জুলাই আন্দোলনে না.গঞ্জের শহীদ আল মামুন আমানত

- আপডেট সময় : ০২:৩২:২০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৯ জুলাই ২০২৫
- / ২৬ জন পড়েছেন
‘আমার স্বামীকে ওরা ইচ্ছে করে হত্যা করেছে। আমি তাদের ফাঁসি চাই।’ বুকফাটা আর্তনাদে এভাবেই স্বামী হত্যার বিচার দাবি করেন ডা. হাসিনা মমতাজ, শহীদ আল মামুন আমানতের স্ত্রী। নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের জালকুড়ি পশ্চিম পাড়ার এই পরিবারে এখন নেমে এসেছে গভীর শোক, বেদনা আর শূন্যতা।
১৯৮৪ সালের ১৭ নভেম্বর কুমিল্লার মুরাদনগরে জন্ম নেন আল মামুন আমানত। অল্প বয়সেই বাবা-মা’কে হারিয়ে বড় হয়েছেন খালার কাছে। জীবনের সংগ্রামে ঘর ছেড়ে চলে আসেন কল-কারখানার শহর নারায়ণগঞ্জে। এখানেই সরকারি তোলারাম কলেজে লেখাপড়া শেষ করে শুরু করেন কাপড়ের ব্যবসা। রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন দীর্ঘদিন; ছিলেন নারায়ণগঞ্জ কলেজ শাখা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। পরে পরিণত বয়সে বিয়ে করেন চিকিৎসক ডা. হাসিনা মমতাজকে। তাঁদের ঘর আলোকিত করে জন্ম নেয় দুই কন্যা আরোহী (৯) এবং আয়রা (২)।
৫ আগস্ট ২০২৪, সরকারবিরোধী আন্দোলনের উত্তাল দিন। সেই দিন বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে বাসা থেকে মোটরসাইকেল নিয়ে বের হন আল মামুন আমানত। শাহবাগে অনুষ্ঠিত শেখ হাসিনার পদত্যাগ দাবিতে বিজয় মিছিলে যোগ দেওয়ার কথা বলে স্ত্রীকে জানান, “রাতে ফিরবো”। কিন্তু আর ফিরে আসেননি তিনি।
এরপর শুরু হয় দিশেহারা খোঁজ। স্ত্রী হাসিনা মমতাজ ছুটে যান এক থানা থেকে আরেক থানায়, হাসপাতাল থেকে মর্গে, পরিচিত-অপরিচিত সকলকে জিজ্ঞেস করতে থাকেন স্বামীর খোঁজে। কোনো উত্তর মেলে না।
তবে এর মধ্যে প্রতারণার শিকার হন তিনি। দুই প্রতারক পরিচয় দেয়। তাদের কাছে আমানতের খবর আছে। এ কথা বলে দুই দফায় ৩৮ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় তারা। এমনকি এক প্রতারক ফেনীর হাইওয়ে পুলিশ পরিচয় দিয়ে আমানতের মোবাইল থেকেই ফোন করে। জানায়, আমানত আহত অবস্থায় ফেনীতে আছেন। সেই বিশ্বাসে পরিবারের সদস্যরা ছুটে যান ফেনীতেও। পরে জানতে পারেন, সেটি সম্পূর্ণ ভুয়া এবং পুলিশ কোনো ফোনই দেয়নি।
১৪ আগস্ট, নিখোঁজের ৯ দিন পর, ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে একটি অজ্ঞাত লাশ সনাক্ত করেন শহীদ আমানতের খালা। কারণ, চেহারা এতটাই বিকৃত ছিল যে স্ত্রী একাধিকবার দেখেও লাশ চিনতে পারেননি।
আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে পরদিন ১৫ আগষ্ট বৃহস্পতিবার রাতে নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়ায় নবাব সলিমউল্লাহ সড়কে আল মামুনের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
জানাজায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক এবং অন্তর্বর্তী সরকারের যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এবং সারজিস আলম অংশ নেন।
এসময় আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘আন্দোলনে নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়া কিংবা যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ এলাকায় মানুষের যে অংশগ্রহণ, জনস্রোত ছিল, তা আমাদের বিজয়ের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। ভাইয়ের শূন্যস্থান পূরণের মতো সামর্থ্য আমাদের কারও নেই। ছাত্র-জনতা নিহতের পরিবারের সাথে আছে।’
জানাজা শেষে শহীদের লাশ নেওয়া হয় কুমিল্লার চান্দিনায় পারিবারিক কবরস্থানে।
শহীদের শরীরে ছিল গুলির চিহ্ন এবং আঘাতের দাগ। ঢামেক হাসপাতালের ভাষ্যমতে, তাকে মৃত অবস্থায়ই ৫ আগস্ট হাসপাতালে রেখে যাওয়া হয়েছিল। স্ত্রী ডা. হাসিনা মমতাজের ভাষ্য অনুযায়ী, তাঁর স্বামীকে গুলি করে এবং পিটিয়ে এমনভাবে জখম করা হয়েছিল যেন কেউ তাকে চিনতে না পারে। মাথায় ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল বলেও তাঁর ধারণা।
তিনি বলেন, “লাশের মুখ পুরো বিকৃত ছিল। খালাই তাঁর হাত, পা এবং মুখের একটি অংশ দেখে চিনে ফেলেন। আমাদের দুই সন্তান। এখন আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াব? সব তো শেষ হয়ে গেল। আমার স্বামীকে তারা ইচ্ছা করে হত্যা করেছে। আমি তাদের ফাঁসি চাই।”
শুধু হত্যাই নয়, পরিবারকে আরও বিপদের মধ্যে ফেলেছে আমানতের মৃত্যু। কারণ, তিনি ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। স্ত্রী চিকিৎসক হলেও মাতৃত্বজনিত কারণে কাজ বন্ধ রেখেছিলেন। ফলে তাঁদের সংসার চলত শুধুই আমানতের আয়ে। এখন দুই ছোট শিশুকে নিয়ে এই পরিবার দাঁড়িয়ে গেছে অনিশ্চয়তার চূড়ায়।
শহীদ আমানতের গ্রামে কিছু আবাদি জমি থাকলেও নিজস্ব ঘর নেই। ফলে নারায়ণগঞ্জেই একটি ভাড়া বাসায় বাস করতেন পরিবার নিয়ে। এখন শহীদ স্ত্রী চিকিৎসা পেশায় ফিরে যাওয়ার মানসিক অবস্থায় নেই। বড় মেয়ে আরোহী দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে, আর আয়রা এখনো দুধের শিশু। বাবার মুখ ভালো করে চিনেও উঠতে পারেনি সে।
হাসিনা মমতাজ বলেন, “আমার মেয়েরা এতিম হয়ে গেল। ওদের কীভাবে আমি মানুষ করবো? কিভাবে ওদের বুকভরা শূন্যতা বোঝাতে পারবো যে ওদের বাবা আর নেই?”
মোহাম্মদ আমানত ফেসবুকে বেশ সক্রিয় ছিলেন। সরকারবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া, শেখ হাসিনার পদত্যাগ দাবি, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমর্থন সবকিছুতেই তাঁর স্পষ্ট অবস্থান ছিল।
৫ আগস্ট সকালে একটি পোস্টে তিনি লেখেন, “পুরো বাংলাদেশ আজ মুক্তির দাবিতে একতাবদ্ধ। এখন তারা মৃত্যুর ভয় ভুলে গেছে। যেকোনো অন্যায়, জুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর চেয়ে গর্বের আর কী হতে পারে। এ আন্দোলনে অংশ নিয়ে স্বৈরাচারমুক্ত করে স্বাধীনতার জন্য কেউ জীবন দিলে সৃষ্টিকর্তা তার প্রতিদান দেবেন।”
এই পোস্টের কয়েক ঘণ্টা পরই নিখোঁজ হন তিনি। এরপর নয়দিন পর পাওয়া যায় লাশ। পরিবারের অভিযোগ, এটি ছিল পূর্বপরিকল্পিত অপহরণ এবং হত্যাকা-। হাসিনা মমতাজ বারবার বলেছেন, “এটা কোনো দুর্ঘটনা নয়। আমার স্বামীকে ইচ্ছে করে হত্যা করা হয়েছে। এটা রাষ্ট্রীয় বাহিনী এবং ছাত্রলীগ ক্যাডারদের কাজ।”
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ শহীদের জানাজায় এসে বলেন, “পার্থিব জগতে আমার ভাইয়ের শূন্যস্থান পূরণের মত সামর্থ্য আমাদের কারো নেই। সৃষ্টিকর্তা যেন তাকে শহীদ হিসেবে কবুল করেন।”