বার্ন ইউনিটে ঘোর কাটছে না স্বজনদের
বার্ন ইউনিটে ঘোর কাটছে না স্বজনদের

- আপডেট সময় : ০৪:৩১:৪২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২২ জুলাই ২০২৫
- / ৩৬ জন পড়েছেন
ছোট্ট জীবন, ছোট্ট দেহ বিধ্বংসী আগুনে পোড়া যন্ত্রণার সঙ্গে লড়তে পারে না। ৮ থেকে ১৩ বছর বয়সি শিশুরা প্রায়ই হেরে যাচ্ছে। চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছে।
মঙ্গলবার বেলা দেড়টা পযর্ন্ত জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। ভর্তি রয়েছে ৪৮ জন। এদের মধ্যে মঙ্গলবার তিন জনকে নতুন করে ভর্তি করা হয়েছে। আইসিইউতে ভর্তি আছে ৫ জন। এদের মধ্যে ৩ জনকে লাইফ সার্পোটে রাখা হয়েছে। পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডে ভর্তি ২০ জন। মোট ভর্তির মধ্যে এখনো অন্তত ২৩ জনের অবস্থা শংকটাপন্ন।
মঙ্গলবার সরেজমিন হাসপাতালটি ঘুরে দেখা গেছে, ওয়ার্ড থেকে আইসিইউ জুড়ে ছোটাছুটি স্বজনদের। স্বজনরা কখনো বারান্দায়, কখনো কাঁচের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে উঁকি দিচ্ছেন, দগ্ধ প্রিয় মানুষটি কেমন আছে দেখার জন্য। সঙ্গে বাড়ছে হা-হুতাশ। হাসপাতাল চত্ত্বর ঘিরে শত শত মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন। কেউ আর্তনাদ করছেন, কেউ রক্ত দিতে ব্যাকুল হয়ে উঠছেন। কেউ কেউ নির্ধারিত বুথে রক্ত দান করছেন। কেউ ভেতরে ঢুকার জন্য প্রাণপন চেষ্টা করছেন। অনেকের আত্মীয়-স্বজনরা দগ্ধ হয়েছেন। কিন্তু, দগ্ধ শিশুদের সুচিকিৎসায় যাতে ইনফেকশন না ছড়ায়, সেজন্য স্বজনদের প্রবেশ সীমিত করে দিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
সোমবার থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত ১০ জন মারা গেছেন। ৮-১৪ বয়সি এসব শিশু-কিশোরদের মধ্যে রয়ছে তানভীর, আফরান, ফায়াজ, এ বি শামীম, সায়ান ইউসুফ, এরিকশন, আরিয়ান ও নাজিম। বাকি দুজন শিক্ষক- মাহরিন চৌধুরী (৪৬) ও মাসুকা (৩৭)।
মঙ্গলবার দুপুর দেড়টা পযর্ন্ত আইসিইউতে ৫ জন ভর্তি রয়েছে। এদের সবাই শংকটাপন্ন। হাসপাতাল বারান্দা জুড়ে স্বজনদের আর্তনাদে পরিবেশ ভারি হয়ে উঠছে। কেউ দুহাতে মুখ ঢেকে বসে রয়েছেন। পানি গড়িয়ে নামছে দুচোখ দিয়ে। কেউ ব্যান্ডেজ করা শিশুকে কোলে নিয়ে কেঁদে চলেছেন অঝোরে। কেউ আর্তনাদ করছেন শিশুর রক্তমাখা ব্যাগ, টিফিন বাক্স আঁকড়ে। কে, কাকে সান্ত্বনা দেবেন? চিকিৎসক নার্স মিডিয়াকর্মী তো বটেই, অচেনা লোকজনও একসঙ্গে এত শিশুর দগ্ধ শরীর দেখে, লাশ দেখে ভরাক্লান্ত, শোকে স্তব্ধ। মঙ্গলবার ভোর থেকে সকালেও শিশুদের মৃতদেহ আগলে হাহাকার চলছিল হাসপাতালে। হাসপাতালে যাওয়ার পরেও অনেকেই কান্না থামিয়ে ফুঁসছিলেন। তাদের ক্ষোভের তীর ছিল জীবন নিরাপত্তার প্রশ্নে। সন্তানরা কি স্কুলেও নিরাপদ নন। ফুল ফোটার আগেই কুঁড়ি ঝরে গেল। কোনো মূল্যেই এই ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয়। যারা এখনো বাঁচার জন্য লড়ছেন, তারা জানে না বাঁচা-মরা কাকে বলে। হাসপাতালের বেডে বেডে সারিবদ্ধ করে রাখা হয়েছে ব্যান্ডেজ ঘেরা শিশুদের। এমন পরিস্থিতিতে ক্ষণে ক্ষণেই দগ্ধ শিশুদের লাশ বের হচ্ছে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট থেকে।
জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের পরিচালক প্রফেসর ডা. নাসির উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, মঙ্গলবারেও সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছেন ২২ থেকে ২৩ জন। এদের মধ্যে ৯-১০ বছরের ফুটফুটে শিশুও রয়েছে। চিকিৎসক থেকে নার্স, হাসপাতালের কর্মী সবাই সর্বোচ্চ চেষ্টায় সেবা দিচ্ছেন। মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। বিশ্বমানের সাপোর্টও দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু, দগ্ধদের অবস্থা এতই ভয়াবহ যে, অনেককেই বাঁচানো সম্ভব হবে না। অনেকেই শতভাগ পোড়া শরীর নিয়ে ভর্তি আছেন। যাদের মধ্যে শিশুর সংখা বেশি।
জাতীয় বার্ন প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে আবাসিক চিকিৎসক শাওন বিন রহমান জানান, সোমবার দিবাগত রাত ২টা ২০ মিনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এ্যারিকসনের মৃত্যু হয়। তার শরীরের ১০০ শতাংশ দগ্ধ ছিল। দিবাগত রাত ২টা ৩০ মিনিটে আয়ানের মৃত্যু হয়, তার শরীরে ৯৫ শতাংশ দগ্ধ । নাজিয়ারও রাতে মৃত্যু হয়, তার শরীরে ৯০ শতাংশ দগ্ধ ছিল। শায়ান ইউসুফের শরীরে ৯৫ শতাংশ দগ্ধ ছিল। ভোর ৫টার দিকে বাপ্পির মৃত্যু হয়েছে, তার শরীরে ৪০ শতাংশ দগ্ধ ছিল। শিক্ষিকা মাসুকারও মৃত্য হয় রাতে, তার শরীর ৮৫ শতাংশ দগ্ধ ছিল।
ইংরেজি ভার্সনের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী মো. মাহতাব রহমান ভূঁইয়া (১৫)। তার শরীরের প্রায় ৭০ শতাংশ পুড়ে গেছে, বর্তমানে আইসিইউতে ভর্তি। মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার রাজামেহার ইউনিয়নের চুলাশ ভূঁইয়া বাড়ির মো. মিনহাজুর রহমান ভূঁইয়া ও নাসরিন আক্তারের একমাত্র ছেলে মাহতাব। তারা ঢাকার উত্তরায় বসবাস করেন। প্রতিদিন মাহতাবকে স্কুলে নিয়ে যেতেন তার বাবা।
বাবা মিনহাজুর রহমান বলেন, আমার একমাত্র ছেলে। নিজেই স্কুলে নিয়ে যেতাম, আনতাম। ছেলেকে যখন স্ট্রেচারে তোলা হচ্ছিল, তখন চিনতেই পারিনি। চিকিৎসকরা বলেছেন তার শরীরের ৭০ শতাংশ পুড়ে গেছে। ঘটনার পর খেকে এখনো জ্ঞান ফেরেনি। আমার একমাত্র ছেলের জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই। মানুষের দোয়ায় আমার ছেলেকে যেন ফিরে পাই। আমার ছেলে যেন আমার বুকে সুস্থ্য হয়ে ফিরে আসেন।
১০ বছরের শিশু নাজিয়ার মৃত্যু হয়েছে সোমবার দিবাগত রাত ৩টায়। শিশুটির লাশ বের করা হয় ভোরে। অপর দিকে তারই ছোট ভাই রাফি এখনো বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন। সোমবার দুজনকেই জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। মঙ্গলবার এ দুই সহোদরের বাবা আশরাফুল ইসলাম নীরবের বন্ধু আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নাজিয়া ও নাফি বাবা-মায়ের সঙ্গে উত্তরার কামারপাড়া এলাকায় থাকত।
এদিকে মঙ্গলবার ভোর থেকে ইনস্টিটিউটে প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। রোগী, আত্মীয় এবং স্টাফ ছাড়া কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। এমনকি সেনাবাহিনীর অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করতে পারছেন না সাংবাদিকও। ইনস্টিটিউটের প্রধান ফটকের সামনে আনসার সদস্য ও প্রবেশমুখে সেনা সদস্যদের কড়া নিরাপত্তায় দেখা গেছে। আহতদের ভিড় এবং জনসমাগম সামাল দিতে বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে প্রবেশে কঠোরতা আরোপ করেছে কর্তৃপক্ষ। ইনস্টিটিউটে প্রবেশ করতে হলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিচয়পত্র দেখাতে হচ্ছে। রোগীর স্বজনদেরও জানাতে হচ্ছে- কার আত্মীয়, রোগীর নাম এবং কোন ওয়ার্ডে আছেন। পরিচয় নিশ্চিত হলেই মিলছে প্রবেশাধিকার।