির ঘাটতির কারণে প্রতিটি জায়গায় নজর রাখা সম্ভব হয় না।”
তিনি আরও বলেন, “অনেক গ্যারেজ আবাসিক ভবনের ভিতরে। বাইরে থেকে বোঝা যায় না। কিছু গ্যারেজ আবার বৈধ মিটার দেখিয়ে অবৈধ লাইন ব্যবহার করছে। বিষয়টি জটিল।”
বিদ্যুৎ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সমস্যা সমাধানে প্রয়োজন কঠোর নজরদারি ও নীতিমালাভিত্তিক চার্জিং সিস্টেম চালু করা। প্রতিটি চার্জিং গ্যারেজকে রেজিস্ট্রেশন ও লাইসেন্সের আওতায় আনতে হবে। আবাসিক মিটারে চার্জিং নিষিদ্ধ করতে হবে।
একইসঙ্গে দুর্নীতিতে জড়িত বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে এবং মিটার রিডিংয়ে স্বচ্ছতা আনতে হবে।
নারায়ণগঞ্জে ইজিবাইক চার্জিং গ্যারেজের আড়ালে বিদ্যুৎ চুরির যে চিত্র উঠে এসেছে, তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এই চক্রে প্রশাসনের নীরবতা, রাজনৈতিক প্রভাব এবং দুর্নীতি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবিলম্বে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে, একদিকে সরকার রাজস্ব হারাবে, অন্যদিকে বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় তৈরি হবে স্থায়ী সংকট।

ট্যাগ :

সংবাদটি সোস্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন

রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার, চুপ প্রশাসন

ইজিবাইক চার্জিং গ্যারেজে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের

আপডেট সময় : ০৪:৩৭:৪০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ জুন ২০২৫

নারায়ণগঞ্জ শহরের কাশিপুর, ফতুল্লা, লালপুর, শিবু মার্কেট, চাঁনমারি, খানপুর, মাসদাইর ও ইসদাইর এলাকায় গজিয়ে উঠেছে অসংখ্য ইজিবাইক চার্জিং গ্যারেজ। এসব গ্যারেজের বড় একটি অংশই দিনের পর দিন আবাসিক বিদ্যুৎ লাইনের মাধ্যমে অবৈধভাবে গাড়ি চার্জ করছে। বৈধ মিটার না থাকায় এবং বিদ্যুৎ বিভাগের নিরবতা ও যোগসাজশে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকার বিদ্যুৎ চুরি হচ্ছে—যার ফলে সরকার যেমন রাজস্ব হারাচ্ছে, তেমনি নাগরিকরাও পড়ছেন চরম দুর্ভোগে।
এলাকার প্রায় প্রতিটি গলিতে এখন ছোট ছোট গ্যারেজ। দিনের বেলায় দরজা বন্ধ, আর রাত নামলেই শুরু হয় চার্জিং কার্যক্রম। রাস্তার পাশে বা আবাসিক ভবনের নিচতলায় বানানো এসব গ্যারেজে দিনের পর দিন সরকারি অনুমোদন ছাড়া মিটারবিহীন বিদ্যুৎ লাইন টেনে চার্জ দেওয়া হচ্ছে শত শত ইজিবাইকে।
একাধিক গ্যারেজ ঘুরে দেখা গেছে, বাইরে থেকে সাধারণ ঘরের মতো হলেও ভিতরে লাইন টানা আছে ৮–১০টি চার্জিং পয়েন্টে। সরাসরি বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে তার এনে চালানো হচ্ছে চার্জিং বোর্ড। কোথাও আবার আবাসিক মিটার থেকে বাইপাস লাইন টেনে ব্যবহার করা হচ্ছে বিদ্যুৎ।
কাশিপুর, ফতুল্লা, লালপুর, শিবু মার্কেট, চাঁনমারি, খানপুর, মাসদাইর ও ইসদাইর মিলিয়ে কমপক্ষে ৫০০টি ছোট-বড় গ্যারেজ চালু রয়েছে। গড়ে প্রতিটি গ্যারেজে দিনে অন্তত ২০–৪০টি ইজিবাইক চার্জ হয়। প্রতিটি ব্যাটারি চার্জে ৮–১০ ইউনিট বিদ্যুৎ খরচ হয়। এ হিসাবে প্রতিদিন হাজার হাজার ইউনিট বিদ্যুৎ চুরি হচ্ছে শুধুমাত্র এই আটটি এলাকা থেকেই।
গড়ে প্রতিদিন ২০ হাজার ইউনিট বিদ্যুৎ চুরি হলে, প্রতি মাসে তা দাঁড়ায় ৬ লক্ষ ইউনিট। বিদ্যুতের বর্তমান খুচরা দাম অনুযায়ী এর বাজারমূল্য প্রায় ৫০–৬০ লাখ টাকা। অথচ এই অর্থের প্রায় পুরোটাই হারিয়ে যাচ্ছে অবৈধ ব্যবস্থার কারণে।
এই গ্যারেজগুলোতে প্রতিটি ইজিবাইক চার্জ দিতে ৮০–১২০ টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়। প্রতিদিন ৩০টি গাড়ি চার্জ করলে, একটি গ্যারেজের আয় দাঁড়ায় গড়ে ৩ হাজার টাকা। শুধু খানপুর ও ফতুল্লা এলাকার ১০০টি গ্যারেজে প্রতিদিন আয় হয় প্রায় ৩ লাখ টাকা, যা মাসে প্রায় ১ কোটি টাকা ছুঁয়ে যায়।
এই বিপুল অর্থের কোনো অংশই সরকার পাচ্ছে না—বরং বৈধ গ্রাহকদের চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিদ্যুৎ বিল, যা বিদ্যুৎ বিভাগের ভুতুড়ে বিল হিসেবেও পরিচিত।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বিদ্যুৎ বিভাগ, প্রশাসন ও রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় দীর্ঘদিন ধরেই চলছে এই অবৈধ সংযোগ। কেউ প্রতিবাদ করলেও কোনো লাভ হয় না।
খানপুর এলাকার বাসিন্দা আবুল হোসেন বলেন, “রাতভর চার্জিং চললেও বিদ্যুৎ অফিস কিছুই দেখে না। মাঝে মাঝে নাটক করে সংযোগ কাটে, তারপর আবার লাইন চলে আসে।”
ফতুল্লার বাসিন্দা শারমিন আক্তার বলেন, “আমরা তো সামান্য ফ্যান-লাইট চালাই। মাসে বিল আসে ৩ হাজার টাকা। অথচ পাশের গ্যারেজে ২০টা গাড়ি চার্জ হয়—তাদের বিল মাত্র ১৫০০ টাকা।”
একাধিক বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী অভিযোগ করেছেন, মিটার রিডারদের ‘ম্যানেজ’ করেই এই কাজ চলে। মাসে মাসে নির্দিষ্ট হারে টাকা দিয়ে দেওয়া হয়, বিনিময়ে তারা কিছুই দেখে না।
ডিপিডিসির নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমরা মাঝে মাঝে অভিযান চালাই। অনেক সময় সংযোগ কেটে দেই। তবে লোকবল ও প্রযুক্তির ঘাটতির কারণে প্রতিটি জায়গায় নজর রাখা সম্ভব হয় না।”
তিনি আরও বলেন, “অনেক গ্যারেজ আবাসিক ভবনের ভিতরে। বাইরে থেকে বোঝা যায় না। কিছু গ্যারেজ আবার বৈধ মিটার দেখিয়ে অবৈধ লাইন ব্যবহার করছে। বিষয়টি জটিল।”
বিদ্যুৎ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সমস্যা সমাধানে প্রয়োজন কঠোর নজরদারি ও নীতিমালাভিত্তিক চার্জিং সিস্টেম চালু করা। প্রতিটি চার্জিং গ্যারেজকে রেজিস্ট্রেশন ও লাইসেন্সের আওতায় আনতে হবে। আবাসিক মিটারে চার্জিং নিষিদ্ধ করতে হবে।
একইসঙ্গে দুর্নীতিতে জড়িত বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে এবং মিটার রিডিংয়ে স্বচ্ছতা আনতে হবে।
নারায়ণগঞ্জে ইজিবাইক চার্জিং গ্যারেজের আড়ালে বিদ্যুৎ চুরির যে চিত্র উঠে এসেছে, তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এই চক্রে প্রশাসনের নীরবতা, রাজনৈতিক প্রভাব এবং দুর্নীতি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবিলম্বে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে, একদিকে সরকার রাজস্ব হারাবে, অন্যদিকে বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় তৈরি হবে স্থায়ী সংকট।