ঢাকা ০৫:৪০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ০১ জুলাই ২০২৫, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
ভেতরের লড়াইয়ে জামায়াতের সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে!

আড়াইহাজারে বিএনপির মনোনয়ন যুদ্ধে ‘সুমন বনাম আজাদ’

সোজাসাপটা রিপোর্ট
  • আপডেট সময় : ০৪:৩৭:৩৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৯ জুন ২০২৫
  • / ৮৭ জন পড়েছেন

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-২ (আড়াইহাজার) আসনে বিএনপির মনোনয়ন ঘিরে দলে দলে উত্তেজনা তুঙ্গে। প্রয়াত কেন্দ্রীয় নেতা বদরুজ্জামান খসরুর ছেলে মাহমুদুর রহমান সুমনকে ঘিরে যেখানে দলের তৃণমূল ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে, ঠিক তখনই একাধিক গুরুতর অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছেন দলের কেন্দ্রীয় নেতা নজরুল ইসলাম আজাদ। এ দুই কেন্দ্রীয় নেতার দ্বন্দ্বে ছায়া ফেলছে গোটা উপজেলা বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে।

দলের ঢাকা বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম আজাদের বিরুদ্ধে স্থানীয় বিএনপির বড় একটি অংশ অভিযোগ তুলেছে তিনি আওয়ামী লীগ কর্মীদের রাজনৈতিক সুরক্ষা ও আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন। এমনকি দলের মধ্যে আওয়ামীপন্থী লোকজনকে ঢুকিয়ে সাংগঠনিকভাবে বিএনপিকে ক্ষয় করার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

তাঁর ঘনিষ্ঠ সহচর সাদিকের ভাই মোবারক ছিলেন ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী। বর্তমানে তাকেও বিএনপির বিভিন্ন প্রচারণায় দেখা যাচ্ছে। একইসাথে আজাদের ভাই রাকিবের জামাই হলেন আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানকের পালকপুত্র—যা কেন্দ্রীয় বিএনপির ভেতরে আজাদের অবস্থান নিয়ে নতুন করে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

বিএনপির এক সময়ের ভরসাযোগ্য নেতা হাবিবুর রহমান হাবু বর্তমানে দলীয় আদর্শ থেকে সরে গেছেন বলেই নেতাকর্মীদের অভিযোগ। জানা যায়, দক্ষিণপাড়ায় অবস্থিত জনসেবা হাসপাতালটি জোর দখল করে তিনি সেখানে চাঁদাবাজি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। অভিযোগ রয়েছে, তিনি আওয়ামী লীগ কর্মীদের পুনর্বাসনও করছেন টাকার বিনিময়ে।

বদরুজ্জামান খসরুর মৃত্যুর পর দলের মধ্যে শান্তি ফিরলেও নজরুল ইসলাম আজাদের ঘনিষ্ঠ ভিপি কবির, সাদিক ও হাবুর মতো নেতাদের তৎপরতায় আবারো নতুন করে বিভক্তির শঙ্কা তৈরি হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, “এই চক্রটাই একসময় সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্ত ছিল, এখন নিজেদের বৈধতা দিতে নতুনভাবে মঞ্চ তৈরি করছে।”

তবে নজরুল ইসলাম আজাদের সমর্থকদের দাবি, “তিনি দুঃসময়ে দলের নেতাকর্মীদের পাশে ছিলেন। হামলা-মামলার সময় পাশে দাঁড়িয়েছেন। এজন্য মাঠপর্যায়ের অনেকে এখনো তাকেই ভরসা করেন।”

আড়াইহাজার বিএনপির প্রয়াত নেতা বদরুজ্জামান খসরুর ছেলে মাহমুদুর রহমান সুমন দীর্ঘদিন ধরে কেন্দ্রীয় যুবদলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। খসরুর মৃত্যুতে নেতাকর্মীরা তার স্মৃতিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে সুমনের নেতৃত্ব মেনে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। থানা বিএনপির বৈঠকে তার হাতে দায়িত্বভার তুলে দেওয়া হয় বলে জানা যায়।

সাধারণ ভোটারদের কাছে সুমন একজন ক্লিন ইমেজের মানুষ। তিনি কখনই সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি বা কারো উপর হামলা মামলায় নেই। বিএনপি যদি ভালো কোন মানুষকে আড়াইহাজারের দ্বায়িত্ব দিতে চায় তবে মাহমুদুর রহমান সুমনকে দিতে হবে।

সাবেক এমপি আতাউর রহমান খান আঙ্গুর অভিযোগ করেছেন, “আমার বিরুদ্ধে নানার মিথ্যা ছড়ানো হচ্ছে অথচ গত ১৫ বছরে আমি ৩০টির বেশি মামলা খেয়েছি, জেল খেটেছি, নির্যাতিত হয়েছি। আমার মতো নির্যাতিত নেতা কতজন আছে?”

তবে স্থানীয় পর্যায়ে অনেকে মনে করেন, আঙ্গুরের কার্যকর রাজনীতির সময় অনেকটাই পেরিয়ে গেছে। বর্তমানে তিনি পেছন থেকে সুমনকে সমর্থন দিচ্ছেন বলে শোনা যায়। আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহন করার ঘোষণা দিলেও সরাসরি নেতৃত্বে তার ফেরার সম্ভাবনা ক্ষীণ।

জামায়াতের মাটি শক্ত হচ্ছে, প্রার্থী ইলিয়াস আলী মোল্লা

বিএনপির অন্তর্দ্বন্দ্ব আর বিশ্বাসযোগ্যতার সংকটে যখন তৃণমূল বিভ্রান্ত, তখন পাল্লা ভারী হচ্ছে জামায়াতে ইসলামীর। জামায়াতের নিশ্চিত প্রার্থী অধ্যাপক ইলিয়াস আলী মোল্লা এলাকায় পরিচিত মুখ। দুপ্তারা ইউনিয়নের সাবেক স্বর্ণপদক প্রাপ্ত চেয়ারম্যান এবং পার্টির পরীক্ষিত সংগঠক হিসেবে তার জনপ্রিয়তা বাড়ছে দ্রুত। বিশ্লেষকরা বলছেন, “বিএনপি যদি বিভক্ত হয়ে পড়ে, তাহলে জামায়াত সহজেই এই আসনে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে পারবে।”

বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপির সামনে দুটি পথ। এক. ‌পুরনো প্রভাবশালীদের আঁকড়ে ধরে দলীয় অবস্থান বজায় রাখা; দুই. নতুন ও ক্লিন ইমেজের নেতৃত্বকে সামনে এনে দলকে ঐক্যবদ্ধ ও তৃণমূলনির্ভর করে তোলা।

আগামী নির্বাচনে আড়াইহাজারে বিএনপির প্রধান লড়াইটি জামায়াতের সঙ্গে যতটা, তার চেয়েও বেশি নিজেদের ভেতরের বিশ্বাসযোগ্যতা ও নেতৃত্বের প্রশ্নে। আজাদ বনাম সুমন, জামায়াত বনাম ধানের শীষ—এই বহুমাত্রিক লড়াইয়ের ময়দানে কে টিকে থাকবে, তার সিদ্ধান্ত হবে আগামী ক’মাসেই।

ট্যাগ :

সংবাদটি সোস্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন

ভেতরের লড়াইয়ে জামায়াতের সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে!

আড়াইহাজারে বিএনপির মনোনয়ন যুদ্ধে ‘সুমন বনাম আজাদ’

আপডেট সময় : ০৪:৩৭:৩৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৯ জুন ২০২৫

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-২ (আড়াইহাজার) আসনে বিএনপির মনোনয়ন ঘিরে দলে দলে উত্তেজনা তুঙ্গে। প্রয়াত কেন্দ্রীয় নেতা বদরুজ্জামান খসরুর ছেলে মাহমুদুর রহমান সুমনকে ঘিরে যেখানে দলের তৃণমূল ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে, ঠিক তখনই একাধিক গুরুতর অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছেন দলের কেন্দ্রীয় নেতা নজরুল ইসলাম আজাদ। এ দুই কেন্দ্রীয় নেতার দ্বন্দ্বে ছায়া ফেলছে গোটা উপজেলা বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে।

দলের ঢাকা বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম আজাদের বিরুদ্ধে স্থানীয় বিএনপির বড় একটি অংশ অভিযোগ তুলেছে তিনি আওয়ামী লীগ কর্মীদের রাজনৈতিক সুরক্ষা ও আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন। এমনকি দলের মধ্যে আওয়ামীপন্থী লোকজনকে ঢুকিয়ে সাংগঠনিকভাবে বিএনপিকে ক্ষয় করার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

তাঁর ঘনিষ্ঠ সহচর সাদিকের ভাই মোবারক ছিলেন ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী। বর্তমানে তাকেও বিএনপির বিভিন্ন প্রচারণায় দেখা যাচ্ছে। একইসাথে আজাদের ভাই রাকিবের জামাই হলেন আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানকের পালকপুত্র—যা কেন্দ্রীয় বিএনপির ভেতরে আজাদের অবস্থান নিয়ে নতুন করে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

বিএনপির এক সময়ের ভরসাযোগ্য নেতা হাবিবুর রহমান হাবু বর্তমানে দলীয় আদর্শ থেকে সরে গেছেন বলেই নেতাকর্মীদের অভিযোগ। জানা যায়, দক্ষিণপাড়ায় অবস্থিত জনসেবা হাসপাতালটি জোর দখল করে তিনি সেখানে চাঁদাবাজি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। অভিযোগ রয়েছে, তিনি আওয়ামী লীগ কর্মীদের পুনর্বাসনও করছেন টাকার বিনিময়ে।

বদরুজ্জামান খসরুর মৃত্যুর পর দলের মধ্যে শান্তি ফিরলেও নজরুল ইসলাম আজাদের ঘনিষ্ঠ ভিপি কবির, সাদিক ও হাবুর মতো নেতাদের তৎপরতায় আবারো নতুন করে বিভক্তির শঙ্কা তৈরি হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, “এই চক্রটাই একসময় সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্ত ছিল, এখন নিজেদের বৈধতা দিতে নতুনভাবে মঞ্চ তৈরি করছে।”

তবে নজরুল ইসলাম আজাদের সমর্থকদের দাবি, “তিনি দুঃসময়ে দলের নেতাকর্মীদের পাশে ছিলেন। হামলা-মামলার সময় পাশে দাঁড়িয়েছেন। এজন্য মাঠপর্যায়ের অনেকে এখনো তাকেই ভরসা করেন।”

আড়াইহাজার বিএনপির প্রয়াত নেতা বদরুজ্জামান খসরুর ছেলে মাহমুদুর রহমান সুমন দীর্ঘদিন ধরে কেন্দ্রীয় যুবদলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। খসরুর মৃত্যুতে নেতাকর্মীরা তার স্মৃতিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে সুমনের নেতৃত্ব মেনে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। থানা বিএনপির বৈঠকে তার হাতে দায়িত্বভার তুলে দেওয়া হয় বলে জানা যায়।

সাধারণ ভোটারদের কাছে সুমন একজন ক্লিন ইমেজের মানুষ। তিনি কখনই সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি বা কারো উপর হামলা মামলায় নেই। বিএনপি যদি ভালো কোন মানুষকে আড়াইহাজারের দ্বায়িত্ব দিতে চায় তবে মাহমুদুর রহমান সুমনকে দিতে হবে।

সাবেক এমপি আতাউর রহমান খান আঙ্গুর অভিযোগ করেছেন, “আমার বিরুদ্ধে নানার মিথ্যা ছড়ানো হচ্ছে অথচ গত ১৫ বছরে আমি ৩০টির বেশি মামলা খেয়েছি, জেল খেটেছি, নির্যাতিত হয়েছি। আমার মতো নির্যাতিত নেতা কতজন আছে?”

তবে স্থানীয় পর্যায়ে অনেকে মনে করেন, আঙ্গুরের কার্যকর রাজনীতির সময় অনেকটাই পেরিয়ে গেছে। বর্তমানে তিনি পেছন থেকে সুমনকে সমর্থন দিচ্ছেন বলে শোনা যায়। আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহন করার ঘোষণা দিলেও সরাসরি নেতৃত্বে তার ফেরার সম্ভাবনা ক্ষীণ।

জামায়াতের মাটি শক্ত হচ্ছে, প্রার্থী ইলিয়াস আলী মোল্লা

বিএনপির অন্তর্দ্বন্দ্ব আর বিশ্বাসযোগ্যতার সংকটে যখন তৃণমূল বিভ্রান্ত, তখন পাল্লা ভারী হচ্ছে জামায়াতে ইসলামীর। জামায়াতের নিশ্চিত প্রার্থী অধ্যাপক ইলিয়াস আলী মোল্লা এলাকায় পরিচিত মুখ। দুপ্তারা ইউনিয়নের সাবেক স্বর্ণপদক প্রাপ্ত চেয়ারম্যান এবং পার্টির পরীক্ষিত সংগঠক হিসেবে তার জনপ্রিয়তা বাড়ছে দ্রুত। বিশ্লেষকরা বলছেন, “বিএনপি যদি বিভক্ত হয়ে পড়ে, তাহলে জামায়াত সহজেই এই আসনে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে পারবে।”

বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপির সামনে দুটি পথ। এক. ‌পুরনো প্রভাবশালীদের আঁকড়ে ধরে দলীয় অবস্থান বজায় রাখা; দুই. নতুন ও ক্লিন ইমেজের নেতৃত্বকে সামনে এনে দলকে ঐক্যবদ্ধ ও তৃণমূলনির্ভর করে তোলা।

আগামী নির্বাচনে আড়াইহাজারে বিএনপির প্রধান লড়াইটি জামায়াতের সঙ্গে যতটা, তার চেয়েও বেশি নিজেদের ভেতরের বিশ্বাসযোগ্যতা ও নেতৃত্বের প্রশ্নে। আজাদ বনাম সুমন, জামায়াত বনাম ধানের শীষ—এই বহুমাত্রিক লড়াইয়ের ময়দানে কে টিকে থাকবে, তার সিদ্ধান্ত হবে আগামী ক’মাসেই।