ইসদাইর-গাবতলী-লালপুরে আবারও ভয়াবহ জলাবদ্ধতা
ইসদাইর-গাবতলী-লালপুরে আবারও ভয়াবহ জলাবদ্ধতা

- আপডেট সময় : ০৫:১৩:৫৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৯ জুলাই ২০২৫
- / ১৫ জন পড়েছেন
স্টাফ রিপোর্টার
গত কয়েকদিনের টানা বর্ষণে আবারও নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার বিস্তীর্ণ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। ইসদাইর, গাবতলী, লালপুর, পৌষা পুকুর পাড়সহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ভয়াবহ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে, কোথাও হাঁটু পানি, আবার কোথাও কোমর সমান পানি। এই জলাবদ্ধতায় জনজীবন সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে একই সমস্যায় ভুগতে থাকা এসব এলাকার বাসিন্দারা ক্ষুব্ধ, ক্লান্ত এবং হতাশ। তাদের অভিযোগ, জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতির ফুলঝুড়ি ছাড়া আর কিছুই মেলেনি।
স্বাধীনতার পর থেকেই অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়নের ফলস্বরূপ ফতুল্লার মানুষ জলাবদ্ধতার অভিশাপে জর্জরিত। সামান্য বৃষ্টিতেই এলাকার রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, দোকানপাট এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পানিতে তলিয়ে যায়। বছরের পর বছর ধরে এই সীমাহীন ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে এখানকার কয়েক লক্ষ মানুষকে। ভুক্তভোগীদের মতে, নির্বাচন এলেই জনপ্রতিনিধিরা জলাবদ্ধতা নিরসনের আশ্বাস দেন, কিন্তু নির্বাচন শেষে সেই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন হয় না।
স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্যমতে, গত দশ বছরে জলাবদ্ধতার সমস্যাটি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। লালপুর এলাকার বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন বলেন, “বৃষ্টি হলেই আমাদের সব শেষ। ঘরের ভেতর পানি ঢুকে যায়। ছেলেমেয়েদের স্কুল-কলেজ যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। এটা কোনো জীবন হলো? প্রতিবার ভোটের আগে নেতারা আসেন, দেখে যান আর আশ্বাস দেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না।”
পৌষা পুকুর পাড়ের পঞ্চাশোর্ধ্ব মজিদ মিয়া ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, “স্বাধীনতার পর থেকেই এই কষ্ট করছি। কত এমপি, চেয়ারম্যান আসল-গেল, কেউ আমাদের দুঃখ বুঝল না। শুধু কথার ফুলঝুড়ি ছাড়ে। এবারের বৃষ্টিতে তো অবস্থা আরও খারাপ। তিন-চার দিন ধরে পানিবন্দি হয়ে আছি।” তার কথার সঙ্গে সুর মেলান গাবতলী এলাকার এক গৃহিণী, “রান্নাঘরে পানি, বাথরুমে পানি। এর মধ্যে কীভাবে বসবাস করা যায়? নোংরা পানির কারণে বাচ্চাদের অসুখ-বিসুখ লেগেই আছে।”
শিল্প-কারখানার বর্জ্য মিশ্রিত কালো ও দুর্গন্ধযুক্ত পানি এই জলাবদ্ধতাকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে। এই দূষিত পানি মাড়িয়েই প্রতিদিন হাজার হাজার শ্রমিককে তাদের কর্মস্থলে যেতে হয়, যা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ। চর্মরোগসহ নানা পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকে।
এই ভয়াবহ জলাবদ্ধতার অন্যতম প্রধান কারণ হলো এলাকার অত্যন্ত দুর্বল ড্রেনেজ ব্যবস্থা। ইসদাইর, গাবতলী, লালপুর ও পৌষা পুকুর পাড়সহ বিশাল এই অঞ্চলের পানি নিষ্কাশনের জন্য একমাত্র পথ হলো লিংক রোড রেজিস্ট্রি কমপ্লেক্সের সামনের একটি ছোট ড্রেন বা পাইপ, যা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। এই সংকীর্ণ পথ দিয়ে বিপুল পরিমাণ পানি সরতে না পারায় সামান্য বৃষ্টিতেই এলাকাগুলো প্লাবিত হয়।
ভুক্তভোগীরা জানান, এই সমস্যা সমাধানের জন্য তারা বারবার জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরে আবেদন করেছেন, কিন্তু কোনো সমাধান মেলেনি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে কেবল আশ্বাসই পাওয়া গেছে, কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
সরকারি কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না দেখে এলাকাবাসী, সামাজিক ব্যক্তিত্ব ও রাজনীতিবিদদের আর্থিক সহযোগিতায় জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য তিনটি অস্থায়ী পাম্প স্থাপন করা হয়। এই পাম্পগুলো দিয়ে পানি সেচে কিছুটা স্বস্তি মিললেও সম্প্রতি একটি পাম্পের পাইপ ফেটে যাওয়ায় সেটি অকেজো হয়ে পড়েছে। ফলে জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে।
এ বিষয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বৃহত্তর গাবতলী সোসাইটির সভাপতি ও নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সদ্য সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও নব-নির্বাচিত কার্যকরী পরিষদ সদস্য রফিকুল ইসলাম জীবন। তিনি বলেন, “উপজেলা প্রশাসন, জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে বারবার ধর্ণা দিয়েও কোনো লাভ হয়নি। মিলেছে শুধু আশ্বাস, কাজের কাজ কিছুই হয় না।” তিনি এই জলাবদ্ধতা নিরসনে জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্টদের দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জোর দাবি জানান।
নারায়ণগঞ্জ-৪ (ফতুল্লা-সিদ্ধিরগঞ্জ) আসনের টানা তিনবারের সাবেক সংসদ সদস্য এ কে এম শামীম ওসমান এই জলাবদ্ধতা নিরসনে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারেননি বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। বিভিন্ন সময়ে তিনি জলাবদ্ধতা নিরসনে নানা উদ্যোগের কথা বললেও তার কোনো বাস্তব প্রতিফলন দেখা যায়নি।
প্রায় ১৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা (ডিএনডি) বাঁধ প্রকল্পটি এই অঞ্চলের মানুষের জন্য আশার আলো হয়ে এসেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, ফতুল্লার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ইসদাইর, গাবতলী, লালপুর, পৌষা পুকুর পাড়ের মতো এলাকাগুলোকে এই প্রকল্পের আওতায় পুরোপুরি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ফলে ডিএনডি প্রকল্পের কাজ চললেও এই নির্দিষ্ট অঞ্চলগুলোর মানুষের দুর্ভোগ লাঘব হচ্ছে না।
শুধু ফতুল্লাই নয়, গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে নারায়ণগঞ্জ শহর এবং শহরতলীর বিভিন্ন এলাকাও পানিতে তলিয়ে গেছে। নগরীর প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে অলিগলি, পাড়া-মহল্লা সর্বত্রই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। চাষাঢ়া, মাসদাইর, জামতলা, দেওভোগ, বাবুরাইল, খানপুর, বাংলাবাজার, নিতাইগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় হাঁটু পানি জমে থাকতে দেখা গেছে।
এর ফলে যানবাহন চলাচল ব্যাহত হচ্ছে এবং তীব্র যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। অনেক এলাকায় বাসাবাড়ি ও দোকানে পানি ঢুকে পড়ায় সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ চরমে উঠেছে। শিক্ষার্থীরা নোংরা পানি পেরিয়ে স্কুলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। রিকশা ও অটোরিকশা চালকরাও এই ভোগান্তির শিকার। ইঞ্জিনে পানি ঢুকে যাওয়ায় তাদের গাড়ি বিকল হয়ে পড়ছে, ফলে আয় কমে যাচ্ছে।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) ড্রেনেজ ব্যবস্থার সংস্কার কাজ করলেও তার সুফল মিলছে না বলে অভিযোগ নগরবাসীর। কাজের ধীরগতি এবং অপরিকল্পিত খোঁড়াখুঁড়ির কারণে মানুষের ভোগান্তি আরও বেড়েছে। নাসিক কর্তৃপক্ষ অবশ্য বলছে, ড্রেন নির্মাণ কাজ শেষ হলে শহরে আর জলাবদ্ধতা থাকবে না। তবে কবে নাগাদ এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে, সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কেউ কিছু বলতে পারছে না।
এই পরিস্থিতিতে নারায়ণগঞ্জবাসী এক অবর্ণনীয় দুর্ভোগের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। ফতুল্লার দশক পুরোনো সমস্যা থেকে শুরু করে শহরের সাম্প্রতিক জলাবদ্ধতা-সব মিলিয়ে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি। ভুক্তভোগীদের একটাই দাবি, কথার ফুলঝুড়ি আর আশ্বাস নয়, তারা এই সমস্যার স্থায়ী ও কার্যকরী সমাধান চায়।