ঢাকা ০১:৫৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫, ২২ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
‘দেশ ছাড়ুন নয়তো গ্রেফতার হোন’—আফাগান শরণার্থীদের ইরানের হুঁশিয়ারি

‘দেশ ছাড়ুন নয়তো গ্রেফতার হোন’—আফাগান শরণার্থীদের ইরানের হুঁশিয়ারি

প্রতিবেদকের নাম :
  • আপডেট সময় : ০৯:৩২:৫৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ৬ জুলাই ২০২৫
  • / ৪ জন পড়েছেন

ইরানে বসবাসরত লাখ লাখ আফগান অভিবাসী ও শরণার্থীকে দেশ ছাড়তে বলা হয়েছে। অন্যথায় তাদের গ্রেপ্তার হওয়ার ঝুঁকি নিতে হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে ইরান সরকার।

আফগান অভিবাসী ও শরণার্থীদের জন্য ইরান ত্যাগ করার নির্ধারিত সময়সীমার মেয়াদ শেষ হয়েছে রোববার। খবর আল-জাজিরার।

মূলত ইসরাইলের সঙ্গে ১২ দিনের যুদ্ধ এবং ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলার জেরে ইরানজুড়ে নিরাপত্তা নিয়ে জনমনে উদ্বেগ বাড়ায় দেশটির সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এ ধরনের গণ-নির্বাসন আফগানিস্তানকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলবে। কারণ দেশটি বিশ্বে সবচেয়ে দরিদ্র ও সংকটাপন্ন দেশগুলোর একটি। বর্তমানে ইরানে প্রায় ৪০ লাখ আফগান অভিবাসী ও শরণার্থী রয়েছে, যাদের অনেকেই কয়েক দশক ধরে সেখানে বসবাস করছেন।

২০২৩ সালে ইরান সরকার ‘অবৈধ’ অভিবাসীদের তাড়াতে একটি অভিযান শুরু করে। চলতি বছরের মার্চে সরকার জানায়, যেসব আফগানদের বৈধভাবে থাকার অনুমতি নেই, তাদের রোববারের মধ্যে স্বেচ্ছায় চলে যেতে হবে, না হলে জোরপূর্বক দেশছাড়া করা হবে।

এই ঘোষণা পর থেকেই ৭ লাখেরও বেশি আফগান ইরান ছেড়ে চলে গেছেন এবং আরও লাখো আফগানি এখন জোরপূর্বক বহিষ্কারের ঝুঁকিতে রয়েছেন। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) জানায়, শুধু জুন মাসেই ২ লাখ ৩০ হাজারের বেশি আফগান ইরান ছেড়েছেন।

ইরান সরকার যদিও আফগানদের লক্ষ্যবস্তু বানানোর অভিযোগ অস্বীকার করেছে, তবে বাস্তবতা ভিন্ন। যুদ্ধ, দারিদ্র্য ও তালেবান শাসন থেকে বাঁচতে পালিয়ে আসা এই মানুষদের এখন তাদের একমাত্র আশ্রয়স্থল থেকেও বিতাড়নের মুখে পড়তে হচ্ছে।

তেহরানে বসবাসকারী রেস্তোরাঁ মালিক বাতৌল আকবারি বলেন, ‘আফগানদের বিরুদ্ধে যে বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে তা খুবই কষ্টদায়ক। এদের অনেকেই এই দেশেই জন্মেছে। এখানকার মাটি তাদের একমাত্র পরিচিত ঘর।’

তিনি আরও বলেন, ‘ইরানে জন্ম হলে আমাদের মনে হয় আমরা দুইটা দেশের মানুষ—আমাদের পূর্বপুরুষ আফগানিস্তান থেকে এসেছেন কিন্তু এই দেশকেই আমরা আপন বলে জেনেছি।’

আরেক আফগান শিক্ষার্থী মোহাম্মদ নাসিম মাজাহেরিকে পরিবারসহ দেশ ছাড়তে হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এই নির্বাসন বহু পরিবারকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে।‘

জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর জানায়, ইসরায়েলের সঙ্গে চলমান সংঘাতের সময় ইরান প্রতিদিন গড়ে ৩০ হাজার আফগানকে বহিষ্কার করেছে, যেখানে যুদ্ধের আগে এই সংখ্যা ছিল দৈনিক প্রায় ২ হাজার।

মঙ্গলবার ইরানি সরকারের মুখপাত্র ফাতেমেহ মোহাজেরানি বলেন, ‘আমরা সবসময় অতিথিদের ভালোভাবে রাখার চেষ্টা করেছি কিন্তু জাতীয় নিরাপত্তা সবার আগে। যারা অবৈধভাবে রয়েছেন তাদের অবশ্যই ফিরে যেতে হবে।’

ইউএনএইচসিআর আরও জানায়, গত মাসের শেষ দিকে আফগানিস্তানে ফিরে আসা প্রায় ১২ লাখ আফগানের মধ্যে অর্ধেকের বেশি এসেছেন ইরান থেকে, যাদের ফেরার প্রক্রিয়া শুরু হয় মার্চের ডেডলাইনের পর থেকেই।

সংস্থাটির আফগানিস্তান প্রতিনিধি আরাফাত জামাল বলেন, ‘মানুষজন বাসে করে আসছে। কখনো একসাথে পাঁচটি বাস এসে পৌঁছায়। পরিবারের সদস্যরা নেমে পড়ছে বিভ্রান্ত, ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত অবস্থায়।’

তিনি বলেন, ‘যুদ্ধ পরিস্থিতি এ অবস্থাকে আরও খারাপ করেছে; তবে সত্যি বলতে এটা দীর্ঘদিন ধরেই চলমান একটা প্রবণতা যার কিছুটা স্বেচ্ছায় ফেরা হলেও অনেকটাই জোরপূর্বক নির্বাসন।’

তেহরান থেকে আল জাজিরার সংবাদদাতা রেসুল সেরদার জানিয়েছেন, ইরানে আফগানদের বিভিন্ন অর্থনৈতিক সমস্যা, পণ্যের সংকট ও সামাজিক অসন্তোষের জন্য দোষারোপ করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘এই অভিযোগগুলো রাজনীতিকদের বক্তব্য ও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া প্রচারণা দ্বারা আরও উস্কে দেওয়া হয়েছে—বিশেষ করে ইরান-ইসরাইল যুদ্ধপর্বের পর, যেখানে ইসরাইল আফগানদের গুপ্তচর হিসেবে নিয়োগ করেছে—এমন দাবি উঠে এসেছে।’

ট্যাগ :

সংবাদটি সোস্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন

‘দেশ ছাড়ুন নয়তো গ্রেফতার হোন’—আফাগান শরণার্থীদের ইরানের হুঁশিয়ারি

‘দেশ ছাড়ুন নয়তো গ্রেফতার হোন’—আফাগান শরণার্থীদের ইরানের হুঁশিয়ারি

আপডেট সময় : ০৯:৩২:৫৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ৬ জুলাই ২০২৫

ইরানে বসবাসরত লাখ লাখ আফগান অভিবাসী ও শরণার্থীকে দেশ ছাড়তে বলা হয়েছে। অন্যথায় তাদের গ্রেপ্তার হওয়ার ঝুঁকি নিতে হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে ইরান সরকার।

আফগান অভিবাসী ও শরণার্থীদের জন্য ইরান ত্যাগ করার নির্ধারিত সময়সীমার মেয়াদ শেষ হয়েছে রোববার। খবর আল-জাজিরার।

মূলত ইসরাইলের সঙ্গে ১২ দিনের যুদ্ধ এবং ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলার জেরে ইরানজুড়ে নিরাপত্তা নিয়ে জনমনে উদ্বেগ বাড়ায় দেশটির সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এ ধরনের গণ-নির্বাসন আফগানিস্তানকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলবে। কারণ দেশটি বিশ্বে সবচেয়ে দরিদ্র ও সংকটাপন্ন দেশগুলোর একটি। বর্তমানে ইরানে প্রায় ৪০ লাখ আফগান অভিবাসী ও শরণার্থী রয়েছে, যাদের অনেকেই কয়েক দশক ধরে সেখানে বসবাস করছেন।

২০২৩ সালে ইরান সরকার ‘অবৈধ’ অভিবাসীদের তাড়াতে একটি অভিযান শুরু করে। চলতি বছরের মার্চে সরকার জানায়, যেসব আফগানদের বৈধভাবে থাকার অনুমতি নেই, তাদের রোববারের মধ্যে স্বেচ্ছায় চলে যেতে হবে, না হলে জোরপূর্বক দেশছাড়া করা হবে।

এই ঘোষণা পর থেকেই ৭ লাখেরও বেশি আফগান ইরান ছেড়ে চলে গেছেন এবং আরও লাখো আফগানি এখন জোরপূর্বক বহিষ্কারের ঝুঁকিতে রয়েছেন। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) জানায়, শুধু জুন মাসেই ২ লাখ ৩০ হাজারের বেশি আফগান ইরান ছেড়েছেন।

ইরান সরকার যদিও আফগানদের লক্ষ্যবস্তু বানানোর অভিযোগ অস্বীকার করেছে, তবে বাস্তবতা ভিন্ন। যুদ্ধ, দারিদ্র্য ও তালেবান শাসন থেকে বাঁচতে পালিয়ে আসা এই মানুষদের এখন তাদের একমাত্র আশ্রয়স্থল থেকেও বিতাড়নের মুখে পড়তে হচ্ছে।

তেহরানে বসবাসকারী রেস্তোরাঁ মালিক বাতৌল আকবারি বলেন, ‘আফগানদের বিরুদ্ধে যে বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে তা খুবই কষ্টদায়ক। এদের অনেকেই এই দেশেই জন্মেছে। এখানকার মাটি তাদের একমাত্র পরিচিত ঘর।’

তিনি আরও বলেন, ‘ইরানে জন্ম হলে আমাদের মনে হয় আমরা দুইটা দেশের মানুষ—আমাদের পূর্বপুরুষ আফগানিস্তান থেকে এসেছেন কিন্তু এই দেশকেই আমরা আপন বলে জেনেছি।’

আরেক আফগান শিক্ষার্থী মোহাম্মদ নাসিম মাজাহেরিকে পরিবারসহ দেশ ছাড়তে হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এই নির্বাসন বহু পরিবারকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে।‘

জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর জানায়, ইসরায়েলের সঙ্গে চলমান সংঘাতের সময় ইরান প্রতিদিন গড়ে ৩০ হাজার আফগানকে বহিষ্কার করেছে, যেখানে যুদ্ধের আগে এই সংখ্যা ছিল দৈনিক প্রায় ২ হাজার।

মঙ্গলবার ইরানি সরকারের মুখপাত্র ফাতেমেহ মোহাজেরানি বলেন, ‘আমরা সবসময় অতিথিদের ভালোভাবে রাখার চেষ্টা করেছি কিন্তু জাতীয় নিরাপত্তা সবার আগে। যারা অবৈধভাবে রয়েছেন তাদের অবশ্যই ফিরে যেতে হবে।’

ইউএনএইচসিআর আরও জানায়, গত মাসের শেষ দিকে আফগানিস্তানে ফিরে আসা প্রায় ১২ লাখ আফগানের মধ্যে অর্ধেকের বেশি এসেছেন ইরান থেকে, যাদের ফেরার প্রক্রিয়া শুরু হয় মার্চের ডেডলাইনের পর থেকেই।

সংস্থাটির আফগানিস্তান প্রতিনিধি আরাফাত জামাল বলেন, ‘মানুষজন বাসে করে আসছে। কখনো একসাথে পাঁচটি বাস এসে পৌঁছায়। পরিবারের সদস্যরা নেমে পড়ছে বিভ্রান্ত, ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত অবস্থায়।’

তিনি বলেন, ‘যুদ্ধ পরিস্থিতি এ অবস্থাকে আরও খারাপ করেছে; তবে সত্যি বলতে এটা দীর্ঘদিন ধরেই চলমান একটা প্রবণতা যার কিছুটা স্বেচ্ছায় ফেরা হলেও অনেকটাই জোরপূর্বক নির্বাসন।’

তেহরান থেকে আল জাজিরার সংবাদদাতা রেসুল সেরদার জানিয়েছেন, ইরানে আফগানদের বিভিন্ন অর্থনৈতিক সমস্যা, পণ্যের সংকট ও সামাজিক অসন্তোষের জন্য দোষারোপ করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘এই অভিযোগগুলো রাজনীতিকদের বক্তব্য ও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া প্রচারণা দ্বারা আরও উস্কে দেওয়া হয়েছে—বিশেষ করে ইরান-ইসরাইল যুদ্ধপর্বের পর, যেখানে ইসরাইল আফগানদের গুপ্তচর হিসেবে নিয়োগ করেছে—এমন দাবি উঠে এসেছে।’