নদী ও খালবেষ্টিত না’গঞ্জে সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার কারণ কি?

- আপডেট সময় : ০৩:৩৮:০৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৯ জুন ২০২৫
- / ৬৮ জন পড়েছেন
নদী ও খালবেষ্টিত জেলা নারায়ণগঞ্জ। শীতলক্ষ্যা, বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী ও মেঘনা নদী ঘিরে থাকা এই জেলা একসময় ছিল জলাভূমির শহর। অথচ এখন সামান্য বৃষ্টিতেই শহরের প্রধান সড়কগুলো হাঁটুসমান পানিতে তলিয়ে যায়। জলাবদ্ধতা যেন নিত্যকার দুর্ভোগে পরিণত হয়েছে। কেন এই অবস্থা এর কারণ কি?
নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের তথ্যমতে, শহরের বিভিন্ন এলাকার ৪০টির বেশি খাল এখন প্রায় বিলুপ্ত। শহরের ভেতরে অনেক খালই এখন মানচিত্রে আছে, বাস্তবে নেই। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, নাসিক ১৩, ১৪, ১৬ ও ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে পূর্বে প্রবাহমান থাকা কয়েকটি খাল এখন আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত। টানবাজার, পশ্চিম মাসদাইর, খানপুর, চাষাড়া ও বাবুরাইল এলাকা জলাবদ্ধতার মূল কারণ, পানি বের হওয়ার মতো খাল অবশিষ্ট নেই। এর ফলে, প্রতিবছর বর্ষা এলেই হাজারো পরিবার জলাবদ্ধতার কবলে পড়ে। ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা দেখা দেয়, শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমে যায়, স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে।
জলাবদ্ধতার কারণ ও খাল দখলের প্রতিবেদন করতে গিয়ে দৈনিক সোজাসাপটার প্রতিবেদকের কাছে উঠে আসে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য যা শুনলে চোখ কপালে উঠার মতো অবস্থা।
অনুসন্ধান বলছে, খাল দখল নারায়ণগঞ্জে এখন এক সাংগঠনিক অপরাধে পরিণত হয়েছে। স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের কিছু নেতা খালপাড়ে মার্কেট, বাসাবাড়ি এমনকি ধর্মীয় স্থাপনাও গড়ে তুলেছেন। একাধিকবার উচ্ছেদ অভিযান হলেও কিছুদিন পর আবারো দখল হয়ে যায়।
একদিকে,জমির মালিকরা খালের পাশে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করে ভাড়া দিচ্ছেন। তারা ওয়াকফ দলিল, সরকারি নকশা উপেক্ষা করে খাল ভরাট করে ফেলছেন।
অন্যদিকে,খালের দুই পাড়ের বাসিন্দারা একপর্যায়ে ধীরে ধীরে খালে ময়লা ফেলে জায়গা দখল করছেন। রান্নাঘর, টয়লেট, গুদাম, সবই এখন খালের জায়গায়!
খাল শুধু দখল করেই ক্ষ্যন্ত হননি সাথে ঘটাচ্ছে মরনঘাতি দূষণও। নারায়ণগঞ্জ একটি শিল্প নগরী হওয়ায় এর প্রভাব আরও ভয়াবহ আকারে রূপ নিয়েছে।
নগরীর সিদ্ধিরগঞ্জ, ফতুল্লা, শিমরাইল ও কাঁচপুর এলাকার ডাইং, গার্মেন্টস, প্লাস্টিক ও ট্যানারি কারখানাগুলোর বেশিরভাগই বর্জ্য শোধন ছাড়াই খালে বর্জ্য ফেলে। এতে খালের পানিতে দেখা যায় কালো রঙ, তীব্র গন্ধ এবং বিষাক্ততা।
শহরের প্রায় প্রতিটি বাজার ও কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালের কঠিন বর্জ্য খালেই ফেলা হয়। এতে জমে থাকা বর্জ্য খালের গতিপথ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দিচ্ছে। অনেক বাড়ির সেপটিক ট্যাংকের পাইপ সরাসরি খালে সংযুক্ত। দিনের পর দিন এই পয়ঃবর্জ্যে খাল হয়ে পড়ছে অচল ও জীবাণুবাহক।
নারায়ণগঞ্জে প্রায় ৫ হাজার ছোট,বড় কারখানা থাকলেও বাস্তব চিত্র হলো , প্রায় ৫০ শতাংশ কারখানায়ই ইটিপি নেই, আর যে ক’টিতে আছে তার অর্ধেকই অচল বা নিষ্ক্রিয়। ইটিপি না থাকার অন্যতম কারণ হলো, ব্যয়বহুল ইটিপি চালাতে বিদ্যুৎ, কেমিক্যাল ও লোকবল লাগে ,ফলে অনেক মালিক সেটি ফাঁকি দেন। দুর্বল মনিটরিং পরিবেশ অধিদপ্তরের পর্যাপ্ত লোকবল ও কার্যকর মনিটরিং ব্যবস্থা না থাকায় কারখানা মালিকরা সহজেই এড়িয়ে যান নিয়ম। দুর্নীতি কাগজে,কলমে ইটিপি চালু দেখিয়ে ফাইল ক্লিয়ার করে ফেলা হয়। ম্যানেজমেন্টের ঘুষ লেনদেনের অভিযোগও রয়েছে।
এইসব অনিয়ন্ব অবহেলার কারণে এইসব কারখানার বিষাক্ত তরল বর্জ্য সরাসরি নদী ও খালে গিয়ে পড়ে। এতে খাল হয়ে পড়ে বিষাক্ত এবং এর চারপাশের জলাবদ্ধতা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করে।
উপরোক্ত সকল বিষয়ে সিটি কর্পোরেশন, জেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর ও পাউবো (পানি উন্নয়ন বোর্ড) , এই চারটি সংস্থা মিলেই তাত্ত্বিকভাবে খাল ও নদীর ব্যবস্থাপনায় জড়িত থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে মিলেছে তাঁর উল্টো চিত্র। সংস্থাগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। কেউই দায়িত্ব স্বীকার করতে চান না। উচ্ছেদ অভিযান বছরে ১-২ বার হয়, তাও আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে থেমে যায়। ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রশাসন অনাগ্রহী থাকে।
পরিবেশবিদ ও নাগরিকদের আশঙ্কাঃ
পরিবেশবাদীরা বলছেন, এখনই খাল উদ্ধার ও দূষণ রোধে কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে নারায়ণগঞ্জে শহুরে বন্যা, জলাবদ্ধতা ও পানিবাহিত রোগ মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়তে পারে।
নাগরিকরা বলছেন, কর দিচ্ছি ঠিকই কিন্তু বিনিময়ে শহরে হাঁটতেও পারছি না। জলাবদ্ধতায় অনেক পরিবার বাধ্য হয়ে অন্যত্র বাসা নিচ্ছে। নারায়ণগঞ্জ এক সময়ের নদী-খাল, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র হলেও এখন শহরটি পরিণত হচ্ছে স্থায়ী জলাবদ্ধ এক সংকটময় নগরীতে। খাল হারাচ্ছে তার অস্তিত্ব, শিল্প দূষণ গ্রাস করছে পরিবেশ। যদি এখনই সচেতন ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার ভিত্তিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করা হয়, তবে অচিরেই নারায়ণগঞ্জ একটি ‘ডুবে যাওয়া নগরী’তে পরিণত হবে।