হাসিনার শাসনকালে যা ঘটেছে, তা সিনেমার কাহিনির মতো
হাসিনার শাসনকালে যা ঘটেছে, তা সিনেমার কাহিনির মতো

- আপডেট সময় : ০৪:২০:৫৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫
- / ৩ জন পড়েছেন
ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের দক্ষিণ এশিয়া ব্যুরোপ্রধান জন রিড বলেন, শেখ হাসিনার শাসনকালে যা ঘটেছে, তার কিছু তো সিনেমার কাহিনির মতো। এ বিষয়ে সে সময়কার শাসকদের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার ডিজিএফআইর সাহায্যে বিভিন্ন ব্যাংক নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার প্রসঙ্গ তুলে ধরা হয়।
বৃহস্পতিবার প্রচারিত ‘বাংলাদেশ’স মিসিং বিলিয়নস, স্টোলেন ইন প্লেইন সাইট’ শিরোনামের তথ্যচিত্রে এফটি বলেছে, প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন ডলার (২ লাখ ৩৪ হাজার ডলার বা ২৮ লাখ ৫৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা) বাংলাদেশ থেকে লুট হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। এই টাকা কীভাবে দেশ থেকে বের করে নেওয়া হয়েছিল এবং তা ফেরত আনা আদৌ সম্ভব কি না, এ নিয়ে ফিন্যান্সিয়াল টাইমস বিক্ষোভকারী, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছে।
এ তথ্যচিত্রে বিভিন্ন তথ্য উপস্থাপন করেছেন এফটির দক্ষিণ এশিয়া ব্যুরো প্রধান জন রিড, অ্যাগ্রিকালচার ও কমোডিটি করেসপনডেন্ট (আগে বাংলাদেশভিত্তিক সাংবাদিক ছিলেন) সুজ্যানা স্যাভিজ, স্পটলাইট অন করাপশনের ডেপুটি ডিরেক্টর হেলেন টেলর এবং ওয়েস্ট মিনস্টার লবি দলের রিপোর্টার রাফে উদ্দিন। তথ্যচিত্রে লন্ডনের হোয়াইট চ্যাপেল স্টেশন দেখিয়ে বলা হয়, স্টেশনটি থেকে বেরোলেই সাইনবোর্ডে লেখা দেখা যায় ‘ওয়েলকাম টু হোয়াইট চ্যাপেল’, কথাটি ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায়ও লেখা।
এতে বোঝা যায়, বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের সম্পর্ক কত পুরোনো। যুক্তরাজ্য এখন নির্বাসনে থাকা না থাকা, নানা প্রান্তের বাংলাদেশি রাজনীতিকদের জন্য জনপ্রিয় গন্তব্যে পরিণত হয়েছে।
শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানা যুক্তরাজ্যের নাগরিক আর শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক লেবার পার্টির এমপি-কিছুদিন আগে পর্যন্ত স্টারমার সরকারের মন্ত্রীও ছিলেন। টিউলিপ সিদ্দিকসহ শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার পরিবারের কয়েকজন সদস্য বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ দুর্নীতির যে তদন্ত করছে, তাতে অবকাঠামো প্রকল্প থেকে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে অভিযুক্ত। দুই পরিবারের কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে ঢাকায় রাষ্ট্রীয় জমি বেআইনি প্রভাব খাটিয়ে দখলের অভিযোগে মামলাও চলছে। এছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে টিউলিপ সিদ্দিককে ঘিরে অনেক প্রশ্ন উঠেছে, এতে তার মন্ত্রিত্বের উপযুক্ততা নিয়ে সংশয় দেখা দেয়।
তথ্যচিত্রে টিউলিপ সিদ্দিকের বিভিন্ন দুর্নীতির তথ্য উল্লেখ করা হয়। যেমন টিউলিপ সিদ্দিককে ঘিরে এফটির তদন্ত ছিল অনেক বড় এক জিগস পাজলের মাত্র একটি টুকরা-যেখানে সাবেক বাংলাদেশি শাসন-ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে যুক্ত শত শত সম্পত্তি খতিয়ে দেখা হয়।
এতে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর কথাও উল্লেখ করা হয়, যিনি যুক্তরাজ্যে ৩০০টির বেশি সম্পত্তির মালিক। যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (এনসিএ) ৩৫০টি সম্পত্তি শনাক্ত করে জব্দ করেছে, যা এফটির খোঁজ পাওয়া ৩০০টির বেশি সম্পত্তির সঙ্গে মিলে যায়। তবে সাইফুজ্জামান চৌধুরী এফটির পাঠানো কোনো প্রশ্নেরই জবাব দেননি।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের দক্ষিণ এশিয়া ব্যুরোপ্রধান জন রিড বলেন, আমরা এমন গল্পও শুনেছি-কিছু ব্যাংক পরিচালককে গোয়েন্দারা অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে যেত, শেয়ার হস্তান্তরের কাগজে সই করিয়ে পদত্যাগে বাধ্য করত আর সেই শেয়ার যেত পুরোনো শাসকদের ঘনিষ্ঠদের হাতে।
তথ্যচিত্রে বলা হয়, ব্যাংক দখলের প্রভাব পরিমাপের একটি ভালো উপায় হলো খেলাপি ঋণের হার দেখা, বিশেষ করে দখলের পর। যেমন ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হার আগেই খুব বেশি ছিল, ইসলামী ব্যাংকের ক্ষেত্রে দখলের পর তা আরও বেড়ে যায়। এতে এস আলম গ্রুপের নামও উল্লেখ করা হয়।
সুজ্যানা স্যাভিজ বলেন, এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল আলমকে বাংলাদেশে ধনকুবের বলা যায়। অন্তর্বর্তী সরকারের অনুমান হচ্ছে, এস আলম ও তার গ্রুপ বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার, এমনকি তার চেয়েও বেশি অর্থ বের করে নিয়েছে। এফটিকে এস আলম গ্রুপ এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ অসত্য বলে জানিয়েছে। এস আলম গ্রুপ আরও দাবি করেছে, বাংলাদেশে তাদের ব্যাংকগুলোর ওপর অন্তর্বর্তী সরকারের আরোপিত বিধিনিষেধের কারণে তারা ক্ষতিগ্রস্ত।
এরপর তথ্যচিত্রে টাকা পাচারের নানা পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হয়। যেমন টাকা বিদেশে যায় মোটামুটি দুভাবে। যেমন ‘ওভার ইনভয়েসিং’ অর্থাৎ আমদানির দামের চেয়ে অনেক বেশি দাম কাগজে দেখিয়ে টাকা পাঠানো; আর ‘আন্ডার ইনভয়েসিং’-বিদেশে রপ্তানির আয় আসার কথা থাকলেও কম দেখিয়ে টাকা ফেরত না আনা। আরেকটি বড় মাধ্যম হচ্ছে অনানুষ্ঠানিক চ্যানেল। অর্থাৎ হুন্ডি, যাকে অন্য জায়গায় হাওলা বলা হয়। এটি বৈধ কাজেও লাগে আবার অবৈধ অর্থ পাচার সাফ করতেও (মানি লন্ডারিং) ব্যবহৃত হতে পারে। অনেক উন্নয়নশীল দেশের মতোই বাংলাদেশের পুঁজি অন্য দেশে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া ব্যক্তিগতভাবে বছরে ১২ হাজার ডলারের বেশি বাইরে নেওয়া যায় না।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ব্যাংক ঋণ মঞ্জুর করলে সবাই নিজের অংশ নিয়ে নেয়, ঋণটি কখনোই ফেরত দেওয়া হয় না। আর এই ঋণের অর্থ পাচার করতে হুন্ডি নেটওয়ার্ক কাজে লাগে। তথ্যচিত্রে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানান, এক হিসাব বলছে-ব্যাংকিং খাত ও ব্যবসায়িক খাত মিলিয়ে মোট ২৩৪ বিলিয়ন ডলার লুটপাট হয়েছে বিভিন্ন উপায়ে-সম্ভবত কোনো দেশের ক্ষেত্রে এটাই সবচেয়ে বড় অর্থ লুণ্ঠন।