ঢাকা ০৪:০৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ০১ অগাস্ট ২০২৫, ১৭ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :

জুলাইয় শহীদ মিনারুলের ‘মৃত্যুসনদে’ সড়ক দুর্ঘটনা

আল আমীন মাহমুদ অর্ণব
  • আপডেট সময় : ০৩:৪৬:২৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১১ জুলাই ২০২৫
  • / ৬১ জন পড়েছেন

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শাটডাউন কর্মসূচির দিন নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে পুলিশের সহায়তায় বিজিবির গুলিতে নিহত হন পোশাক শ্রমিক মিনারুল ইসলাম (২৭)। ঘটনার পরদিন রাজশাহী নগরীর গুড়িপাড়া-পুরাপাড়া মহল্লায় নিজ বাড়িতে পৌঁছালে পরিবারকে চাপ দিয়ে তার মৃত্যুর কারণ গোপন করতে বাধ্য করা হয়। তখনকার ১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রজব আলী স্পষ্ট ভাষায় পরিবারকে বলেন—মিনারুল গুলিতে মারা গেছে, এমনটা বলা যাবে না। সড়ক দুর্ঘটনার কথা বলে দাফন করতে হবে। বাধ্য হয়ে মৃত্যুসনদেও ‘সড়ক দুর্ঘটনা’ লেখা হয়।
আতঙ্কে, চাপের মুখে শহীদের পরিবারের কেউ তখন প্রতিবাদ করতে পারেননি। মিনারুলের ভাই নাজমুল হক জানান, তারা কিছু বলতে পারেননি, কারণ চারপাশে তখন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা ছিল এবং প্রতিরোধ করলে লাশ দাফন করাও কঠিন হয়ে যেত। কাউন্সিলরের ভাই, রাজশাহী মহানগর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নাহিদ আক্তার নাহান পরিবারকে হুমকি দেন যাতে গুলির কথা না বলা হয়।
২০২৪ সালের ২০ জুলাই, চলছিলো কারফিউ। বিকেলে সিদ্ধিরগঞ্জের আদমজী রোডের আল আমিন নগর এলাকায় আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ ও বিজিবি এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। ওই সময় ঘরে খাওয়ার কিছু না থাকায় বাজারে বাধ্য হয়ে যেতে হয় মিনারুলকে। যাওয়ার পথে মিনারুল গুলিবিদ্ধ হন। মিনারুল সেখানেই ঢলে পরে। আহত অবস্থায় তাকে নারায়ণগঞ্জের খানপুর ৩০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
পরদিন রাজশাহীতে লাশ পৌঁছানোর পর স্থানীয় বাসিন্দা রেজাউল ইসলাম লাশ গোসল করান। তিনি বলেন, মিনারুলের শরীরে কোনো কাটা-ছেঁড়ার দাগ ছিল না, ছিল কেবল তলপেটে গভীর ক্ষত, যা ছিল একটি গুলির চিহ্ন। মিনারুলের ভাই সোহেল একটি ভিডিও ফুটেজ দেখান যেখানে স্পষ্টভাবে দেখা যায়, তার তলপেটে ব্যান্ডেজ খোলা হলে এক ইঞ্চির মতো গুলির ক্ষত রয়েছে। এলাকাবাসীর ভাষ্যও ছিল একই রকম, তিনি সড়ক দুর্ঘটনায় নয়, গুলিতেই নিহত হয়েছেন।
মিনারুল ইসলাম ছিলেন নারায়ণগঞ্জের একটি পোশাক কারখানার সিনিয়র অপারেটর। তিনি রাজশাহীর গুড়িপাড়া-পুরাপাড়ার বাসিন্দা। দুই ভাই রিকশাচালক, বাবা আগেই মারা গেছেন। মৃত্যুর সময় তার স্ত্রী শম্পা খাতুন ছিলেন ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। স্বামী হারানোর এক মাস পর তিনি একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। সন্তানের নাম রাখা হয় বাবার নামের সাথে মিলিয়ে মিনহাজুল ইসলাম। এখন তার বয়স ১১ মাস।
ঘটনার সময় কেউ প্রকাশ্যে কিছু বলতে না পারলেও সরকার পতনের পর সাহস ফিরে পায় পরিবার। মিনারুলের ভাই নাজমুল হক গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক এমপি শামিম ওসমান, নজরুল ইসলাম বাবু, গোলাম দস্তগীর গাজী, আব্দুল্লাহ আল কায়সার, সাবেক মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীসহ ১৩০ জনকে আসামি করা হয়। মামলায় কাউন্সিলর রজব আলী, তার ভাই নাহান ও স্থানীয় যুবলীগ নেতা জাকির হোসেনের নামও রয়েছে।
এজাহারে বলা হয়, ২০ জুলাই সিদ্ধিরগঞ্জের আল আমিন নগরে আন্দোলনকারীদের ওপর সরাসরি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা চালানো হয়। এ সময় মিনারুল ইসলাম তলপেটে গুলিবিদ্ধ হন এবং খানপুর হাসপাতালে নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়।
সরকার পতনের পর জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে মিনারুল ইসলামকে শহীদ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তার পরিবারকে দেওয়া হয় পাঁচ লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা এর মধ্যে চার লাখ পেয়েছেন স্ত্রী শম্পা খাতুন এবং এক লাখ তার মা ডলি বেগম।
আওয়ামী লীগের পতনের পর পালিয়ে যান রাজশাহী মহানগর যুবলীগ নেতা নাহান। ৭ আগস্ট চুয়াডাঙ্গার দর্শনা সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালানোর সময় বিজিবির হাতে গ্রেফতার হন কাউন্সিলর রজব আলী।
এদিকে, এখনও মিনারুলের মৃত্যুসনদে লেখা রয়েছে ‘সড়ক দুর্ঘটনা’। তারা বলছে, একজন শহীদকে নিয়ে এমন জঘন্য মিথ্যাচার শুধু শহীদের অসম্মানই নয়, দেশের ইতিহাসকেই বিকৃত করার চেষ্টা।
মিনারুলের স্ত্রী বলেন, সন্তান বাবার মুখ দেখতে পায়নি। এখন যখন বড় হবে, কীভাবে তাকে বলা হবে—তোমার বাবা গুলিতে শহীদ হয়েছেন, অথচ কাগজে লেখা আছে সড়ক দুর্ঘটনা!
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ বলছেন, যারা মৃত্যুর সত্য আড়াল করেছে, তারা এখন ইতিহাসের কাঠগড়ায়। নতুন সরকারকে এই মিথ্যাচার সংশোধন ও বিচার কার্যক্রম নিশ্চিত করার আহ্বান জানাচ্ছে তার পরিবার।
এখন পর্যন্ত মামলাটি তদন্তাধীন রয়েছে। নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার জানিয়েছেন, সময় লাগলেও সঠিক তদন্তের মাধ্যমে সত্য বেরিয়ে আসবে।
শহীদ মিনারুল ইসলামের মৃত্যু এখন শুধু একটি পরিবারের নয়, পুরো জাতির সামনে জবাবদিহির প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। একজন সাধারণ পোশাক শ্রমিক, যে গুলি খেয়ে প্রাণ দিয়েছে, তার মৃত্যুও যদি চাপা দেওয়া হয়, তবে স্বাধীনতার অর্থ কী?

ট্যাগ :

সংবাদটি সোস্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন

জুলাইয় শহীদ মিনারুলের ‘মৃত্যুসনদে’ সড়ক দুর্ঘটনা

আপডেট সময় : ০৩:৪৬:২৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১১ জুলাই ২০২৫

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শাটডাউন কর্মসূচির দিন নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে পুলিশের সহায়তায় বিজিবির গুলিতে নিহত হন পোশাক শ্রমিক মিনারুল ইসলাম (২৭)। ঘটনার পরদিন রাজশাহী নগরীর গুড়িপাড়া-পুরাপাড়া মহল্লায় নিজ বাড়িতে পৌঁছালে পরিবারকে চাপ দিয়ে তার মৃত্যুর কারণ গোপন করতে বাধ্য করা হয়। তখনকার ১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রজব আলী স্পষ্ট ভাষায় পরিবারকে বলেন—মিনারুল গুলিতে মারা গেছে, এমনটা বলা যাবে না। সড়ক দুর্ঘটনার কথা বলে দাফন করতে হবে। বাধ্য হয়ে মৃত্যুসনদেও ‘সড়ক দুর্ঘটনা’ লেখা হয়।
আতঙ্কে, চাপের মুখে শহীদের পরিবারের কেউ তখন প্রতিবাদ করতে পারেননি। মিনারুলের ভাই নাজমুল হক জানান, তারা কিছু বলতে পারেননি, কারণ চারপাশে তখন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা ছিল এবং প্রতিরোধ করলে লাশ দাফন করাও কঠিন হয়ে যেত। কাউন্সিলরের ভাই, রাজশাহী মহানগর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নাহিদ আক্তার নাহান পরিবারকে হুমকি দেন যাতে গুলির কথা না বলা হয়।
২০২৪ সালের ২০ জুলাই, চলছিলো কারফিউ। বিকেলে সিদ্ধিরগঞ্জের আদমজী রোডের আল আমিন নগর এলাকায় আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ ও বিজিবি এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। ওই সময় ঘরে খাওয়ার কিছু না থাকায় বাজারে বাধ্য হয়ে যেতে হয় মিনারুলকে। যাওয়ার পথে মিনারুল গুলিবিদ্ধ হন। মিনারুল সেখানেই ঢলে পরে। আহত অবস্থায় তাকে নারায়ণগঞ্জের খানপুর ৩০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
পরদিন রাজশাহীতে লাশ পৌঁছানোর পর স্থানীয় বাসিন্দা রেজাউল ইসলাম লাশ গোসল করান। তিনি বলেন, মিনারুলের শরীরে কোনো কাটা-ছেঁড়ার দাগ ছিল না, ছিল কেবল তলপেটে গভীর ক্ষত, যা ছিল একটি গুলির চিহ্ন। মিনারুলের ভাই সোহেল একটি ভিডিও ফুটেজ দেখান যেখানে স্পষ্টভাবে দেখা যায়, তার তলপেটে ব্যান্ডেজ খোলা হলে এক ইঞ্চির মতো গুলির ক্ষত রয়েছে। এলাকাবাসীর ভাষ্যও ছিল একই রকম, তিনি সড়ক দুর্ঘটনায় নয়, গুলিতেই নিহত হয়েছেন।
মিনারুল ইসলাম ছিলেন নারায়ণগঞ্জের একটি পোশাক কারখানার সিনিয়র অপারেটর। তিনি রাজশাহীর গুড়িপাড়া-পুরাপাড়ার বাসিন্দা। দুই ভাই রিকশাচালক, বাবা আগেই মারা গেছেন। মৃত্যুর সময় তার স্ত্রী শম্পা খাতুন ছিলেন ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। স্বামী হারানোর এক মাস পর তিনি একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। সন্তানের নাম রাখা হয় বাবার নামের সাথে মিলিয়ে মিনহাজুল ইসলাম। এখন তার বয়স ১১ মাস।
ঘটনার সময় কেউ প্রকাশ্যে কিছু বলতে না পারলেও সরকার পতনের পর সাহস ফিরে পায় পরিবার। মিনারুলের ভাই নাজমুল হক গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক এমপি শামিম ওসমান, নজরুল ইসলাম বাবু, গোলাম দস্তগীর গাজী, আব্দুল্লাহ আল কায়সার, সাবেক মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীসহ ১৩০ জনকে আসামি করা হয়। মামলায় কাউন্সিলর রজব আলী, তার ভাই নাহান ও স্থানীয় যুবলীগ নেতা জাকির হোসেনের নামও রয়েছে।
এজাহারে বলা হয়, ২০ জুলাই সিদ্ধিরগঞ্জের আল আমিন নগরে আন্দোলনকারীদের ওপর সরাসরি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা চালানো হয়। এ সময় মিনারুল ইসলাম তলপেটে গুলিবিদ্ধ হন এবং খানপুর হাসপাতালে নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়।
সরকার পতনের পর জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে মিনারুল ইসলামকে শহীদ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তার পরিবারকে দেওয়া হয় পাঁচ লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা এর মধ্যে চার লাখ পেয়েছেন স্ত্রী শম্পা খাতুন এবং এক লাখ তার মা ডলি বেগম।
আওয়ামী লীগের পতনের পর পালিয়ে যান রাজশাহী মহানগর যুবলীগ নেতা নাহান। ৭ আগস্ট চুয়াডাঙ্গার দর্শনা সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালানোর সময় বিজিবির হাতে গ্রেফতার হন কাউন্সিলর রজব আলী।
এদিকে, এখনও মিনারুলের মৃত্যুসনদে লেখা রয়েছে ‘সড়ক দুর্ঘটনা’। তারা বলছে, একজন শহীদকে নিয়ে এমন জঘন্য মিথ্যাচার শুধু শহীদের অসম্মানই নয়, দেশের ইতিহাসকেই বিকৃত করার চেষ্টা।
মিনারুলের স্ত্রী বলেন, সন্তান বাবার মুখ দেখতে পায়নি। এখন যখন বড় হবে, কীভাবে তাকে বলা হবে—তোমার বাবা গুলিতে শহীদ হয়েছেন, অথচ কাগজে লেখা আছে সড়ক দুর্ঘটনা!
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ বলছেন, যারা মৃত্যুর সত্য আড়াল করেছে, তারা এখন ইতিহাসের কাঠগড়ায়। নতুন সরকারকে এই মিথ্যাচার সংশোধন ও বিচার কার্যক্রম নিশ্চিত করার আহ্বান জানাচ্ছে তার পরিবার।
এখন পর্যন্ত মামলাটি তদন্তাধীন রয়েছে। নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার জানিয়েছেন, সময় লাগলেও সঠিক তদন্তের মাধ্যমে সত্য বেরিয়ে আসবে।
শহীদ মিনারুল ইসলামের মৃত্যু এখন শুধু একটি পরিবারের নয়, পুরো জাতির সামনে জবাবদিহির প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। একজন সাধারণ পোশাক শ্রমিক, যে গুলি খেয়ে প্রাণ দিয়েছে, তার মৃত্যুও যদি চাপা দেওয়া হয়, তবে স্বাধীনতার অর্থ কী?