ঢাকা ১১:০০ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

নির্বাচন নয়, বাংলাদেশে নৈরাজ্যই কি ভারতের কৌশল?

প্রতিবেদকের নাম :
  • আপডেট সময় : ০৭:১১:৫৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • / ৪৬ জন পড়েছেন
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডা. জাহেদ উর রহমান বলেছেন, ‘শেখ হাসিনার পতন ও দেশত্যাগের পর বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে ভারত একটি স্পষ্ট মনোভাব প্রকাশ করে আসছে। তারা চায় একটি নির্বাচিত সরকার, যাদের সঙ্গে তারা স্বাচ্ছন্দ্যে সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারবে। কিন্তু বাস্তবতা কি সত্যিই এমন? সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অবস্থা এবং বিভিন্ন সংকেত নির্দেশ করে, ভারতের আসল লক্ষ্য হতে পারে নির্বাচনের বদলে দেশের অস্থিতিশীলতা বা নৈরাজ্য তৈরি করা, যা তাদের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে সুবিধাজনক।’

বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) নিজের ইউটিউব চ্যানেলে তিনি এসব কথা বলেন।

ডা. জাহেদ উর রহমান বলেন, ‘শেখ হাসিনার পতন ও দেশত্যাগের পর থেকে আমরা বহুবার ভারতের পক্ষ থেকে শুনেছি তারা বাংলাদেশে একটি নির্বাচন চায়। তাদের বক্তব্যে এটাও পরোক্ষভাবে স্পষ্ট হয়েছে যে তারা একটি নির্বাচিত সরকারের সঙ্গেই সব ধরনের সম্পর্ক ও চুক্তি বজায় রাখতে আগ্রহী। এখন প্রশ্ন হলো, ভারত আসলেই কি বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায়, নাকি তারা শুধু নিজের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের কথা মাথায় রেখেই এমন বক্তব্য দিচ্ছে? এই প্রসঙ্গে আরেকটি ইস্যু হচ্ছে, সম্প্রতি বাংলাদেশে যে পিআরভিত্তিক নির্বাচনীব্যবস্থার দাবি উঠেছে, সেই আন্দোলন আদতে কার স্বার্থ রক্ষা করছে? আরো সরাসরি বললে, এই আন্দোলন কি ভারতের কোনো কৌশলগত উদ্দেশ্য পূরণ করছে?’

তিনি বলেন, ‘ভারত সব সময় বলে এসেছে যে তারা বাংলাদেশের একটি নির্বাচিত সরকার চায়। তাদের এ দাবির পেছনে একটি যুক্তি আছে, যা তারা খোলাখুলিভাবেই উপস্থাপন করে।

তারা বলে, বাংলাদেশের বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারগুলোর ভেতরে একাধিক পাওয়ার সেন্টার রয়েছে। যেমন সরকার নিজে, উপদেষ্টা পরিষদ, সেনাবাহিনী, ছাত্রসংগঠন ইত্যাদি। ফলে ভারতের প্রশ্ন হলো, তারা আসলে কার সঙ্গে কথা বলবে? ভারতের এই যুক্তিটি পুরোপুরি ভিত্তিহীন নয়। বাস্তবেই এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামোর একটি বড় সংকট—সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় একাধিক কেন্দ্র থেকে ক্ষমতা পরিচালিত হয়।
জাহেদ উর রহমান মনে করেন, “শেখ হাসিনার পতন এবং দেশত্যাগের পর প্রথম যে সরকার গঠিত হয়, সেটি মূলত ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার। যদিও ড. ইউনূসকে ঘিরে অনেক বিতর্ক ও সমালোচনা রয়েছে, তার পরও ভারতের সঙ্গে তার অবস্থান ছিল অত্যন্ত দৃঢ় ও সম্মানজনক। তিনি ভারতের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে, চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস দেখিয়েছেন এবং বাংলাদেশের একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে মর্যাদা রক্ষার চেষ্টা করেছেন—এই জায়গায় তার ভূমিকা প্রশংসনীয়। আর সে কারণেই ভারত শেখ হাসিনার মতো একটি ‘স্লেভ-মাইন্ডসেট’ সম্পন্ন সরকার চেয়েছিল। যে সরকার তাদের প্রতি নিঃশর্তভাবে অনুগত থাকবে।

ড. ইউনূসকে নিয়ে ভারত সন্তুষ্ট হতে পারেনি। সে ক্ষেত্রে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত সরকারের সঙ্গে তারা ততটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেনি। এ কারণে এখন একটি নির্বাচিত সরকারই তাদের কাছে ‘মন্দের ভালো’ বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তবে প্রশ্ন হলো, এটিই কি ভারতের জন্য সত্যিকারের ‘সেরা’ বা ‘বেস্ট অপশন’।”তিনি বলেন, “ভারত বরাবরই নির্বাচন নিয়ে একটি নির্দিষ্ট বক্তব্য দিয়ে আসছে। সর্বশেষ ২০ আগস্ট তারা আবারও একই ধরনের বিবৃতি দিয়েছে—তারা বলেছে, ‘ভারত আবারও জানাতে চায় যে, আমাদের প্রত্যাশা হচ্ছে বাংলাদেশের একটি দ্রুত, অবাধ, শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন, যেখানে জনগণ তাদের রায় দিতে পারবে এবং তাদের ইচ্ছা প্রতিফলিত হবে।’ এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন হলো—ভারত আসলে কী চায়? তারা কি সত্যিই বাংলাদেশের একটি স্থায়ী, শক্তিশালী ও স্বয়ংসম্পূর্ণ সরকার চায়? নাকি তারা এমন একটি সরকার চায়, যেটি তাদের স্বার্থে নমনীয় থাকবে? আমি এই জায়গায় এসে ভারতের উদ্দেশ্য নিয়ে একটি সিরিয়াস প্রশ্ন তুলছি।”

জাহেদ উর রহমান মনে করেন, “ভারতের জন্য বাংলাদেশের সবচেয়ে লাভজনক পরিস্থিতি হলো—দেশে একটি নৈরাজ্য তৈরি হোক এবং ভবিষ্যতে একটি দুর্বল, জোটনির্ভর সরকার গঠিত হোক। এমনকি নির্বাচন না হওয়াটাও তাদের জন্য ভালো, কারণ অরাজকতা তৈরি হলে আওয়ামী লীগ, ভারতের এজেন্সি—সবাই মাঠে নামবে, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার মতো ঘটনা ঘটতে পারে, যা ভারতকে ভবিষ্যতে হস্তক্ষেপের সুযোগ দেবে। এই অবস্থায় জনমনে ‘আওয়ামী লীগ দুর্নীতিগ্রস্ত হলেও অন্তত স্থিতিশীলতা দিত’ এমন ভাবনা ফিরে আসতে পারে। ফলে অরাজকতা আসলে আওয়ামী লীগকে ফেরানোর পথ তৈরি করা তাদের জন্য সহজ হবে।”

তিনি বলেন, ‘জামায়াত পিআর নিয়ে যে আন্দোলনে নেমেছে সেটাও ভারতের স্বার্থে যেতে পারে। কারণ পিআর মানেই জোটনির্ভর, অস্থির, দুর্বল সরকার—যেটি ভারতের প্রভাবের কাছে বেশি নমনীয়। নেপালের অভিজ্ঞতা তা-ই বলে। পিআর না হলে নির্বাচনে না যাওয়ার হুমকি আসলে একটি বার্গেনিং টুল। কিন্তু এর ফলে রাজনীতিতে নতুন সংঘাত তৈরি হচ্ছে, যা পুরো পরিবেশকে আরো বিপজ্জনক করে তুলছে।’

ট্যাগ :

সংবাদটি সোস্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন

নির্বাচন নয়, বাংলাদেশে নৈরাজ্যই কি ভারতের কৌশল?

আপডেট সময় : ০৭:১১:৫৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডা. জাহেদ উর রহমান বলেছেন, ‘শেখ হাসিনার পতন ও দেশত্যাগের পর বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে ভারত একটি স্পষ্ট মনোভাব প্রকাশ করে আসছে। তারা চায় একটি নির্বাচিত সরকার, যাদের সঙ্গে তারা স্বাচ্ছন্দ্যে সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারবে। কিন্তু বাস্তবতা কি সত্যিই এমন? সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অবস্থা এবং বিভিন্ন সংকেত নির্দেশ করে, ভারতের আসল লক্ষ্য হতে পারে নির্বাচনের বদলে দেশের অস্থিতিশীলতা বা নৈরাজ্য তৈরি করা, যা তাদের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে সুবিধাজনক।’

বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) নিজের ইউটিউব চ্যানেলে তিনি এসব কথা বলেন।

ডা. জাহেদ উর রহমান বলেন, ‘শেখ হাসিনার পতন ও দেশত্যাগের পর থেকে আমরা বহুবার ভারতের পক্ষ থেকে শুনেছি তারা বাংলাদেশে একটি নির্বাচন চায়। তাদের বক্তব্যে এটাও পরোক্ষভাবে স্পষ্ট হয়েছে যে তারা একটি নির্বাচিত সরকারের সঙ্গেই সব ধরনের সম্পর্ক ও চুক্তি বজায় রাখতে আগ্রহী। এখন প্রশ্ন হলো, ভারত আসলেই কি বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায়, নাকি তারা শুধু নিজের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের কথা মাথায় রেখেই এমন বক্তব্য দিচ্ছে? এই প্রসঙ্গে আরেকটি ইস্যু হচ্ছে, সম্প্রতি বাংলাদেশে যে পিআরভিত্তিক নির্বাচনীব্যবস্থার দাবি উঠেছে, সেই আন্দোলন আদতে কার স্বার্থ রক্ষা করছে? আরো সরাসরি বললে, এই আন্দোলন কি ভারতের কোনো কৌশলগত উদ্দেশ্য পূরণ করছে?’

তিনি বলেন, ‘ভারত সব সময় বলে এসেছে যে তারা বাংলাদেশের একটি নির্বাচিত সরকার চায়। তাদের এ দাবির পেছনে একটি যুক্তি আছে, যা তারা খোলাখুলিভাবেই উপস্থাপন করে।

তারা বলে, বাংলাদেশের বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারগুলোর ভেতরে একাধিক পাওয়ার সেন্টার রয়েছে। যেমন সরকার নিজে, উপদেষ্টা পরিষদ, সেনাবাহিনী, ছাত্রসংগঠন ইত্যাদি। ফলে ভারতের প্রশ্ন হলো, তারা আসলে কার সঙ্গে কথা বলবে? ভারতের এই যুক্তিটি পুরোপুরি ভিত্তিহীন নয়। বাস্তবেই এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামোর একটি বড় সংকট—সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় একাধিক কেন্দ্র থেকে ক্ষমতা পরিচালিত হয়।
জাহেদ উর রহমান মনে করেন, “শেখ হাসিনার পতন এবং দেশত্যাগের পর প্রথম যে সরকার গঠিত হয়, সেটি মূলত ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার। যদিও ড. ইউনূসকে ঘিরে অনেক বিতর্ক ও সমালোচনা রয়েছে, তার পরও ভারতের সঙ্গে তার অবস্থান ছিল অত্যন্ত দৃঢ় ও সম্মানজনক। তিনি ভারতের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে, চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস দেখিয়েছেন এবং বাংলাদেশের একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে মর্যাদা রক্ষার চেষ্টা করেছেন—এই জায়গায় তার ভূমিকা প্রশংসনীয়। আর সে কারণেই ভারত শেখ হাসিনার মতো একটি ‘স্লেভ-মাইন্ডসেট’ সম্পন্ন সরকার চেয়েছিল। যে সরকার তাদের প্রতি নিঃশর্তভাবে অনুগত থাকবে।

ড. ইউনূসকে নিয়ে ভারত সন্তুষ্ট হতে পারেনি। সে ক্ষেত্রে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত সরকারের সঙ্গে তারা ততটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেনি। এ কারণে এখন একটি নির্বাচিত সরকারই তাদের কাছে ‘মন্দের ভালো’ বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তবে প্রশ্ন হলো, এটিই কি ভারতের জন্য সত্যিকারের ‘সেরা’ বা ‘বেস্ট অপশন’।”তিনি বলেন, “ভারত বরাবরই নির্বাচন নিয়ে একটি নির্দিষ্ট বক্তব্য দিয়ে আসছে। সর্বশেষ ২০ আগস্ট তারা আবারও একই ধরনের বিবৃতি দিয়েছে—তারা বলেছে, ‘ভারত আবারও জানাতে চায় যে, আমাদের প্রত্যাশা হচ্ছে বাংলাদেশের একটি দ্রুত, অবাধ, শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন, যেখানে জনগণ তাদের রায় দিতে পারবে এবং তাদের ইচ্ছা প্রতিফলিত হবে।’ এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন হলো—ভারত আসলে কী চায়? তারা কি সত্যিই বাংলাদেশের একটি স্থায়ী, শক্তিশালী ও স্বয়ংসম্পূর্ণ সরকার চায়? নাকি তারা এমন একটি সরকার চায়, যেটি তাদের স্বার্থে নমনীয় থাকবে? আমি এই জায়গায় এসে ভারতের উদ্দেশ্য নিয়ে একটি সিরিয়াস প্রশ্ন তুলছি।”

জাহেদ উর রহমান মনে করেন, “ভারতের জন্য বাংলাদেশের সবচেয়ে লাভজনক পরিস্থিতি হলো—দেশে একটি নৈরাজ্য তৈরি হোক এবং ভবিষ্যতে একটি দুর্বল, জোটনির্ভর সরকার গঠিত হোক। এমনকি নির্বাচন না হওয়াটাও তাদের জন্য ভালো, কারণ অরাজকতা তৈরি হলে আওয়ামী লীগ, ভারতের এজেন্সি—সবাই মাঠে নামবে, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার মতো ঘটনা ঘটতে পারে, যা ভারতকে ভবিষ্যতে হস্তক্ষেপের সুযোগ দেবে। এই অবস্থায় জনমনে ‘আওয়ামী লীগ দুর্নীতিগ্রস্ত হলেও অন্তত স্থিতিশীলতা দিত’ এমন ভাবনা ফিরে আসতে পারে। ফলে অরাজকতা আসলে আওয়ামী লীগকে ফেরানোর পথ তৈরি করা তাদের জন্য সহজ হবে।”

তিনি বলেন, ‘জামায়াত পিআর নিয়ে যে আন্দোলনে নেমেছে সেটাও ভারতের স্বার্থে যেতে পারে। কারণ পিআর মানেই জোটনির্ভর, অস্থির, দুর্বল সরকার—যেটি ভারতের প্রভাবের কাছে বেশি নমনীয়। নেপালের অভিজ্ঞতা তা-ই বলে। পিআর না হলে নির্বাচনে না যাওয়ার হুমকি আসলে একটি বার্গেনিং টুল। কিন্তু এর ফলে রাজনীতিতে নতুন সংঘাত তৈরি হচ্ছে, যা পুরো পরিবেশকে আরো বিপজ্জনক করে তুলছে।’