আবু সাঈদের কবর দেখে, আমাদের কবর দেখেনা

- আপডেট সময় : ০৩:০৫:০৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৪ জুলাই ২০২৫
- / ৭৬ জন পড়েছেন
২৪ বছরের তরুণ আলেম মাবরুর হুসাইন ছিলেন এক আদর্শিক, মেধাবী ও হৃদয়বান তরুণ। কেবল একজন আলেম হিসেবেই নয়, একজন সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবেও তিনি ছিলেন জনপ্রিয়। ইসলামী সংগীত পরিবেশন করতেন, যার কিছু এখনও ইউটিউবে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ভক্ত হৃদয়ে আলো ছড়াচ্ছে। যিনি ছিলেন নৈতিকতা, দেশপ্রেম ও দীনদারির এক পরিপূর্ণ প্রতিচ্ছবি। অথচ সেই উজ্জ্বল তরুণকেই আজ মানুষ স্মরণ করে “শহীদ মাবরুর হুসাইন” নামে।
শহীদের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের কুতুবপুর ইউনিয়নের পূর্ব শিয়াচর গ্রামে। বাবা একজন ব্যবসায়ী, মা গৃহিণী। বংশের একমাত্র ছেলে সন্তান ছিলেন তিনি মাবরুর। পরিবারের চোখের মণি। স্বচ্ছল পরিবারটি গড়ে তুলেছিল এক স্বপ্নরাজ্য সন্তানকে আলেমে দ্বীন বানিয়ে মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত করবে। সেই স্বপ্ন বাস্তবতাও হয়ে উঠছিল। কিন্তু ২০২৪ সালের ঐতিহাসিক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রক্তাক্ত পটভূমিতে সেই স্বপ্ন খান খান হয়ে যায়।
গত বছরের ২০ জুলাই, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে দমন করতে দেশে কারফিউ জারি করে তৎকালীন স্বৈরাচারী সরকার। কিন্তু প্রতিবাদ থামেনি। প্রতিদিনই চলছিল ছাত্র-জনতার মিছিল। একের পর এক শহীদের রক্তে সয়লাব হচ্ছিল দেশের রাজপথ। সেই আন্দোলনের এক গৌরবময় দিন, ৫ আগষ্ট ২০২৪, দুপুর ১২টা। ভুইগর এলাকার সিকদার পাম্পের সামনে অন্যান্য ছাত্রদের সাথে উপস্থিত হন মাবরুর। তখনো মাথার ওপর চক্কর কাটছিল রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হেলিকপ্টার। হঠাৎ করেই সেই হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছোঁড়া হয়। একটি গুলি এসে তাঁর ডান পাশের পাঁজর ভেদ করে বেরিয়ে যায়। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান মাবরুর। দেশের জন্য রক্ত দিয়ে অমর হয়ে যান তিনি।
শহীদ মাবরুরের মা শাহনাজ বেগম কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলেন, “আমার ছেলে দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে। সন্তান হারানোর ব্যথা কী, সেটা মা-বাবা ছাড়া কেউ বুঝবে না। আমার বাবা পুলিশের গুলিতে মারা গেছে। এখন পুলিশ দেখলেই ভয় লাগে।” এই একটি উক্তিই বলে দেয়, কী রকম ভয়াবহ এবং দীর্ঘকালীন শোক বহন করছে এই পরিবার। একদিকে পিতৃহীন হওয়ার ক্ষত, আরেকদিকে সন্তান হারানোর যন্ত্রণায় যেন বারবার কুরবান হচ্ছেন শহীদের মা।
এই রক্তাক্ত বাস্তবতা কেবল একটি ঘটনার নয়, বরং একটি জাগরণের প্রতীক হয়ে উঠেছে। শহীদ মাবরুর হোসেন রাব্বির নামে যাঁকে পরিবার-প্রতিবেশীরা চিনতেন, তিনি ছিলেন পরিবারের এবং বংশের একমাত্র সন্তান। তাঁর জন্মের পর খুশিতে মা (শহীদের মা) একটানা তিন মাস নফল রোজা রেখেছিলেন। সেই খুশির সন্তান একদিন তাঁদের বুক খালি করে দিয়ে গেলেন। মায়ের বুকফাটা কান্নায় কেঁপে ওঠে প্রতিবেশীরাও।
এই বছরের কোরবানির ঈদেও সেই শোক আরও তীব্র হয়ে ধরা দেয়। যখন প্রতিবেশীরা জানান—“আমরা রাব্বির পক্ষ থেকে কুরবানী দিচ্ছি” তখন মা শাহনাজ বেগম কান্নায় ভেঙে পড়েন। স্মরণ করে বলেন, “রাব্বি গত বছর থেকে আয় শুরু করছিল। কোরবানির সময় আমাকে বলছিল, ‘মা! আগামী বছর নিজের নামেই কুরবানী দিবো ইনশাআল্লাহ।’” সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হলো বটে, তবে মর্মান্তিকভাবে। মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “কোরবানি ছেলের নামে ঠিকই হইতাছে, কিন্তু ছেলেই তো কুরবান হয়ে গেলোৃ”
এমন একটি বাস্তবতায় আমরা মুখোমুখি হই এক গভীর প্রশ্নের, একটি রাষ্ট্র কেন নিজের সন্তানদের হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে হত্যা করে? কেন শান্তিপূর্ণ ছাত্র আন্দোলনে এমন ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা বরদাস্ত করা হয়? মাবরুর হুসাইন তো কোন অস্ত্রধারী জঙ্গি ছিল না, ছিল একজন মেধাবী, ধার্মিক, দায়িত্ববান যুবক। যিনি শুধু দীনকে ভালোবাসতেন, সংস্কৃতিকে ভালোবাসতেন, দেশকে ভালোবাসতেন।
শহীদের মৃত্যুর পর তাঁর এলাকাজুড়ে নেমে আসে শোকের ছায়া। সহপাঠী, বন্ধু, প্রতিবেশী, মসজিদের মুসল্লি সবাই চোখের জল ফেলেছে। তাঁর ইউটিউব চ্যানেল ঘুরে অনেকেই বলেন, “এই ছেলেটা কি কাউকে আঘাত করতে পারতো? তার কণ্ঠে ছিল শুধু মধুরতা, হৃদয়ের আহ্বান।” অথচ সেই কণ্ঠ আর নেই। সেই মধুর হৃদয় ভেদ করেছে রাষ্ট্রের রাইফেলের গুলি।
কিন্তু শহীদ মাবরুর হুসাইন কি হারিয়ে গেছেন? না, তিনি বেঁচে আছেন তাঁর সংগীতে, তাঁর মা-বাবার চোখের জলে, তাঁর বন্ধুবান্ধবের গর্বে, আর সবচেয়ে বেশি, ইতিহাসের পাতায়। তাঁকে নিয়ে ভবিষ্যতে লেখা হবে কবিতা, নাটক, প্রতিবাদ সংগীত। শহীদদের মিছিল থেমে থাকে না। শহীদ মাবরুর হুসাইন সেই চিরকালীন মিছিলে আজ অগ্রভাগে। তিনি প্রমাণ করেছেন, আদর্শকে ভালোবাসা মানে শুধু কথা নয়, প্রয়োজনে প্রাণ দিতেও পিছপা হওয়া নয়।
মাবরুরের বাবা আজ নিরবে তাকিয়ে থাকেন ছেলের ফাঁকা বিছানার দিকে। মা দোয়ার ভেতর খুঁজে ফেরেন তাঁর প্রিয় সন্তানের মুখ। বাড়ির উঠোনের প্রতিটি ধূলিকণায় যেন মিশে আছে রাব্বির পায়ের শব্দ। তাদের চোখে জল থাকলেও হৃদয়ে আছে গর্ব। তাঁরা জানেন, তাঁদের ছেলে কেবল তাঁদেরই ছিল না, সে ছিল পুরো জাতির সন্তান। যে জাতির মেরুদ- ভেঙে ফেলা হয়েছিল, তাকে জাগিয়ে তুলতে যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন, শহীদ মাবরুর হুসাইন তাঁদের একজন।
মাবরুরের মা আক্ষেপ করে বলেন, আমার মাবরুরকে আবু সাঈদের মতো করেই তো মেরেছে। আওয়ামী পুলিশবাহিনী টেনে হিঁচড়ে নিয়ে অমানুষিক ভাবে মেরেছে। সরকার আবু সাঈদের কবর দেখে, কই আমাদের কবর তো দেখেনা।
শহীদের রক্ত কখনো বৃথা যায় না। ইতিহাস বলে, এই রক্তই একদিন পরিবর্তনের বীজ বোনে। হয়তো কোনো এক ভবিষ্যতের ঈদে, কোনো এক সকালবেলায় শহীদ মাবরুর হুসাইনের মা আবারো বলবেন “আমার ছেলে নিজের নামে কোরবানি দিয়েছিল, কিন্তু সে নিজেই কোরবানি হয়ে গিয়ে আমাদের সত্যিকারের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে।”
আজ তাই শুধু শোক নয়, এই প্রতিবেদন হয়ে উঠুক একটি প্রতিজ্ঞার দলিল আর কোনো মাবরুর যেন হেলিকপ্টারের গুলিতে প্রাণ না হারায়। আর কোনো মা যেন বলতে না বাধ্য হন “ছেলেই তো কুরবান হয়ে গেলোৃ”