ঢাকা ০৪:৫৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩০ জুলাই ২০২৫, ১৫ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

আগুনে পুড়ে ছাই শহীদ সোহেলের স্বপ্ন

প্রতিবেদকের নাম :
  • আপডেট সময় : ০২:০৬:৫৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৬ জুলাই ২০২৫
  • / ৭০ জন পড়েছেন

সোহেল আহমদ- একটি নাম, একটি মুখ, একটি স্বপ্ন। জন্মেছিলেন ২০০৩ সালের ১৭ জুন, সিলেট জেলার বিয়ানিবাজার উপজেলার কাকুরা গ্রামের এক গরিব পরিবারে। আট সদস্যের সেই পরিবারে তার অবস্থান ছিল আশার আলো হিসেবে। পিতা তখলিছুর রহমান একজন সৎ বর্গাচাষী, যিনি নিজের জমি না থাকা সত্ত্বেও পরের জমিতে ফসল ফলিয়ে সংসার চালানোর প্রাণপণ চেষ্টা করতেন। মা পারভীন বেগম গৃহিণী। দারিদ্র্য ছিল চিরসঙ্গী, কিন্তু সুখ-শান্তিতে চলছিল জীবন। ঠিক তখনই জন্ম নেয় সোহেলের সংগ্রামী যাত্রা।
ছেলেবেলা থেকেই সোহেল ছিলেন পরিশ্রমী। লেখাপড়ার প্রতি টান থাকলেও জীবনের কঠিন বাস্তবতায় টিকতে পারেননি স্কুলে। পরিবারের আর্থিক চাপে কিশোর বয়সেই টাইলসের কাজ করতে হয় তাকে। শহরে গিয়ে দিনরাত খেটে রোজগার করে ভাইবোনদের পড়াশোনা চালানো, সংসারে কিছুটা সহায়তা করা, এই ছিল তার জীবনের মূল লক্ষ্য। নিজে কষ্ট করে চললেও সোহেলের মধ্যে ছিল দৃঢ় প্রত্যয়। সে তার পরিবারকে দারিদ্র্যতা থেকে মুক্ত করবে।
২০২৪ সালে যখন সারা দেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়, তখন সোহেলও আন্দোলনে কণ্ঠ মিলিয়েছিল। যদিও সে নিয়মিত ছাত্র ছিল না, কিন্তু সে অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান জানাতে পিছপা হয়নি। শিক্ষার অধিকার, ন্যায্যতার দাবিতে যখন সারাদেশ উত্তাল, তখন সেই প্রতিবাদে সাধারণ শ্রমজীবী যুবকরাও পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল ছাত্রদের। সোহেলও তাদের একজন। কিন্তু সেই আন্দোলনই হয়ে ওঠে তার জীবনের সমাপ্তি।
২০২৪ সালের ২০ জুলাই। বিকেল ৪টার দিকে নারায়ণগঞ্জ শহরে সরকার কারফিউ জারি করে। ততক্ষণে শহর উত্তপ্ত, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চরমে। এ সময় বিক্ষোভকারীরা নারায়ণগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসে আগুন ধরিয়ে দেয়। ভয়াবহ সেই অগ্নিকা- ছড়িয়ে পড়ে পুরো ভবনে। ওই সময় ভবনের তৃতীয় তলায় ডাচ-বাংলা ব্যাংকের একটি শাখায় টাইলস লাগানোর কাজ করছিলেন সোহেল আহমদ। ঠিক তখনই ভবনের ৮ম তলায় অবস্থিত পুলিশের ক্যাম্প রক্ষার্থে পুলিশ ভবনের প্রধান গেট বন্ধ করে দেয়, যাতে কেউ ঢুকতে বা বের হতে না পারে।
ভবনের ভেতরে আটকে যায় তিনজন শ্রমিক, যাদের একজন সোহেল। আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, ভবনের বাইরের কেউ কিছু করতে পারছিল না, আর ভেতরের মানুষরা হয়ে পড়ে বন্দী। পুলিশি অবরোধ ভেদ করে কেউ নামতে পারল না নিচে। মুহূর্তের মধ্যে আগুন ভয়াবহ রূপ নেয়। আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায় তিনজন শ্রমিক। তাদের পোড়া দেহ ময়নাতদন্তের জন্য উদ্ধার করা হয়, পরে এক দুঃসহ যাত্রায় সোহেলের মৃতদেহ পৌঁছায় তার গ্রামের বাড়ি কাকুরায়।
গ্রামের মানুষ, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীরা সবাই শোকে স্তব্ধ হয়ে যায়। যে ছেলেটি দিনরাত খেটে নিজের পরিবারটিকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছিল, তার জীবন এমন মর্মান্তিক পরিণতির শিকার হবে—কেউ কল্পনাও করেনি। পরিবার হারালো তাদের একমাত্র ভরসার জায়গা। বাবা তখলিছুর রহমান যেন বাকরুদ্ধ। শুধু বলেন, “সোহেল আমাদের পরিবারের বাতিঘর ছিল। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ত, ভাইবোনদের জন্য নিজেকে বিসর্জন দিয়েছিল। ওর চলে যাওয়া মানে আমাদের সমস্ত স্বপ্নের শেষ।”
সোহেল ছিলেন পরিবারটির মূল অর্থনৈতিক ভরসা। তার উপার্জনে চলে যেত আটজনের খাবার, ভাইবোনদের স্কুল ফি, ওষুধ, জামাকাপড়। এখন সে নেই। বাবা একজন দিনমজুর, যিনি শুধু মৌসুমে কাজ পান। মা অসুস্থ ও গৃহিণী। বাকি ভাইবোনদের অনেকেই এখনো স্কুলে। কিন্তু পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়ার মতো অর্থ তাদের হাতে নেই।
সোহেলের মৃত্যুর পর পরিবারটি চরম দুঃসহ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। মাত্র একটি কাঁচা ঘর—যেখানে এতজনের থাকা দুঃসাধ্য। ভাঙা বেড়া, চুইয়ে পড়া ছাদ আর অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকা ভাইবোনেরা যেন দেশের কাছে একটি প্রশ্ন রেখে দিচ্ছে “সোহেলের ত্যাগ কি শুধুই আগুনে পুড়ে শেষ হয়ে যাবে?”
এই পরিবারটির পাশে দাঁড়ানোর এখনই সময়। সরকার, সমাজ বা সাধারণ মানুষ কেউ যদি একটু সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়, তাহলে হয়ত সোহেলের স্বপ্নের কিছুটা বাস্তবায়ন সম্ভব। একটি নিরাপদ ঘর, বাবার জন্য একটি ছোট ব্যবসা, ভাইবোনদের পড়াশোনার খরচ। এগুলো যদি নিশ্চিত করা যায়, তাহলে অন্তত শহীদের আত্মত্যাগ কিছুটা স্বার্থক হবে।
সোহেলের জীবনের ইতিহাস আমাদের মনে করিয়ে দেয়, এই দেশে এখনো এমন অসংখ্য যুবক আছে যারা নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে পরিবারকে বাঁচাতে চায়, সমাজকে বদলাতে চায়। তাদের মৃত্যুকে শুধু পরিসংখ্যানে সীমাবদ্ধ রাখা নয়, বরং তাদের জীবনের গল্পগুলো তুলে ধরাই আমাদের দায়িত্ব। যেন ভবিষ্যতের কোনো সোহেল আগুনে পুড়ে না মরে, বরং স্বপ্ন পূরণ করে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে।
সোহেল আহমদ শহীদ হয়েছেন, কিন্তু তার স্বপ্ন এখনো জীবিত। এখন সময় সেই স্বপ্নগুলোকে বাস্তবের আলোয় ফিরিয়ে আনার।

ট্যাগ :

সংবাদটি সোস্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন

আগুনে পুড়ে ছাই শহীদ সোহেলের স্বপ্ন

আপডেট সময় : ০২:০৬:৫৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৬ জুলাই ২০২৫

সোহেল আহমদ- একটি নাম, একটি মুখ, একটি স্বপ্ন। জন্মেছিলেন ২০০৩ সালের ১৭ জুন, সিলেট জেলার বিয়ানিবাজার উপজেলার কাকুরা গ্রামের এক গরিব পরিবারে। আট সদস্যের সেই পরিবারে তার অবস্থান ছিল আশার আলো হিসেবে। পিতা তখলিছুর রহমান একজন সৎ বর্গাচাষী, যিনি নিজের জমি না থাকা সত্ত্বেও পরের জমিতে ফসল ফলিয়ে সংসার চালানোর প্রাণপণ চেষ্টা করতেন। মা পারভীন বেগম গৃহিণী। দারিদ্র্য ছিল চিরসঙ্গী, কিন্তু সুখ-শান্তিতে চলছিল জীবন। ঠিক তখনই জন্ম নেয় সোহেলের সংগ্রামী যাত্রা।
ছেলেবেলা থেকেই সোহেল ছিলেন পরিশ্রমী। লেখাপড়ার প্রতি টান থাকলেও জীবনের কঠিন বাস্তবতায় টিকতে পারেননি স্কুলে। পরিবারের আর্থিক চাপে কিশোর বয়সেই টাইলসের কাজ করতে হয় তাকে। শহরে গিয়ে দিনরাত খেটে রোজগার করে ভাইবোনদের পড়াশোনা চালানো, সংসারে কিছুটা সহায়তা করা, এই ছিল তার জীবনের মূল লক্ষ্য। নিজে কষ্ট করে চললেও সোহেলের মধ্যে ছিল দৃঢ় প্রত্যয়। সে তার পরিবারকে দারিদ্র্যতা থেকে মুক্ত করবে।
২০২৪ সালে যখন সারা দেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়, তখন সোহেলও আন্দোলনে কণ্ঠ মিলিয়েছিল। যদিও সে নিয়মিত ছাত্র ছিল না, কিন্তু সে অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান জানাতে পিছপা হয়নি। শিক্ষার অধিকার, ন্যায্যতার দাবিতে যখন সারাদেশ উত্তাল, তখন সেই প্রতিবাদে সাধারণ শ্রমজীবী যুবকরাও পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল ছাত্রদের। সোহেলও তাদের একজন। কিন্তু সেই আন্দোলনই হয়ে ওঠে তার জীবনের সমাপ্তি।
২০২৪ সালের ২০ জুলাই। বিকেল ৪টার দিকে নারায়ণগঞ্জ শহরে সরকার কারফিউ জারি করে। ততক্ষণে শহর উত্তপ্ত, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চরমে। এ সময় বিক্ষোভকারীরা নারায়ণগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসে আগুন ধরিয়ে দেয়। ভয়াবহ সেই অগ্নিকা- ছড়িয়ে পড়ে পুরো ভবনে। ওই সময় ভবনের তৃতীয় তলায় ডাচ-বাংলা ব্যাংকের একটি শাখায় টাইলস লাগানোর কাজ করছিলেন সোহেল আহমদ। ঠিক তখনই ভবনের ৮ম তলায় অবস্থিত পুলিশের ক্যাম্প রক্ষার্থে পুলিশ ভবনের প্রধান গেট বন্ধ করে দেয়, যাতে কেউ ঢুকতে বা বের হতে না পারে।
ভবনের ভেতরে আটকে যায় তিনজন শ্রমিক, যাদের একজন সোহেল। আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, ভবনের বাইরের কেউ কিছু করতে পারছিল না, আর ভেতরের মানুষরা হয়ে পড়ে বন্দী। পুলিশি অবরোধ ভেদ করে কেউ নামতে পারল না নিচে। মুহূর্তের মধ্যে আগুন ভয়াবহ রূপ নেয়। আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায় তিনজন শ্রমিক। তাদের পোড়া দেহ ময়নাতদন্তের জন্য উদ্ধার করা হয়, পরে এক দুঃসহ যাত্রায় সোহেলের মৃতদেহ পৌঁছায় তার গ্রামের বাড়ি কাকুরায়।
গ্রামের মানুষ, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীরা সবাই শোকে স্তব্ধ হয়ে যায়। যে ছেলেটি দিনরাত খেটে নিজের পরিবারটিকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছিল, তার জীবন এমন মর্মান্তিক পরিণতির শিকার হবে—কেউ কল্পনাও করেনি। পরিবার হারালো তাদের একমাত্র ভরসার জায়গা। বাবা তখলিছুর রহমান যেন বাকরুদ্ধ। শুধু বলেন, “সোহেল আমাদের পরিবারের বাতিঘর ছিল। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ত, ভাইবোনদের জন্য নিজেকে বিসর্জন দিয়েছিল। ওর চলে যাওয়া মানে আমাদের সমস্ত স্বপ্নের শেষ।”
সোহেল ছিলেন পরিবারটির মূল অর্থনৈতিক ভরসা। তার উপার্জনে চলে যেত আটজনের খাবার, ভাইবোনদের স্কুল ফি, ওষুধ, জামাকাপড়। এখন সে নেই। বাবা একজন দিনমজুর, যিনি শুধু মৌসুমে কাজ পান। মা অসুস্থ ও গৃহিণী। বাকি ভাইবোনদের অনেকেই এখনো স্কুলে। কিন্তু পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়ার মতো অর্থ তাদের হাতে নেই।
সোহেলের মৃত্যুর পর পরিবারটি চরম দুঃসহ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। মাত্র একটি কাঁচা ঘর—যেখানে এতজনের থাকা দুঃসাধ্য। ভাঙা বেড়া, চুইয়ে পড়া ছাদ আর অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকা ভাইবোনেরা যেন দেশের কাছে একটি প্রশ্ন রেখে দিচ্ছে “সোহেলের ত্যাগ কি শুধুই আগুনে পুড়ে শেষ হয়ে যাবে?”
এই পরিবারটির পাশে দাঁড়ানোর এখনই সময়। সরকার, সমাজ বা সাধারণ মানুষ কেউ যদি একটু সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়, তাহলে হয়ত সোহেলের স্বপ্নের কিছুটা বাস্তবায়ন সম্ভব। একটি নিরাপদ ঘর, বাবার জন্য একটি ছোট ব্যবসা, ভাইবোনদের পড়াশোনার খরচ। এগুলো যদি নিশ্চিত করা যায়, তাহলে অন্তত শহীদের আত্মত্যাগ কিছুটা স্বার্থক হবে।
সোহেলের জীবনের ইতিহাস আমাদের মনে করিয়ে দেয়, এই দেশে এখনো এমন অসংখ্য যুবক আছে যারা নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে পরিবারকে বাঁচাতে চায়, সমাজকে বদলাতে চায়। তাদের মৃত্যুকে শুধু পরিসংখ্যানে সীমাবদ্ধ রাখা নয়, বরং তাদের জীবনের গল্পগুলো তুলে ধরাই আমাদের দায়িত্ব। যেন ভবিষ্যতের কোনো সোহেল আগুনে পুড়ে না মরে, বরং স্বপ্ন পূরণ করে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে।
সোহেল আহমদ শহীদ হয়েছেন, কিন্তু তার স্বপ্ন এখনো জীবিত। এখন সময় সেই স্বপ্নগুলোকে বাস্তবের আলোয় ফিরিয়ে আনার।