গত ১৫ দিনে অন্তত ৯ লা'শ উদ্ধার!
না’গঞ্জে প্রশ্নবিদ্ধ পুলিশ প্রশাসন

- আপডেট সময় : ০৩:১০:৩১ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৮ জুন ২০২৫
- / ৯০ জন পড়েছেন
সাব্বির হোসেন
নারায়ণগঞ্জ এক সময়ের শিল্প, ব্যবসা আর শান্তি-শৃঙ্খলার প্রতীক এই শহর যেন বর্তমানে রূপ নিয়েছে আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তার নগরীতে। গত ১৫ দিনের ব্যবধানে শহরজুড়ে একাধিক খুন, গুম, অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার এবং রহস্যজনক মৃত্যু সমাজে যেমন নিরাপত্তাহীনতার বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছে, তেমনি প্রশাসনের নীরবতা প্রশ্ন তুলেছে আইনের শাসন নিয়েও।
বিশ্লেষক ও স্থানীয় নাগরিকদের ভাষ্য অনুযায়ী, এসব ঘটনায় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা ও অপরাধীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়াই পরিস্থিতিকে দিনদিন ভয়াবহ করে তুলছে। প্রতিদিন পত্রিকার পাতা বা সামাজিক মাধ্যমে চোখ রাখলেই নতুন কোনো মরদেহ উদ্ধারের সংবাদ চোখে পড়ে। আর তা যেন এখন “স্বাভাবিক ঘটনা” হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এক নজরে গত ১৫ দিনের খুন ও লাশ উদ্ধারের ঘটনাঃ
চাষাড়া রেলস্টেশন সংলগ্ন ড্রেন থেকে পঁচাগলা লাশ উদ্ধার
গত ৬ জুন ভোরে শহরের প্রাণকেন্দ্র চাষাড়া রেলস্টেশনের পাশে একটি ড্রেন থেকে উদ্ধার করা হয় অজ্ঞাত এক যুবকের পঁচাগলা মরদেহ। প্রাথমিকভাবে পুলিশের ধারণা, লাশটি প্রায় ৭-৮ দিন আগের। তবে নিহতের কোনো পরিচয় এখনো শনাক্ত হয়নি। ঘটনাস্থলে ছুটে আসা এলাকাবাসী বলেছে, তারা একাধিকবার দুর্গন্ধের কথা পুলিশকে জানালেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
সিদ্ধিরগঞ্জে বস্তাবন্দি মরদেহ
৮ জুন সিদ্ধিরগঞ্জ থানার মিজমিজি খাল থেকে উদ্ধার করা হয় বস্তাবন্দি অবস্থায় ২৫ বছর বয়সী যুবক জাহিদুল ইসলামের মরদেহ। নিহতের ভাই বলেন, “সে তিন দিন আগে নিখোঁজ হয়। থানায় জিডি করেছিলাম, কিন্তু গুরুত্ব দেয়নি কেউ। আজ ওর মরদেহ খাল থেকে পাওয়া গেল।” এখনও খুনের মোটিভ পরিষ্কার নয়।
ফতুল্লায় গৃহবধূকে গলা কেটে হত্যা
১১ জুন রাতে ফতুল্লার কাশিপুর এলাকায় স্বামীর সাথে কলহের জেরে গৃহবধূ রাবেয়া আক্তারকে নির্মমভাবে গলা কেটে হত্যা করা হয়। এলাকাবাসীর দাবি, স্বামীকে আগেও কয়েকবার মাদক সংক্রান্ত কারণে থানায় নেয়া হয়েছিল। কিন্তু তাকে জামিনে ছেড়ে দেওয়া হয়। ঘটনার পর থেকে স্বামী পলাতক, পুলিশ এখনও তাকে ধরতে পারেনি।
আড়াইহাজারে নিখোঁজের ৩ দিন পর লাশ
১৩ জুন, আড়াইহাজার থানার খাগকান্দা ইউনিয়নের একটি ধানক্ষেত থেকে উদ্ধার হয় নিখোঁজ যুবক আসিফ হোসেনের লাশ। তার শরীরে একাধিক আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। আসিফের পরিবার বলছে, “আমরা আগে থেকেই আশঙ্কা করছিলাম, কিন্তু পুলিশ গুরুত্ব দেয়নি।”
বন্দরে কিশোর গ্যাংয়ের ছুরিকাঘাতে কিশোর নিহত
১৫ জুন, বন্দরের মুসলিমনগরে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে এক কিশোর নিহত হয়। এলাকাবাসীর দাবি, দুই কিশোর গ্যাং ‘ডন গ্রুপ’ ও ‘রেডবুল
গ্রুপ’-এর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছিল। পুলিশ জানে, কিন্তু কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
v গত ১১ জুন শহরের অত্যান্ত অপরাধ প্রবণ এলাকা হিসেবে পরিচিত হাজিগঞ্জ কিল্লারপুল ড্রেজার কার্য্যালয়ের সড়কের পাশে অজ্ঞাত নামা একজন পুরুষের (আনুমানিক ৫০) মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
v ১৬ জুন সকালে নগরীর চাষাঢ়া বঙ্গবন্ধু সড়কে পড়ে থাকা অবস্থায় উদ্ধার হয় বন্দরের বাসিন্দা মুসলিম মিয়া নামেরে এক ব্যক্তির লাশ।
v সর্বশেষ গতকাল সকালে ফতুল্লার পূর্ব শিয়াচর এলাকা থেকে জনি সরকার নামের এক ব্যক্তির বস্তা বন্দি লাশ উদ্ধার করে এলাকাবাসী।
প্রশাসনের ভূমিকা: কেন এত নীরবতা?
প্রতিটি ঘটনার পর পুলিশের পক্ষ থেকে একই বিবৃতি,”তদন্ত চলছে”, “সন্দেহভাজনদের চিহ্নিত করা হয়েছে”, “দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে”। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অধিকাংশ ঘটনায় কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। অভিযুক্তদের কেউ কেউ প্রকাশ্যেই ঘুরে বেড়াচ্ছে, আবার কেউ পলাতক হলেও গ্রেপ্তারের কোনো তৎপরতা নেই।
নারায়ণগঞ্জ শহরের নাগরিক অধিকার ফোরামের সভাপতি হাসানুজ্জামান বলেন,
“প্রতিদিন কোথাও না কোথাও মরদেহ পাওয়া যাচ্ছে, অথচ আমরা প্রশাসনের কাছ থেকে কোনো ধরনের স্বস্তির বার্তা পাচ্ছি না। তারা যেন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে।”
নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান,
“আমরা চেষ্টা করছি, কিন্তু অনেক সময় অপরাধীরা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকায় আইনি প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। কিছু ঘটনা আন্তঃজেলা অপরাধ চক্রের সাথেও জড়িত।”
তবে এ বক্তব্যে সন্তুষ্ট নয় সাধারণ মানুষ। তাদের প্রশ্ন, “তাহলে আমরা যাব কোথায়?”
নাগরিক উদ্বেগ: কোথায় নিরাপত্তা?
নারায়ণগঞ্জ শহরে এখন সন্ধ্যার পর দোকানপাট দ্রুত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অনেক ব্যবসায়ী বলেছেন, তারা এখন দোকানে অতিরিক্ত কর্মচারী রেখে চলাফেরা করছেন, যাতে দ্রুত সরে পড়তে পারেন। নারীদের চলাফেরায় দেখা দিয়েছে সীমাবদ্ধতা।
বিশেষ করে অভিভাবকরা চরম আতঙ্কে রয়েছেন। স্কুল-কলেজগামী মেয়েরা প্রাইভেট পড়া কমিয়ে দিয়েছে, কারণ অভিভাবকরা আর তাদের একা বাইরে যেতে দিতে সাহস পাচ্ছেন না।
একজন অভিভাবক বলেন,
“একদিন পরপর লাশ পড়ছে, ছেলে-মেয়েদের নিয়ে ঘর থেকে বের হওয়াই কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে।”
জনপ্রতিনিধি ও সুশীল সমাজ কী বলছেন?
সিটি করপোরেশনের একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর বলেন,
“আমরা বারবার প্রশাসনকে বলেছি, কিন্তু তারা সময়মতো ব্যবস্থা নেয় না। এলাকায় কিশোর গ্যাং বা সন্ত্রাসীদের তালিকা দিয়েছি, কিন্তু অভিযান হয় না।”
সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও শিক্ষক ড. রফিকুল ইসলাম বলেন,
“এটা কেবল অপরাধ নয়, এটা সমাজের ওপর একটি মানসিক আক্রমণ। যখন মানুষ ভাবতে শুরু করে পুলিশ কিছু করবে না, তখন আইন-শৃঙ্খলা বলতে কিছু থাকে না।”
এইদিকে নগরীর সচেতন মহল বলছেন, বিষয়টি শুধু অপরাধ দমন নয়, এটি প্রশাসনিক ব্যর্থতা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবের প্রতিফলন। এখনই প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ। এর জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া উচিত যেমন, প্রতিটি খুন ও লাশ উদ্ধারের ঘটনায় পৃথক তদন্ত টিম গঠন, থানা পর্যায়ে মাসিক অপরাধ বিশ্লেষণ সভা বাধ্যতামূলক করা, কিশোর গ্যাং ও চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের তালিকা করে গ্রেপ্তার অভিযান, প্রতিটি এলাকা পর্যবেক্ষণে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন, প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে নিয়মিত সমন্বয় সভা, স্থানীয় সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনকে উৎসাহ দেওয়া। এইরূপ কিছু পদক্ষেপ জরুরী বানে গ্রহন করা দরকার।
নগরীর সাধারণ মানুষের মতে,নিয়মিত খুন, গুম, মরদেহ উদ্ধার, এই ঘটনাগুলো যেন এখন আমাদের জীবনের “নতুন স্বাভাবিকতা” হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অভ্যস্ততা সবচেয়ে বিপজ্জনক। কারণ, একবার যদি মানুষ রাষ্ট্রের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে, তাহলে সমাজে নেমে আসে অরাজকতা।
নারায়ণগঞ্জের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, অপরাধীরা কতটা বেপরোয়া, প্রশাসন কতটা উদাসীন, এবং নাগরিক সমাজ কতটা আতঙ্কগ্রস্ত। এখনই সময় সকলে একসাথে না দাঁড়ালে হয়তো সামনে আরও ভয়াবহ দিন অপেক্ষা করছে।