বিদ্রোহের ইঙ্গিত মান্নানের

- আপডেট সময় : ০৪:৪০:৩১ অপরাহ্ন, সোমবার, ২০ অক্টোবর ২০২৫
- / ৪ জন পড়েছেন
নারায়ণগঞ্জ-৩ (সোনারগাঁ ও সিদ্ধিরগঞ্জ) আসনে মনোনয়ন ঘিরে বিএনপির অভ্যন্তরে চলছে অস্থিরতা, সন্দেহ এবং হিসাব-নিকাশের রাজনীতি। সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিনের সক্রিয় মাঠে ফেরার পর থেকে সোনারগাঁ থানা বিএনপির সভাপতি ও একই আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী আজহারুল ইসলাম মান্নান যেন নিজ রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে কিছুটা নড়বড়ে হয়ে পড়েছেন। তৃণমূলে গিয়াস উদ্দিনের ব্যাপক জনপ্রিয়তা, দীর্ঘ সাংগঠনিক অভিজ্ঞতা এবং সিদ্ধিরগঞ্জে তার প্রভাবের কারণে মান্নান এখন নতুন এক রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মুখোমুখি।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির কেন্দ্রীয় উচ্চপর্যায়ে নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকায় গিয়াস উদ্দিনের নাম আবারও আলোচনায় এসেছে। তিনি শুধু দলের পুরনো এবং অভিজ্ঞ নেতা হিসেবেই নয়, আন্দোলন-সংগ্রামের সময়েও মাঠে ছিলেন বলেই তৃণমূলের মধ্যে তার প্রতি আস্থা তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে আজহারুল ইসলাম মান্নান তুলনামূলকভাবে নতুন মুখ হিসেবে স্থানীয় রাজনীতিতে নিজের অবস্থান সুসংহত করার চেষ্টা করছেন। তবে সাম্প্রতিক বক্তব্য ও আচরণে তিনি যেন ইঙ্গিত দিয়েছেন, মনোনয়ন না পেলে তিনি দলীয় প্রার্থী হিসেবে নয়, স্বতন্ত্র পথেও হাঁটতে প্রস্তুত।
গত শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) সোনারগাঁয়ের জামপুর ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডে এক স্থানীয় কর্মীসভায় আজহারুল ইসলাম মান্নান বলেন, “আমাদের সোনারগাঁয়ে ৩ লক্ষ ৭৫ হাজার ভোট আর সিদ্ধিরগঞ্জে ২ লাখ ২০ হাজার ভোট। আমাদের সোনারগাঁয়ের থেকে যাকে নমিনেশন দেওয়া হোক; যদি সোনারগাঁকে রক্ষা করতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়, তাহলে যারা সোনারগাঁয়ের সাথে বেঈমানী করেছে তারা কি আমাদের সাথে পারবে?” তার এই বক্তব্যেই যেন অঘোষিতভাবে উঠে এসেছে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ইঙ্গিত জানান স্থানীয় নেতা-কর্মীরা।
এই বক্তব্যের পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হয় ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনার ঝড়। ফেসবুকের রাজনৈতিক গ্রুপ ও ব্যক্তিগত আইডি থেকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে মান্নানের বক্তব্যের ভিডিও ও বিশ্লেষণ। নেটিজেনদের একাংশ লিখছেন, “উনার কথায় বোঝা যাচ্ছে, সিদ্ধিরগঞ্জের ভোট তার দরকার নেই। উনি শুধু সোনারগাঁয়ের রাজনীতিকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন।” আরেকজন মন্তব্য করেন, “মান্নান সাহেব মনে হয় বুঝে গেছেন এবার আর নমিনেশন তার হাতে আসবে না, তাই আগেভাগেই স্বতন্ত্র প্রার্থিতার মঞ্চ তৈরি করছেন।” কেউ কেউ আরও তীব্র ভাষায় বলেন, “যিনি নিজের দলের সিদ্ধান্তের আগেই বিদ্রোহের সুর তোলেন, তিনি বিএনপির তৃণমূল ঐক্যের জন্য হুমকি।”
তবে মান্নানপন্থীরা এসব সমালোচনা উড়িয়ে দিয়ে বলছেন, তার বক্তব্য বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। তারা বলছেন, মান্নান কেবল বলতে চেয়েছেন যে সোনারগাঁয়ের ভোটার সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি, তাই সেখানকার জনমতের গুরুত্বও বেশি।
এদিকে তৃণমূল থেকে জানা যায়, সোনারগাঁয়ে আজহারুল ইসলাম মান্নানের জনপ্রিয়তা থাকলেও সিদ্ধিরগঞ্জে তার অবস্থান তুলনামূলক দুর্বল। সোনারগাঁয়ে তার নিজস্ব কর্মী-সমর্থক গোষ্ঠী শক্তিশালী হলেও সিদ্ধিরগঞ্জ থানা বিএনপিতে তিনি এখনো জনভিত্তি তৈরি করতে পারেননি। স্থানীয় নেতারা বলছেন, রাজনীতিতে তিনি বরাবরই সোনারগাঁ-কেন্দ্রিক ছিলেন, ফলে সিদ্ধিরগঞ্জের নেতাকর্মীরা তাকে নিজেদের মানুষ হিসেবে দেখেন না। এ কারণেই কেউ কেউ মনে করছেন, তিনি বাস্তবতা বুঝে আগেভাগেই ‘স্বতন্ত্র’ সুর তুলছেন, যাতে ভবিষ্যতে নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা যায়।
সোনারগাঁ থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি খন্দকার আবু জাফর বলেন, যার নির্বাচনের ক্ষমতা নাই, তাকেই আমি এক সময় উপজেলা চেয়ারম্যান বানাইছিলাম। মানুষের সঙ্গে কিভাবে ব্যবহার করতে হয়, আমরা জানি। কিন্তু অতিরিক্ত অহংকার পতনের মূল। মান্নান মূলত দলে বিভাজন তৈরি করছে। ওরা আসে শুধু দলকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে, ভালো লোক ওদের পাশে থাকে না।
তৃণমূল নেতাদের অনেকে আবু জাফরের বক্তব্যের সঙ্গে একমত প্রকাশ করে বলেন, মান্নানের অতীত রাজনৈতিক অবস্থান খুব একটা শক্তিশালী নয়। তিনি দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে একাধিকবার স্বেচ্ছাচারী মনোভাব দেখিয়েছেন। তাদের দাবি, যদি বিএনপি কেন্দ্র থেকে সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করা হয়, তাহলে গিয়াস উদ্দিনই নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য প্রার্থী হবেন।
অন্যদিকে সোনারগাঁ থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসেন ভিন্ন মত দিয়েছেন। তিনি বলেন, মান্নান সাহেব এমন কোনো বক্তব্য দেননি যা দলের বিপক্ষে যায়। অনেকেই বিষয়টা বিকৃতভাবে উপস্থাপন করছে। তিনি শুধু বলতে চেয়েছেন, সোনারগাঁয়ে ভোটারের সংখ্যা বেশি, তাই এখানকার নেতৃত্ব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা বিশ্বাস করি, তিনি দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যাবেন না।
দলীয় অভ্যন্তরে এখন প্রশ্ন উঠেছে, বিএনপি কীভাবে সামলাবে এই নীরব বিদ্রোহের ইঙ্গিত? কেন্দ্রীয় নেতারা এখনো এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করেননি, তবে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির মধ্যে এ ইস্যুতে যে বিভক্তি তৈরি হয়েছে, তা আর গোপন নেই। বিশেষ করে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে ‘গিয়াস উদ্দিন বনাম মান্নান’ এই দ্বন্দ্ব এখন প্রকাশ্য আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে।
আসন্ন নির্বাচনে বিএনপি যদি সত্যিই ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নামতে চায়, তাহলে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ ও মনোনয়ন-সংক্রান্ত বিরোধ আগে মেটাতে হবে। কারণ, স্বতন্ত্র প্রার্থিতা কিংবা অভ্যন্তরীণ বিভাজন বিএনপির ভোটব্যাংককে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। তারা মনে করেন, এই মুহূর্তে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের উচিত হবে গিয়াস উদ্দিন ও মান্নান উভয় পক্ষকে সমঝোতার মাধ্যমে ঐক্যের রূপরেখা তৈরি করা।
এদিকে স্থানীয় রাজনৈতিক অঙ্গন বলছে, মান্নানের ‘স্বতন্ত্র প্রার্থী’ হওয়ার ইঙ্গিত শুধু সোনারগাঁতেই নয়, পুরো নারায়ণগঞ্জ জেলাজুড়েই আলোচনার ঝড় তুলেছে। অনেকেই বলছেন, এ ধরনের আচরণ বিএনপির জন্য শুভ সংকেত নয়। তবে অন্যরা মনে করেন, এটি নির্বাচনের আগাম চাপ প্রয়োগের একটি কৌশল মাত্র। যাতে কেন্দ্রীয় নেতারা তাকে গুরুত্ব দেন এবং প্রার্থী তালিকায় জায়গা করে নেন।
সবশেষে প্রশ্ন থেকেই যায় মান্নান কি সত্যিই স্বতন্ত্র প্রার্থী হবেন, নাকি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সিদ্ধান্তের প্রতি আনুগত্য দেখাবেন? সময়ই বলবে। তবে আপাতত নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনে বিএনপির রাজনীতিতে ‘বিদ্রোহের ইঙ্গিত মান্নানের’ এই আলোচনাই এখন সবার মুখে মুখে।