ঢাকা ১২:৫৮ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫, ১৯ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

প্রকৌশলী হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হলোনা শহীদ ইমরানের

প্রতিবেদকের নাম :
  • আপডেট সময় : ১০:৪৫:৩৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩ জুলাই ২০২৫
  • / ২৪ জন পড়েছেন

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের এক রক্তাক্ত দিনে শহীদ হন নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের তরুণ ছাত্র ইমরান হাসান। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জগতে নিজেকে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতেন যিনি, আজ তিনি শুধুই ইতিহাসের এক বেদনার নাম। তিনি শুধু একজন ছাত্র ছিলেন না, ছিলেন একটি সম্ভাবনাময় জীবনের প্রতীক। আর তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যেন নিভে যায় একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের স্বপ্ন।
২০০৫ সালের ১৭ ডিসেম্বর সোনারগাঁয়ের চর রমজান সোনাউল্লাহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ইমরান হাসান। তাঁর পিতা মোঃ ছালে আহাম্মেদ একজন ক্ষুদ্র মুদি দোকানদার, বয়স ৫০ বছর। মা কোহিনুর আক্তার গৃহিণী। ছোট ভাই আবু সাইদ দশম শ্রেণির ছাত্র। পরিবারের মাসিক আয় মাত্র ১০ হাজার টাকা। তবে অর্থকষ্টের মাঝেও সন্তানদের শিক্ষা ও আদর্শিকভাবে গড়ে তুলতেই চেষ্টা করে গেছেন বাবা-মা। গজারিয়া ইনস্টিটিউট অব সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে অধ্যয়নরত ইমরান ছিলেন তাঁদের সেই স্বপ্নপূরণের আশা।
১৬ জুলাই আবু সাঈদ সহ ৬ জন নিহত হন স্বৈরাচার সরকার সমর্থিত গুন্ডাবাহিনী এবং পুলিশের গুলিতে। আন্দোলন ধাবিত হয় চরম পর্যায়ের দিকে। ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। দেশব্যাপী ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ এর ডাক দেন মুক্তিকামী ছাত্রনেতারা।
সেই প্রেক্ষিতেই ১৮ই জুলাই আন্দোলনকারীদের সাথে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে নেমে পড়েন ইমরান হাসান। সাহসের যোগানদাতা হয়ে বীরের মতো এগিয়ে থাকেন সম্মুখে। পুলিশের টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড, বুলেট কিছুই তাকে থামাতে পারেনি ইমরান হাসানকে। চালিয়ে গিয়েছেন আন্দোলন। ১৮ জুলাই থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত কমপ্লিট শাটডাউনের প্রতিটি সময় ছিলেন রাজপথে। ২১ জুলাই এর পর, শুরু হয় স্বৈরাচারী সরকারের পালিত বাহিনীর দ্বারা ধরপাকড় অভিযান। চলতে থাকে অনলাইনভিত্তিক নানা কার্যক্রম। যেখানে সরব ছিলেন ইমরান হাসান। অবশেষে ডাক আসে জনগণের কাঙ্খিত এক দফায় অর্থাৎ স্বৈরাচারী সরকার পতনের ডাক। ৩ আগস্ট শহীদ মিনার অভিমুখে মার্চ, ৪ আগস্ট অসহযোগ আন্দোলন এবং ৫ আগস্ট লং মার্চ টু গণভবন। ৫ আগষ্ট সকাল ১০ টায় শহীদ ইমরান হাসান অন্যান্য ছাত্র জনতার সাথে যাত্রাবাড়ী মোড়ে সমবেত হয়েছিলেন। সবার সাথে যোগ দেন লং মার্চে। উদ্দেশ্য গণভবন, বিপত্তি বাধে আন্দোলনের স্টালিনগ্রাদ খ্যাত যাত্রাবাড়িতে। মুখোমুখি অবস্থান নেয় পুলিশ ও লাখো জনতা। মুহুর্মুহু চলতে থাকে টিয়ারশেল এবং সাউন্ড গ্রেনেড। অনেকে ভয়ে পিছিয়ে যেতে থাকলেও একেবারে ফ্রন্টলাইনে অবস্থান নেয় দুঃসাহসী শহীদ ইমরান হাসান। যুক্তি একটাই, সবাই পিছিয়ে গেলে আন্দোলন সফল হবে কিভাবে?
সময় ১২ টা বেজে ২৫ মিনিট, কিছুক্ষনের বিরতির পর আবারো ফায়ার করে পুলিশবাহিনী। এবার টিয়ারশেল নয়, সাউন্ড গ্রেনেড নয়, ছুড়ে দেয় প্রাণঘাতী এলোপাথাড়ি গুলির মধ্যে ইমরান হাসান গুলিবিদ্ধ হন। ডান বুকে এবং তলপেটে লাগে দুটি গুলি। রক্তাক্ত অবস্থায় স্থানীয় লোকজন তাঁকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে।
ইমরান হাসানের মৃত্যুর পরে পুরো পরিবার ভেঙে পড়ে। বাবা-মা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ১ সেপ্টেম্বর শহীদের মা কোহিনুর আক্তার বাদী হয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ২৯৮ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সহায়তায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা নির্বিচারে গুলি চালায়, যার ফলে ইমরান নিহত হন।
একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, শুধু যাত্রাবাড়ী মোড়েই ওইদিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে প্রাণ হারায় অন্তত ৫০ জন। তাদেরই একজন ছিলেন ইমরান, যিনি মিছিলের সম্মুখভাগে থেকে নেতৃত্ব দিতে চেয়েছিলেন।
ইমরানের শেষ ঠিকানা এখন সোনারগাঁয়ের গঙ্গানগর গ্রামে। সেখানে গ্রামের মানুষের চোখে আজও অশ্রু, আর বাড়ির আঙিনায় নিস্তব্ধতা। যে ছেলেটি অল্পতেই খুশি থাকত, বাবা-মার কাছে কিছু না চেয়েও সব দিতে চাইত সে আজ নিথর, স্মৃতি হয়ে গেছে একটি গোটা পরিবারের।
শহীদ ইমরান হাসান কোনো রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না, ছিলেন না ক্ষমতাধর কারো আত্মীয়। তিনি ছিলেন একজন সাধারণ তরুণ, যিনি স্বপ্ন দেখতেন, সংগ্রাম করতেন, আর অন্যায়ের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিলেন। তাঁর রক্ত আমাদের মনে করিয়ে দেয়- স্বাধীন দেশে স্বপ্ন দেখতে গেলে গুলি খেতে হয়, প্রতিবাদ করতে গেলে শহীদ হতে হয়।
আমরা যেন ভুলে না যাই, ইতিহাস শুধু গৌরবের নয়, শোকেরও। শহীদ ইমরান হাসানের নাম থাকবে সেই ইতিহাসের পাতায়, যেখানে লেখা থাকবে তরুণদের রক্তের বিনিময়ে বদলে যাওয়া এক সময়ের কথা।

ট্যাগ :

সংবাদটি সোস্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন

প্রকৌশলী হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হলোনা শহীদ ইমরানের

আপডেট সময় : ১০:৪৫:৩৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩ জুলাই ২০২৫

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের এক রক্তাক্ত দিনে শহীদ হন নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের তরুণ ছাত্র ইমরান হাসান। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জগতে নিজেকে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতেন যিনি, আজ তিনি শুধুই ইতিহাসের এক বেদনার নাম। তিনি শুধু একজন ছাত্র ছিলেন না, ছিলেন একটি সম্ভাবনাময় জীবনের প্রতীক। আর তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যেন নিভে যায় একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের স্বপ্ন।
২০০৫ সালের ১৭ ডিসেম্বর সোনারগাঁয়ের চর রমজান সোনাউল্লাহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ইমরান হাসান। তাঁর পিতা মোঃ ছালে আহাম্মেদ একজন ক্ষুদ্র মুদি দোকানদার, বয়স ৫০ বছর। মা কোহিনুর আক্তার গৃহিণী। ছোট ভাই আবু সাইদ দশম শ্রেণির ছাত্র। পরিবারের মাসিক আয় মাত্র ১০ হাজার টাকা। তবে অর্থকষ্টের মাঝেও সন্তানদের শিক্ষা ও আদর্শিকভাবে গড়ে তুলতেই চেষ্টা করে গেছেন বাবা-মা। গজারিয়া ইনস্টিটিউট অব সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে অধ্যয়নরত ইমরান ছিলেন তাঁদের সেই স্বপ্নপূরণের আশা।
১৬ জুলাই আবু সাঈদ সহ ৬ জন নিহত হন স্বৈরাচার সরকার সমর্থিত গুন্ডাবাহিনী এবং পুলিশের গুলিতে। আন্দোলন ধাবিত হয় চরম পর্যায়ের দিকে। ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। দেশব্যাপী ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ এর ডাক দেন মুক্তিকামী ছাত্রনেতারা।
সেই প্রেক্ষিতেই ১৮ই জুলাই আন্দোলনকারীদের সাথে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে নেমে পড়েন ইমরান হাসান। সাহসের যোগানদাতা হয়ে বীরের মতো এগিয়ে থাকেন সম্মুখে। পুলিশের টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড, বুলেট কিছুই তাকে থামাতে পারেনি ইমরান হাসানকে। চালিয়ে গিয়েছেন আন্দোলন। ১৮ জুলাই থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত কমপ্লিট শাটডাউনের প্রতিটি সময় ছিলেন রাজপথে। ২১ জুলাই এর পর, শুরু হয় স্বৈরাচারী সরকারের পালিত বাহিনীর দ্বারা ধরপাকড় অভিযান। চলতে থাকে অনলাইনভিত্তিক নানা কার্যক্রম। যেখানে সরব ছিলেন ইমরান হাসান। অবশেষে ডাক আসে জনগণের কাঙ্খিত এক দফায় অর্থাৎ স্বৈরাচারী সরকার পতনের ডাক। ৩ আগস্ট শহীদ মিনার অভিমুখে মার্চ, ৪ আগস্ট অসহযোগ আন্দোলন এবং ৫ আগস্ট লং মার্চ টু গণভবন। ৫ আগষ্ট সকাল ১০ টায় শহীদ ইমরান হাসান অন্যান্য ছাত্র জনতার সাথে যাত্রাবাড়ী মোড়ে সমবেত হয়েছিলেন। সবার সাথে যোগ দেন লং মার্চে। উদ্দেশ্য গণভবন, বিপত্তি বাধে আন্দোলনের স্টালিনগ্রাদ খ্যাত যাত্রাবাড়িতে। মুখোমুখি অবস্থান নেয় পুলিশ ও লাখো জনতা। মুহুর্মুহু চলতে থাকে টিয়ারশেল এবং সাউন্ড গ্রেনেড। অনেকে ভয়ে পিছিয়ে যেতে থাকলেও একেবারে ফ্রন্টলাইনে অবস্থান নেয় দুঃসাহসী শহীদ ইমরান হাসান। যুক্তি একটাই, সবাই পিছিয়ে গেলে আন্দোলন সফল হবে কিভাবে?
সময় ১২ টা বেজে ২৫ মিনিট, কিছুক্ষনের বিরতির পর আবারো ফায়ার করে পুলিশবাহিনী। এবার টিয়ারশেল নয়, সাউন্ড গ্রেনেড নয়, ছুড়ে দেয় প্রাণঘাতী এলোপাথাড়ি গুলির মধ্যে ইমরান হাসান গুলিবিদ্ধ হন। ডান বুকে এবং তলপেটে লাগে দুটি গুলি। রক্তাক্ত অবস্থায় স্থানীয় লোকজন তাঁকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে।
ইমরান হাসানের মৃত্যুর পরে পুরো পরিবার ভেঙে পড়ে। বাবা-মা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ১ সেপ্টেম্বর শহীদের মা কোহিনুর আক্তার বাদী হয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ২৯৮ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সহায়তায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা নির্বিচারে গুলি চালায়, যার ফলে ইমরান নিহত হন।
একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, শুধু যাত্রাবাড়ী মোড়েই ওইদিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে প্রাণ হারায় অন্তত ৫০ জন। তাদেরই একজন ছিলেন ইমরান, যিনি মিছিলের সম্মুখভাগে থেকে নেতৃত্ব দিতে চেয়েছিলেন।
ইমরানের শেষ ঠিকানা এখন সোনারগাঁয়ের গঙ্গানগর গ্রামে। সেখানে গ্রামের মানুষের চোখে আজও অশ্রু, আর বাড়ির আঙিনায় নিস্তব্ধতা। যে ছেলেটি অল্পতেই খুশি থাকত, বাবা-মার কাছে কিছু না চেয়েও সব দিতে চাইত সে আজ নিথর, স্মৃতি হয়ে গেছে একটি গোটা পরিবারের।
শহীদ ইমরান হাসান কোনো রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না, ছিলেন না ক্ষমতাধর কারো আত্মীয়। তিনি ছিলেন একজন সাধারণ তরুণ, যিনি স্বপ্ন দেখতেন, সংগ্রাম করতেন, আর অন্যায়ের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিলেন। তাঁর রক্ত আমাদের মনে করিয়ে দেয়- স্বাধীন দেশে স্বপ্ন দেখতে গেলে গুলি খেতে হয়, প্রতিবাদ করতে গেলে শহীদ হতে হয়।
আমরা যেন ভুলে না যাই, ইতিহাস শুধু গৌরবের নয়, শোকেরও। শহীদ ইমরান হাসানের নাম থাকবে সেই ইতিহাসের পাতায়, যেখানে লেখা থাকবে তরুণদের রক্তের বিনিময়ে বদলে যাওয়া এক সময়ের কথা।