ঢাকা ০১:৪৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১২ নভেম্বর ২০২৫, ২৭ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

দূরে সরে যাচ্ছে চাঁদ, পৃথিবীর কী হবে?

প্রতিবেদকের নাম :
  • আপডেট সময় : ০৭:৩১:৫৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • / ৭০ জন পড়েছেন
চাঁদ প্রতি বছর পৃথিবী থেকে একটু একটু করে দূরে সরে যাচ্ছে। অবশ্য দূরে সরে যাওয়ার হার খুব কম। বছরে মাত্র ৪ সেন্টিমিটারের মতো। এই ঘটনা কোনো আকস্মিক পরিবর্তন নয়।

এই দূরে সরে যাওয়ার পেছনে একটি ধীরগতির প্রক্রিয়া রয়েছে, যা কোটি কোটি বছর ধরে চলছে। কিন্তু দূর ভবিষ্যতে এটা অনেকটাই দূরে সরে যাবে। ফলে পৃথিবীতে প্রাণ ধারণই হয়তো কঠিন হয়ে পড়বে তখন। কারণ, পৃথিবীতে প্রাণ ধারণের জন্য যতগুলো বিষয় ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে, চাঁদের অবস্থান এর মধ্যে অন্যতম।
তাই চাঁদ ছাড়া পৃথিবীতে প্রাণ টিকে থাকা অসম্ভব।যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানী স্টিফেন ডিকারবি জানান, জোয়ার-ভাটার শক্তি ও কৌণিক ভরবেগের কারণে পৃথিবী থেকে দূরে সরে যাচ্ছে চাঁদ। সূর্য ও চাঁদের মহাকর্ষীয় টানের কারণে পৃথিবীতে জোয়ার-ভাটার সৃষ্টি হয়। চাঁদের আকর্ষণশক্তির কারণে পৃথিবীর যে অংশ চাঁদের দিকে থাকে সেখানে সমুদ্রের পানি ফুলে ওঠে।

বিপরীত দিকেও একই রকম জোয়ার সৃষ্টি হয়। এতে পৃথিবীর দুই পাশে দুটি জোয়ারের স্ফীতি তৈরি হয়। পৃথিবী তার নিজ অক্ষের ওপর প্রতি ২৪ ঘণ্টায় একবার ঘোরে। ফলে এই জোয়ারের স্ফীতি চাঁদের আকর্ষণের চেয়ে সামান্য এগিয়ে থাকে। পৃথিবীর ঘূর্ণন গতির কারণে এই স্ফীতি চাঁদকে সামনের দিকে ঠেলে দেয়।
ফলে চাঁদ অতিরিক্ত শক্তির মাধ্যমে তার কক্ষপথকে সামান্য প্রসারিত করছে।জোয়ারের স্ফীতি যখন চাঁদকে টেনে সামনে নিয়ে যায়, তখন চাঁদ পাল্টা টানে পৃথিবীর ঘূর্ণন গতির ওপর বিশেষ ধরনের ব্রেক তৈরি করে। এর ফলে পৃথিবীর ঘূর্ণনগতি ধীরে ধীরে কমে আসছে। এতে দিনের দৈর্ঘ্য প্রতি শতাব্দীতে প্রায় ২ দশমিক ৩ মিলিসেকেন্ড করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই পুরো প্রক্রিয়া পদার্থবিজ্ঞানের কৌণিক ভরবেগের সংরক্ষণ নীতির ওপর নির্ভরশীল। এই নীতি অনুসারে, কোনো আবদ্ধ সিস্টেমের মোট কৌণিক ভরবেগ স্থির থাকে। যখন পৃথিবীর ঘূর্ণনগতির কৌণিক ভরবেগ কমে যায়, তখন চাঁদের কক্ষপথের কৌণিক ভরবেগ বেড়ে যায়। আর কক্ষপথের কৌণিক ভরবেগ বাড়লে চাঁদ পৃথিবী থেকে দূরে সরে যায়।

বিজ্ঞানীরা চাঁদে পৃষ্ঠে বিশেষ প্রতিফলক বসিয়ে রেখেছেন। লেজার রশ্মি পাঠিয়ে তারা চাঁদের সঠিক দূরত্ব পরিমাপ করেন। ১৯৬৯ সালে অ্যাপোলো ১১ মিশনে এই প্রতিফলক স্থাপন করা হয়। সেই পরিমাপ থেকেই জানা যায়, চাঁদ ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে।

বিজ্ঞানীদের তথ্যমতে, চাঁদ যে গতিতে দূরে সরে যাচ্ছে, তা নিয়ে আপাতত বিপদের কোনো আশঙ্কা নেই। তবে কোটি কোটি বছর পর এর ফলে পৃথিবীতে দিনের দৈর্ঘ্য উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাবে। তখন জোয়ার-ভাটার তীব্রতাও কম হবে। এই বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া কেবল চাঁদ বা পৃথিবীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, মহাবিশ্বের অন্যান্য গ্রহ ও তাদের উপগ্রহের মধ্যে এমন প্রবণতা দেখা যায়।

চাঁদ ও পৃথিবীর সম্পর্ক এক অদ্ভুত ও সুন্দর ভারসাম্যের উপর দাঁড়িয়ে আছে। যদিও চাঁদ দূরে সরে যাচ্ছে, এই পরিবর্তন এত ধীর যে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কোনো প্রভাব পড়ে না। তবে ভবিষ্যতের পৃথিবী ও চাঁদের সম্পর্ক কেমন হবে, তা বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণে ক্রমাগত জানা যাবে।

ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির অর্থাৎ ক্যালটেকের গ্রহ বিজ্ঞানী ডেভিড স্টিভেনসন জানান, চাঁদের এই দূরে সরে যাওয়া আমাদের সৌরজগতের ইতিহাস এবং পৃথিবী-চাঁদের সম্পর্ক বুঝতে সহায়ক। এই ধীর প্রক্রিয়া থেকেই আমরা জানি পৃথিবীর দিনগুলি অতীতে ছোট ছিল এবং ভবিষ্যতে আরো বড় হবে।

ট্যাগ :

সংবাদটি সোস্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন

দূরে সরে যাচ্ছে চাঁদ, পৃথিবীর কী হবে?

আপডেট সময় : ০৭:৩১:৫৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫
চাঁদ প্রতি বছর পৃথিবী থেকে একটু একটু করে দূরে সরে যাচ্ছে। অবশ্য দূরে সরে যাওয়ার হার খুব কম। বছরে মাত্র ৪ সেন্টিমিটারের মতো। এই ঘটনা কোনো আকস্মিক পরিবর্তন নয়।

এই দূরে সরে যাওয়ার পেছনে একটি ধীরগতির প্রক্রিয়া রয়েছে, যা কোটি কোটি বছর ধরে চলছে। কিন্তু দূর ভবিষ্যতে এটা অনেকটাই দূরে সরে যাবে। ফলে পৃথিবীতে প্রাণ ধারণই হয়তো কঠিন হয়ে পড়বে তখন। কারণ, পৃথিবীতে প্রাণ ধারণের জন্য যতগুলো বিষয় ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে, চাঁদের অবস্থান এর মধ্যে অন্যতম।
তাই চাঁদ ছাড়া পৃথিবীতে প্রাণ টিকে থাকা অসম্ভব।যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানী স্টিফেন ডিকারবি জানান, জোয়ার-ভাটার শক্তি ও কৌণিক ভরবেগের কারণে পৃথিবী থেকে দূরে সরে যাচ্ছে চাঁদ। সূর্য ও চাঁদের মহাকর্ষীয় টানের কারণে পৃথিবীতে জোয়ার-ভাটার সৃষ্টি হয়। চাঁদের আকর্ষণশক্তির কারণে পৃথিবীর যে অংশ চাঁদের দিকে থাকে সেখানে সমুদ্রের পানি ফুলে ওঠে।

বিপরীত দিকেও একই রকম জোয়ার সৃষ্টি হয়। এতে পৃথিবীর দুই পাশে দুটি জোয়ারের স্ফীতি তৈরি হয়। পৃথিবী তার নিজ অক্ষের ওপর প্রতি ২৪ ঘণ্টায় একবার ঘোরে। ফলে এই জোয়ারের স্ফীতি চাঁদের আকর্ষণের চেয়ে সামান্য এগিয়ে থাকে। পৃথিবীর ঘূর্ণন গতির কারণে এই স্ফীতি চাঁদকে সামনের দিকে ঠেলে দেয়।
ফলে চাঁদ অতিরিক্ত শক্তির মাধ্যমে তার কক্ষপথকে সামান্য প্রসারিত করছে।জোয়ারের স্ফীতি যখন চাঁদকে টেনে সামনে নিয়ে যায়, তখন চাঁদ পাল্টা টানে পৃথিবীর ঘূর্ণন গতির ওপর বিশেষ ধরনের ব্রেক তৈরি করে। এর ফলে পৃথিবীর ঘূর্ণনগতি ধীরে ধীরে কমে আসছে। এতে দিনের দৈর্ঘ্য প্রতি শতাব্দীতে প্রায় ২ দশমিক ৩ মিলিসেকেন্ড করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই পুরো প্রক্রিয়া পদার্থবিজ্ঞানের কৌণিক ভরবেগের সংরক্ষণ নীতির ওপর নির্ভরশীল। এই নীতি অনুসারে, কোনো আবদ্ধ সিস্টেমের মোট কৌণিক ভরবেগ স্থির থাকে। যখন পৃথিবীর ঘূর্ণনগতির কৌণিক ভরবেগ কমে যায়, তখন চাঁদের কক্ষপথের কৌণিক ভরবেগ বেড়ে যায়। আর কক্ষপথের কৌণিক ভরবেগ বাড়লে চাঁদ পৃথিবী থেকে দূরে সরে যায়।

বিজ্ঞানীরা চাঁদে পৃষ্ঠে বিশেষ প্রতিফলক বসিয়ে রেখেছেন। লেজার রশ্মি পাঠিয়ে তারা চাঁদের সঠিক দূরত্ব পরিমাপ করেন। ১৯৬৯ সালে অ্যাপোলো ১১ মিশনে এই প্রতিফলক স্থাপন করা হয়। সেই পরিমাপ থেকেই জানা যায়, চাঁদ ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে।

বিজ্ঞানীদের তথ্যমতে, চাঁদ যে গতিতে দূরে সরে যাচ্ছে, তা নিয়ে আপাতত বিপদের কোনো আশঙ্কা নেই। তবে কোটি কোটি বছর পর এর ফলে পৃথিবীতে দিনের দৈর্ঘ্য উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাবে। তখন জোয়ার-ভাটার তীব্রতাও কম হবে। এই বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া কেবল চাঁদ বা পৃথিবীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, মহাবিশ্বের অন্যান্য গ্রহ ও তাদের উপগ্রহের মধ্যে এমন প্রবণতা দেখা যায়।

চাঁদ ও পৃথিবীর সম্পর্ক এক অদ্ভুত ও সুন্দর ভারসাম্যের উপর দাঁড়িয়ে আছে। যদিও চাঁদ দূরে সরে যাচ্ছে, এই পরিবর্তন এত ধীর যে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কোনো প্রভাব পড়ে না। তবে ভবিষ্যতের পৃথিবী ও চাঁদের সম্পর্ক কেমন হবে, তা বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণে ক্রমাগত জানা যাবে।

ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির অর্থাৎ ক্যালটেকের গ্রহ বিজ্ঞানী ডেভিড স্টিভেনসন জানান, চাঁদের এই দূরে সরে যাওয়া আমাদের সৌরজগতের ইতিহাস এবং পৃথিবী-চাঁদের সম্পর্ক বুঝতে সহায়ক। এই ধীর প্রক্রিয়া থেকেই আমরা জানি পৃথিবীর দিনগুলি অতীতে ছোট ছিল এবং ভবিষ্যতে আরো বড় হবে।