ফিলিস্তিন স্বাধীন রাষ্ট্র হলে এটি পরিচালনা করবে কে?

- আপডেট সময় : ০৪:১৭:৩৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫
- / ২৮ জন পড়েছেন
জাতিসংঘের বৈশ্বিক সম্মেলনে সম্প্রতি ফিলিস্তিনকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে বেশ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ। ফ্রান্স ও সৌদি আরবের আয়োজিত এ সম্মেলনে প্রথমে যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, পর্তুগাল, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, মাল্টা, আন্দোর্রা, মোনাকো। এর আগে চলতি বছরের ২০ মার্চ মেক্সিকো সরকার জানায়, তারা ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
এর মধ্যদিয়ে জাতিসংঘের ১৯৩ সদস্যের মধ্যে ১৫৬টি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিল। গাজায় ইসরাইলি
যুদ্ধ ও অধিকৃত পশ্চিম তীরে দখলদারির বিরুদ্ধে প্রতীকী প্রতিক্রিয়া হিসেবে পশ্চিমা দেশগুলো এ স্বীকৃতির দিয়েছে। এসব দেশের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠায় দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের দাবি আরও জোরালো হয়ে উঠল।
পশ্চিমা দেশগুলোর একের পর এক স্বীকৃতি এরইমধ্যে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে-কে এটি পরিচালনা করবে?
‘আমাদের একটি নতুন নেতৃত্বের প্রয়োজন’
ইসরাইল ও প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) এর মধ্যে ১৯৯৪ সালে হওয়া একটি চুক্তির ফলে প্যালেস্টাইন ন্যাশনাল অথরিটি (যা কেবল প্যালেস্টাইন অথরিটি বা পিএ নামে পরিচিত) তৈরি হয়, যেটি গাজা ও পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদের উপর আংশিক নিয়ন্ত্রণ রাখে।
কিন্তু ২০০৭ সালে হামাস ও পিএলওর প্রধান উপদল ফাতাহর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পর থেকে, গাজা ও পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিরা দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী সরকার দ্বারা শাসিত হচ্ছে: গাজায় হামাস এবং পশ্চিম তীরে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ, যার নেতৃত্বে আছেন মাহমুদ আব্বাস।
এটা ৭৭ বছরের ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা এবং ১৮ বছরের রাজনৈতিক বিভাজন: যা পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকা বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য দীর্ঘ সময়।
ইতিমধ্যেই ফিলিস্তিনি রাজনীতি অস্থির হয়ে উঠেছে, যার ফলে বেশিরভাগ ফিলিস্তিনি তাদের নেতৃত্বকে পছন্দ করে না এবং রাষ্ট্রের দিকে অগ্রগতি তো দূরের কথা, কোনও ধরনের অভ্যন্তরীণ পুনর্মিলনের সম্ভাবনা সম্পর্কেও হতাশ তারা।
সর্বশেষ রাষ্ট্রপতি এবং সংসদীয় নির্বাচন হয়েছিল ২০০৬ সালে, যার অর্থ ৩৬ বছরের কম বয়সি কোনও ফিলিস্তিনি কখনও পশ্চিম তীর বা গাজায় ভোট দেয়নি।
‘এই সময়কালে আমাদের নির্বাচন না হওয়াটা মনকে খুব বিচলিত করে তোলে’, বলেন ফিলিস্তিনি আইনজীবী ডায়ানা বাট্টু।
‘আমাদের নতুন নেতৃত্বের প্রয়োজন।’
গাজায় ২০২৩ সালের অক্টোবরে শুরু হওয়া যুদ্ধের পর, সমস্যাটি আরও তীব্র হয়ে উঠেছে।
লক্ষ লক্ষ নাগরিক মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ার পর, পশ্চিম তীরে অবস্থিত সদর দপ্তর থেকে আব্বাসের ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ মূলত অসহায় দর্শকের ভূমিকায় নেমে এসেছে।
বছরের পর বছর ধরে অভ্যন্তরীণ বিরোধ
নেতৃত্বের স্তরের মধ্যে বিরোধ, উত্তেজনা বহু বছর আগে থেকে।
বহু বছরের নির্বাসন থেকে পিএলও চেয়ারম্যান ইয়াসির আরাফাত যখন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নেতৃত্ব দিতে ফিরে আসেন, তখন স্থানীয় ফিলিস্তিনি রাজনীতিবিদরা অনেকেই সেই প্রক্রিয়ায় নিজেদের অবস্থান খুঁজে পাননি।
‘অভ্যন্তরীণরা’ আরাফাতের ‘বহিরাগতদের’ কর্তৃত্ববাদী স্টাইলের প্রতি বিরক্ত হয়ে ওঠে।
আরাফাতের বাহিনীর দুর্নীতির গুজব ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সুনাম বৃদ্ধিতে তেমন কোনও ভূমিকা পালন করেনি।
আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, নবগঠিত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ পশ্চিম তীরে ইসরাইল ধীরে ধীরে উপনিবেশ স্থাপন বন্ধ করতে বা ১৯৯৩ সালের সেপ্টেম্বরে হোয়াইট হাউসে প্রাক্তন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী ইজহাক রবিনের সাথে আরাফাতের ঐতিহাসিক করমর্দনের মাধ্যমে উত্থিত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে অক্ষম বলে মনে হয়েছিল।
পরবর্তী বছরগুলো মসৃণ রাজনৈতিক বিবর্তনের জন্য সহায়ক ছিল না, এর কারণ ব্যর্থ শান্তি উদ্যোগ, ইহুদি বসতির অব্যাহত সম্প্রসারণ, উভয় পক্ষের চরমপন্থীদের সহিংসতা, ইসরাইলের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং ২০০৭ সালে হামাস ও ফাতাহর মধ্যে সহিংসতার প্রভাব।
‘ঘটনার স্বাভাবিক ধারায় নতুন ব্যক্তিত্ব, নতুন প্রজন্মের আবির্ভাব হতো,’ ফিলিস্তিনি ইতিহাসবিদ ইয়েজিদ সায়িগ বলেন।
‘কিন্তু তা অসম্ভব ছিল… অধিকৃত অঞ্চলগুলিতে ফিলিস্তিনিরা বিভক্ত, এবং এর ফলে নতুন ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব এবং একত্রিত হওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। ‘
তবে একজন ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটেছিল: মারওয়ান বারঘৌতি।
পশ্চিম তীরে জন্মগ্রহণ করে সেখানেই বেড়ে ওঠা মারওয়ান বারঘৌতি ১৫ বছর বয়সে আরাফাতের নেতৃত্বাধীন পিএলও উপদল ফাতাহ-তে সক্রিয় হয়ে ওঠেন।
গ্রেফতার হওয়ার আগে এবং পাঁচজন ইসরাইলি নিহত হওয়ার মারাত্মক হামলার পরিকল্পনার অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার আগে দ্বিতীয় ফিলিস্তিনি বিদ্রোহের সময় বারঘৌতি একজন জনপ্রিয় নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন।
অবশ্য তিনি বরাবরই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন, ২০০২ সাল থেকে ইসরাইলি কারাগারে রয়েছেন বারঘৌতি।
তবুও যখন ফিলিস্তিনিরা সম্ভাব্য ভবিষ্যত নেতাদের নিয়ে কথা বলেন, তখন তারা এমন একজন ব্যক্তির কথাই বলেন, যিনি প্রায় এক-চতুর্থাংশ শতাব্দী ধরে বন্দী আছেন।
পশ্চিম তীর ভিত্তিক প্যালেস্টাইন সেন্টার ফর পলিসি অ্যান্ড সার্ভে রিসার্চের সাম্প্রতিক এক জনমত জরিপে দেখা গেছে যে ৫০ শতাংশ ফিলিস্তিনি বারঘৌতিকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে বেছে নেবেন, বারঘৌতি এক্ষেত্রে ২০০৫ সাল থেকে এই পদে থাকা আব্বাসের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছেন।
হামাসের সাথে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধপূর্ণ অবস্থানে থাকা ফাতাহ-র একজন সিনিয়র সদস্য হওয়া সত্ত্বেও, গাজায় বন্দী ইসরাইলি জিম্মিদের বিনিময়ে হামাস যেসব রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি চায়, তার তালিকায় বারঘৌতির নাম স্থান পাবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
কিন্তু ইসরাইল তাকে মুক্তি দেওয়ার কোনও ইঙ্গিত দেয়নি।
নেতানিয়াহু এবং ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র
গাজা যুদ্ধের আগেও, নেতানিয়াহুর ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের বিরোধিতা ছিল স্পষ্ট।
তিনি ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে বলেছিলেন, ‘সবাই জানে যে আমিই সেই ব্যক্তি যিনি কয়েক দশক ধরে এমন একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বাধা দিয়ে এসেছি যা আমাদের অস্তিত্বকে বিপন্ন করবে। ‘
গাজার উপর ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ পুনরায় প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তর্জাতিক আহ্বান সত্ত্বেও, নেতানিয়াহু জোর দিয়ে বলেন যে গাজার ভবিষ্যত শাসনে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কোনও ভূমিকা থাকবে না। তিনি যুক্তি দেন যে আব্বাস ৭ই অক্টোবর হামাসের হামলার নিন্দা করেননি।
আগস্টে, ইসরাইল একটি বসতি প্রকল্পের চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় যা পূর্ব জেরুজালেমকে পশ্চিম তীর থেকে কার্যকরভাবে বিচ্ছিন্ন করবে।
তিন হাজার চারশ’টি বাড়ির পরিকল্পনা অনুমোদিত হয়েছিল, ইসরাইলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ বলেছিলেন যে এই পরিকল্পনাটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের ধারণাকে সমাহিত করবে, ‘কারণ স্বীকৃতি দেওয়ার মতো কিছুই নেই এবং স্বীকৃতি দেওয়ার মতো কেউ নেই’।
সাইগের যুক্তি, এটি খুব একটা নতুন পরিস্থিতি নয়।
‘আপনি আর্কেঞ্জেল মাইকেলকে পৃথিবীতে নামিয়ে আনতে পারেন এবং তাকে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রধান করতে পারেন, কিন্তু এতে কোনও পার্থক্য হবে না। কারণ আপনাকে এমন পরিস্থিতিতে কাজ করতে হবে যেখানে কোনও ধরনের সাফল্য সম্পূর্ণরূপে অসম্ভব। ‘
‘এবং এটি দীর্ঘদিন ধরেই চলছে।’
একটি বিষয় নিশ্চিত: যদি একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটে, তাহলে হামাস তা পরিচালনা করবে না।
ফ্রান্স ও সৌদি আরবের আয়োজন অনুযায়ী জুলাই মাসে তিন দিনের সম্মেলনের শেষে এক ঘোষণাপত্রে ঘোষণা করা হয়েছিল, ‘হামাসকে গাজায় তাদের শাসনের অবসান ঘটাতে হবে এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের অস্ত্র হস্তান্তর করতে হবে। ‘
‘নিউইয়র্ক ঘোষণাপত্র’ সমস্ত আরব রাষ্ট্র দ্বারা অনুমোদিত হয়েছিল এবং পরবর্তীতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ১৪২ জন সদস্য এটি গ্রহণ করেছিলেন।
হামাস তাদের পক্ষ থেকে বলেছে যে তারা গাজার কর্তৃত্ব টেকনোক্র্যাটদের একটি স্বাধীন প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করতে প্রস্তুত।
স্বীকৃতির প্রতীকীকরণ কি যথেষ্ট?
বারঘৌতির কারাগারে থাকা, আব্বাসের বয়স ৯০ বছরের কাছাকাছি হওয়া, হামাস নিশ্চিহ্ন হতে চলা এবং পশ্চিম তীর টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া, এসবে এটা স্পষ্ট যে ফিলিস্তিনের নেতৃত্ব এবং সংহতির অভাব রয়েছে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্থহীন।
‘এটি আসলে খুবই মূল্যবান হতে পারে,’ বলেন ডায়ানা বাট্টু, যদিও তিনি সতর্ক করে বলেন: ‘এটি নির্ভর করে কেন এই দেশগুলি এটি করছে এবং তাদের উদ্দেশ্য কী তার উপর।’
একজন ব্রিটিশ সরকারি কর্মকর্তা, নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছিলেন যে স্বীকৃতির প্রতীকীকরণ যথেষ্ট নয়।
‘প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কি এমন কিছুর দিকে অগ্রগতি অর্জন করতে পারি যাতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কেবল একটি স্বীকৃতি দেওয়া পক্ষে পরিণত না হয়। ‘
নিউইয়র্ক ঘোষণাপত্রে ব্রিটেনসহ স্বাক্ষরকারীদের ‘ফিলিস্তিন প্রশ্নের শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তির জন্য বাস্তব, নির্দিষ্ট সময় সীমাবদ্ধ এবং অপরিবর্তনীয় পদক্ষেপ’ গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
লন্ডনের কর্মকর্তারা ঘোষণাপত্রে গাজা ও পশ্চিম তীর একীভূতকরণ, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এবং ফিলিস্তিনি নির্বাচনের প্রতি সমর্থন (পাশাপাশি গাজার জন্য আরব পুনর্গঠন পরিকল্পনা) উল্লেখ করার দিকে ইঙ্গিত করেছেন যা স্বীকৃতি অনুসরণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
কিন্তু তারা জানেন যে এক্ষেত্রে বাধাগুলি ভয়াবহ।
ইসরাইল দৃঢ়ভাবে বিরোধিতা করে আসছে এবং পশ্চিম তীরের কিছু অংশ বা পুরো অংশ আনুষ্ঠানিকভাবে সংযুক্ত করার মাধ্যমে প্রতিশোধ নেওয়ার হুমকিও দিয়েছে।
এদিকে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বৃহস্পতিবার এই বিষয়ে তার অসন্তোষ স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে আমার মতবিরোধ রয়েছে। ‘