কালামের বিষফোঁড়া আশা

- আপডেট সময় : ০১:৫২:০৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৮ অক্টোবর ২০২৫
- / ৯ জন পড়েছেন
নারায়ণগঞ্জ-৫ (সদর-বন্দর) আসনের রাজনীতিতে একসময় সবচেয়ে শক্ত অবস্থানে ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সাবেক সংসদ সদস্য ও নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট আবুল কালাম। ১৯৯১, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টানা তিনবার বিজয়ী হয়ে তিনি ছিলেন এ অঞ্চলের বিএনপি রাজনীতির সবচেয়ে আলোচিত ও প্রভাবশালী নেতাদের একজন। আইন পেশা থেকে উঠে আসা কালাম তার মেধা, নেতৃত্বগুণ ও জনসংযোগ দিয়ে এলাকায় দলের শক্ত ভিত তৈরি করেছিলেন।
বিএনপির জাতীয় নেতাদের কাছেও তিনি ছিলেন আস্থাভাজন। অথচ আজ সময়ের পালাবদলে তিনি নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তার মুখে দাঁড়িয়ে আছেন।
এর প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে স্বৈরাচার আমলে কালামের নিষ্ক্রিয়তা আর তারই ছেলে নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির যুগ্ম-আহ্বায়ক ও নাসিকের ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর আবুল কাউছার আশা।
পতিত স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ সরকারের দীর্ঘ শাসনামলে আবুল কালাম পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় বিএনপি নেতা-কর্মীরা। তারা জানান, এ সময় তিনি অসুস্থতার অজুহাতে রাজনীতি থেকে নিজেকে আড়াল করে ফেলেন এবং কারও সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন না। এমনকি বিএনপির কোনো কর্মী ফোন করলেও তিনি রিসিভ করতেন না বলে অভিযোগ রয়েছে।
আওয়ামী দমনপীড়নের সময় যখন দলের নেতাকর্মীরা হামলা-মামলায় জর্জরিত, কেউ কারাগারে, কেউ আত্মগোপনে, তখন কালাম ছিলেন সম্পূর্ণ নিস্ক্রিয়। তৃণমূল কর্মীরা বলেন, আওয়ামী শাসনামলে তিনি দলের কোনো সাংগঠনিক কার্যক্রমে অংশ নেননি, কোনো কর্মসূচিতেও দেখা যায়নি। বরং সুবিধা বাগাতে তিনি ওসমান পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করেছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এসব কারণে এলাকার বিএনপি কর্মীদের মধ্যে তার প্রতি আস্থা অনেকটাই হারিয়ে গেছে। এলকাবাসীর অফিযোগ তিনি ৩ বার এমপি নির্বাচিত হলেও কোন উন্নয়নই করেননি। কারো উপকারে এসেছেন এমন নজিরও নেই। তবে তিনি কারও ক্ষতিও করেননি। প্রকৃতপক্ষে আবুল কালামের কোন কিছু করার যোগ্যতা রয়েছে কিনা তা নিয়েও জনমনে প্রশ্ন রয়েছে।
এই অবস্থায় রাজনৈতিকভাবে আরও বিপদে ফেলেছে তার ছেলে আবুল কাউছার আশার বিতর্কিত কর্মকাণ্ড। বিএনপির তৃণমূল থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় নীতি-নির্ধারণী মহল নেতারা পর্যন্ত এ নিয়ে উদ্বিগ্ন। অভিযোগ রয়েছে, আশা দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় একটি নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তুলেছেন, যারা বিভিন্ন সময় টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, জমি দখল ও তাঁর বিরোধী নিজ রাজনৈতিক কর্মীদের দমনপীড়নে জড়িত।
স্থানীয় ব্যবসায়ী মহলের একাংশ অভিযোগ করেছেন, আশার নেতৃত্বে থাকা লোকজন নিয়মিতভাবে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও কন্ট্রাক্টরদের কাছ থেকে চাঁদ দাবি করে থাকে। যারা প্রতিবাদ করার সাহস করেছেন, তারা নানা হুমকি ও হামলার শিকার হয়েছেন।
এমন কর্মকাণ্ড স্বাভাবিকভাবেই বিএনপির ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। কারণ, যে দলে গণতন্ত্র, জনগণের অধিকার ও সুশাসনের কথা বলা হয়, সেই দলের প্রভাবশালী নেতার ছেলে যদি চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত থাকে, তাহলে দলীয় প্রতীক নিয়ে জনগণের সামনে দাঁড়ানো কঠিন হয়ে পড়ে।
এরই মধ্যে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা এ অভিযোগের বিষয়ে অবহিত হয়েছেন। দলের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে আলোচনা চলছে, এমন বিতর্কিত ইস্যুর কারণে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আবুল কালামকে মনোনয়ন দিলে তা দলের জন্য বড় ধরনের রাজনৈতিক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হয়ে দাঁড়াতে পারে।
আশার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ শুধু অর্থনৈতিক অপরাধ বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। রাজনৈতিক মহলের অনেকে বলছেন, তিনি দলের ভেতরেও বিভাজন তৈরি করতে সক্রিয়।
মহানগর বিএনপির বিভিন্ন নেতাদের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব, তৃণমূলের কর্মীদের ওপর তার দমননীতি এবং ব্যক্তিগত প্রভাব খাটানোর প্রবণতা দলের সাংগঠনিক শক্তিকে দুর্বল করেছে। ফলে বিএনপির ভেতরে একটি ক্ষোভ জমে উঠেছে, যা আসন্ন নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে। বহু কর্মী এখন প্রকাশ্যে বলছেন, আশার মতো বিতর্কিত চরিত্রের ছেলের কারণে তার বাবার প্রতি সমর্থন দেওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
স্থানীয় নেতারা মনে করছেন, আশার এ ধরনের কর্মকাণ্ড আসলে আবুল কালামের দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ারকে ম্লান করে দিচ্ছে। একসময় যিনি জনতার আস্থার প্রতীক ছিলেন, আজ তিনি নিজের পরিবারের বিতর্কের কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছেন। ভোটারদের বড় একটি অংশের মধ্যে এই ধারণা তৈরি হয়েছে যে, কালাম তার ছেলেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না।
একজন নেতা যদি নিজের পরিবারকে সঠিক পথে রাখতে ব্যর্থ হন, তবে তিনি কিভাবে জনগণের নেতৃত্ব দেবেন? এ প্রশ্ন এখন চারদিকে ঘুরপাক খাচ্ছে।
এদিকে, নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনটি রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে জামায়াতের শক্ত অবস্থান, অন্যদিকে বিএনপির দীর্ঘদিনের প্রভাব। দুই দলের জন্যই এটি মর্যাদার আসন। এখানে প্রার্থী নির্ধারণে একটু ভুল সিদ্ধান্তও নির্বাচনের ফল পাল্টে দিতে পারে। জামায়াতের তরফে চূড়ান্ত শক্তিশালী প্রার্থী সক্রিয় আছেন, যারা এরই মধ্যে মাঠে নেমে পড়েছেন এবং নিয়মিত নানা নির্বাচনী কৌশলে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
তারা কালামের পরিবারের এই বিতর্কিত ইস্যুকে প্রধান প্রচার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। ফলে মনোনয়ন পেলে কালামের জন্য নির্বাচনী লড়াই আগের চেয়ে অনেক বেশি কঠিন হয়ে যাবে।
কেন্দ্রীয় বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, দলের শীর্ষ নেতৃত্ব এ বিষয়ে গভীর পর্যবেক্ষণ করছে। আশার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এসেছে, তার প্রমাণ ও নথি এখন অনেকের কাছেই রয়েছে। এরই মধ্যে কিছু ব্যবসায়ী সংগঠন ও স্থানীয় নেতারা গোপনে কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিস্তারিত তথ্য দিয়েছেন।
এসব তথ্য পর্যালোচনা করে অনেক কেন্দ্রীয় নেতা মনে করছেন, দলীয় প্রতীকে কালামকে প্রার্থী করা হলে তা জামায়াত বা স্বতন্ত্র কারো জন্য রাজনৈতিক সুবিধা এনে দিতে পারে।
অন্যদিকে, কালামের সমর্থকরা বলছেন, তার দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, সাংগঠনিক দক্ষতা ও জনপ্রিয়তা এখনও অটুট রয়েছে। তারা বিশ্বাস করেন, যদি কালামকে সুযোগ দেওয়া হয়, তবে তিনি জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে পারবেন। তবে প্রশ্ন রয়ে গেছে আওয়ামী স্বৈরশাসনের সময় হাত-পা গুটিয়ে থাকা কালাম বা আশার কর্মকাণ্ড ভুলে গিয়ে দলীয় কর্মীরা বা জনগণ কি সত্যিই তাঁদেরকে ভোট দেবে? রাজনৈতিক বাস্তবতায় এ প্রশ্নের উত্তর এখনই বলা কঠিন।
এখন সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয় হলো দলীয় মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় কেন্দ্র কতটা কঠোর হবে। বিএনপি যদি সত্যিই বিতর্ক এড়াতে চায়, তবে নতুন প্রার্থী বেছে নিতে হবে। ইতিমধ্যেই নারায়ণগঞ্জ বিএনপির ভেতরে কয়েকজন বিকল্প নেতার নাম আলোচনায় এসেছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ তরুণ, কেউবা দীর্ঘদিন ধরে সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত এবং তৃণমূলে গ্রহণযোগ্য। এমন পরিস্থিতিতে আবুল কালামের ভবিষ্যৎ অনেকটাই নির্ভর করছে কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের ওপর।
তবে এটাও সত্য, রাজনীতিতে অভিজ্ঞতা ও অতীত ভূমিকা সবসময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কালাম যদি শেষ মুহূর্তে ছেলের বিতর্ক থেকে নিজেকে আলাদা প্রমাণ করতে পারেন, তবে হয়তো তিনি আবারও কেন্দ্রের আস্থা অর্জন করতে পারবেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত আশার কর্মকাণ্ড তার পুরো রাজনৈতিক ক্যারিয়ারকে বিষফোঁড়ার মতো পীড়া দিচ্ছে।
নারায়ণগঞ্জের রাজনৈতিক মহল বলছে, “আশা আসলে কালামের বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে।” স্থানীয় সাধারণ ভোটার থেকে শুরু করে বিএনপির তৃণমূল নেতারাও এ বক্তব্য এখন খোলাখুলি বলছেন। এ ধরনের বক্তব্য যত বাড়ছে, ততই কালামের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। নির্বাচনের অঙ্গনে যেখানে প্রত্যেকটি পদক্ষেপ হিসেব করে ফেলতে হয়, সেখানে নিজের পরিবারের বিতর্কই যদি বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তবে আর কিছু বলার থাকে না।
আবুল কালাম একসময় যে বিশ্বাস, আস্থা ও জনপ্রিয়তার প্রতীক ছিলেন, তার সেই অবস্থান আজ ছেলের নানা অপকর্মের কারণে বিপন্ন। আশার সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও দলের ভেতরে বিভাজন সৃষ্টি- সব মিলিয়ে কালামের জন্য এটি এখন সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক সংকট। বিএনপির নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা এ বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট সঙ্কিত, আর সেই কারণেই আগামী জাতীয় নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে কালামের মনোনয়ন পাওয়া এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
তবে একটি বিষয় পরিষ্কার, আশা যদি এভাবে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকেন, তাহলে কালামের জন্য এই নির্বাচনী মাঠ আর আগের মতো উর্বর থাকবে না। সময়ই বলে দেবে, তিনি কি তার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে পারবেন নাকি ছেলে আশার কর্মকাণ্ডই তার দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের সমাপ্তি টেনে দেবে।