ঢাকা ০৯:৫৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই ২০২৫, ১৬ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :

হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলিতে শহীদ আহসান

অর্ণব আল আমীন
  • আপডেট সময় : ০৬:০৬:৫৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ৯ জুলাই ২০২৫
  • / ৭৩ জন পড়েছেন

২১ জুলাই ২০২৪। ঢাকার আকাশে হেলিকপ্টারের গর্জন, নিচে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ, পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া আর একটার পর একটা গুলির শব্দ। এমন এক আতঙ্কের দিনে মা খালেদা কবির বারবার অনুরোধ করেছিলেন ছেলেকে“বাবা, তুই বাইরে যাইস না। কেউ বের হবি না।”
কিন্তু মায়ের নিষেধ অমান্য করেই মেধাবী তরুণ আহসান কবীর শরীফ বেরিয়ে যান আন্দোলনের মাঠে। শরীফের ভাষায়, এই আন্দোলন ছিল “ভবিষ্যতের প্রজন্মের জন্য একটা ন্যায্যতার দাবি।” কিন্তু ওই দিন তিনি আর ফিরলেন না। ফিরলো তাঁর নিথর দেহ।
শরীফ ছিলেন ঢাকার ডেমরা থানার দক্ষিণ সানারপাড় এলাকার বাসিন্দা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইক্রোবায়োলজিতে মাস্টার্স শেষে একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করতেন। বয়স হয়েছিল ৩৩ বছর। তাঁর বাবা মোঃ হুমায়ুন কবির অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, মা খালেদা কবির একজন অসুস্থ গৃহিণী, হাঁটুতে অপারেশন হওয়া সত্ত্বেও লাঠিতে ভর করে কোনোমতে চলেন। শরীফের বড় ভাই মাহবুব প্রবাসী, বোন রোকেয়া মিরপুরে থাকেন। ছোট ভাতিজি সারাহ সারাদিন চাচার সাথেই সময় কাটাতো।
২১ জুলাই দুপুর তিনটার দিকে শরীফ সাইনবোর্ড এলাকায় আন্দোলনের ছবি তুলছিলেন। হঠাৎ মাথার উপর হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছোড়া হয়। একটি গুলি তার বুকের মাঝ বরাবর ঢুকে পেছন দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান।
খবর পেয়ে পিতা হুমায়ুন কবির ছুটে যান। গলিতে পড়ে থাকা ছেলের নিথর দেহ নিজে চোখে দেখে ভেঙে পড়েন। বলেন, “গিয়া দেখি পোলার নিথর দেহটা পইড়া আছে। একটাও গাড়ি নাই। পরে এক সবজি ওয়ালার ভ্যানে উঠায়া, নিজেই ভ্যান চালাইয়া হাসপাতালে নেই। গিয়া ডাক্তাররে কই, আমার বাবাডারে বাঁচান। কিন্তু ডাক্তার কয়, আপনার ছেলে আর নাই।
মা খালেদা কবির বলেন, “আমার পায়ে অনেক ব্যথা। হাঁটতেও পারি না। শরীফ আসত অফিস থেইকা, পায়ে মালিশ করত। চাইলেই ও অপারেশনের জন্য টাকা দিত। এখন কেউ নাই। ওরে ছাড়া আমি আর কিছু বুঝি না। আল্লাহ আমার পোলারে নিছে, আমি বাঁচি কেমনে?”
শরীফের ভাতিজি সারাহ এখনো মনে করে, তার চাচ্চু চকলেট আনতে গেছে। চাচার কথা উঠলে বলে, “চাচ্চু কোথায় যেন গেছে, চকলেট নিয়ে আসবে।
বোন রোকেয়া বলেন, “হেলিকপ্টার থেইকা পাখি শিকারের মতো গুলি কইরা ভাইটারে মারছে। ভাইয়ের মরণের পর ঘরের ভরণপোষণ সব এলোমেলো হয়ে গেছে। বাবা আর ঘরে থাকেন না, তাবলীগে তাবলীগে ঘুরে বেড়ান।”
শরীফকে হাসপাতালে নেওয়ার পর স্থানীয় আওয়ামীপন্থী সন্ত্রাসীরা পোষ্টমর্টেম না করে তড়িঘড়ি দাফনের জন্য পরিবারকে হুমকি দেয়। ভয় আর নিরাপত্তাহীনতায় পরিবার বাদ মাগরিব জানাজা শেষে ডেমরার শুকুরসী কবরস্থানে তাকে দাফন করে।
পিতা মোঃ হুমায়ুন কবির পরে শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় আরও অভিযুক্ত করা হয় আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, ওবায়দুল কাদের, জুনায়েদ পলক ও শামিম ওসমানকে। এজাহারে বলা হয়, “হেলিকপ্টার থেকে পরিকল্পিতভাবে গুলি ছুড়ে হত্যা করা হয়। পরে পোষ্টমর্টেম না করার জন্য হুমকি দেওয়া হয়।”
শরীফের পরিবার জামায়াতে ইসলামি থেকে ২ লাখ টাকা ও ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ থেকে ৫ লাখ টাকা সহায়তা পেয়েছে। কিন্তু এই সহায়তা শোকের ভার হালকা করতে পারেনি।
পিতা হুমায়ুন কবির বলেন, “আমার ছেলেটা সোনার টুকরা ছিল। এমন ছেলে এই যুগে কই পায়? ওর মতো একটা পোলা কাইড়া নিলো খুনি হাসিনা। আমি ওর বিচার চাই, আমি বিচার চাই সব মা-বাবার, যারা ছেলেদের হারায়ছে।”
আহসান কবীর শরীফ একটি নাম, একটি প্রতিবাদী চেতনার প্রতীক। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, এই রাষ্ট্র কেমন ভয় পায় একটি মেধাবী সন্তানের সাহসিকতাকে। এখন প্রশ্ন একটাই এই হত্যা কি কখনো বিচার পাবে? নাকি রক্তাক্ত জুলাই-অগাস্ট কেবলই অরক্ষিত তরুণদের কবরে নাম লেখাতে থাকবে?

ট্যাগ :

সংবাদটি সোস্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন

হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলিতে শহীদ আহসান

আপডেট সময় : ০৬:০৬:৫৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ৯ জুলাই ২০২৫

২১ জুলাই ২০২৪। ঢাকার আকাশে হেলিকপ্টারের গর্জন, নিচে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ, পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া আর একটার পর একটা গুলির শব্দ। এমন এক আতঙ্কের দিনে মা খালেদা কবির বারবার অনুরোধ করেছিলেন ছেলেকে“বাবা, তুই বাইরে যাইস না। কেউ বের হবি না।”
কিন্তু মায়ের নিষেধ অমান্য করেই মেধাবী তরুণ আহসান কবীর শরীফ বেরিয়ে যান আন্দোলনের মাঠে। শরীফের ভাষায়, এই আন্দোলন ছিল “ভবিষ্যতের প্রজন্মের জন্য একটা ন্যায্যতার দাবি।” কিন্তু ওই দিন তিনি আর ফিরলেন না। ফিরলো তাঁর নিথর দেহ।
শরীফ ছিলেন ঢাকার ডেমরা থানার দক্ষিণ সানারপাড় এলাকার বাসিন্দা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইক্রোবায়োলজিতে মাস্টার্স শেষে একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করতেন। বয়স হয়েছিল ৩৩ বছর। তাঁর বাবা মোঃ হুমায়ুন কবির অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, মা খালেদা কবির একজন অসুস্থ গৃহিণী, হাঁটুতে অপারেশন হওয়া সত্ত্বেও লাঠিতে ভর করে কোনোমতে চলেন। শরীফের বড় ভাই মাহবুব প্রবাসী, বোন রোকেয়া মিরপুরে থাকেন। ছোট ভাতিজি সারাহ সারাদিন চাচার সাথেই সময় কাটাতো।
২১ জুলাই দুপুর তিনটার দিকে শরীফ সাইনবোর্ড এলাকায় আন্দোলনের ছবি তুলছিলেন। হঠাৎ মাথার উপর হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছোড়া হয়। একটি গুলি তার বুকের মাঝ বরাবর ঢুকে পেছন দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান।
খবর পেয়ে পিতা হুমায়ুন কবির ছুটে যান। গলিতে পড়ে থাকা ছেলের নিথর দেহ নিজে চোখে দেখে ভেঙে পড়েন। বলেন, “গিয়া দেখি পোলার নিথর দেহটা পইড়া আছে। একটাও গাড়ি নাই। পরে এক সবজি ওয়ালার ভ্যানে উঠায়া, নিজেই ভ্যান চালাইয়া হাসপাতালে নেই। গিয়া ডাক্তাররে কই, আমার বাবাডারে বাঁচান। কিন্তু ডাক্তার কয়, আপনার ছেলে আর নাই।
মা খালেদা কবির বলেন, “আমার পায়ে অনেক ব্যথা। হাঁটতেও পারি না। শরীফ আসত অফিস থেইকা, পায়ে মালিশ করত। চাইলেই ও অপারেশনের জন্য টাকা দিত। এখন কেউ নাই। ওরে ছাড়া আমি আর কিছু বুঝি না। আল্লাহ আমার পোলারে নিছে, আমি বাঁচি কেমনে?”
শরীফের ভাতিজি সারাহ এখনো মনে করে, তার চাচ্চু চকলেট আনতে গেছে। চাচার কথা উঠলে বলে, “চাচ্চু কোথায় যেন গেছে, চকলেট নিয়ে আসবে।
বোন রোকেয়া বলেন, “হেলিকপ্টার থেইকা পাখি শিকারের মতো গুলি কইরা ভাইটারে মারছে। ভাইয়ের মরণের পর ঘরের ভরণপোষণ সব এলোমেলো হয়ে গেছে। বাবা আর ঘরে থাকেন না, তাবলীগে তাবলীগে ঘুরে বেড়ান।”
শরীফকে হাসপাতালে নেওয়ার পর স্থানীয় আওয়ামীপন্থী সন্ত্রাসীরা পোষ্টমর্টেম না করে তড়িঘড়ি দাফনের জন্য পরিবারকে হুমকি দেয়। ভয় আর নিরাপত্তাহীনতায় পরিবার বাদ মাগরিব জানাজা শেষে ডেমরার শুকুরসী কবরস্থানে তাকে দাফন করে।
পিতা মোঃ হুমায়ুন কবির পরে শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় আরও অভিযুক্ত করা হয় আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, ওবায়দুল কাদের, জুনায়েদ পলক ও শামিম ওসমানকে। এজাহারে বলা হয়, “হেলিকপ্টার থেকে পরিকল্পিতভাবে গুলি ছুড়ে হত্যা করা হয়। পরে পোষ্টমর্টেম না করার জন্য হুমকি দেওয়া হয়।”
শরীফের পরিবার জামায়াতে ইসলামি থেকে ২ লাখ টাকা ও ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ থেকে ৫ লাখ টাকা সহায়তা পেয়েছে। কিন্তু এই সহায়তা শোকের ভার হালকা করতে পারেনি।
পিতা হুমায়ুন কবির বলেন, “আমার ছেলেটা সোনার টুকরা ছিল। এমন ছেলে এই যুগে কই পায়? ওর মতো একটা পোলা কাইড়া নিলো খুনি হাসিনা। আমি ওর বিচার চাই, আমি বিচার চাই সব মা-বাবার, যারা ছেলেদের হারায়ছে।”
আহসান কবীর শরীফ একটি নাম, একটি প্রতিবাদী চেতনার প্রতীক। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, এই রাষ্ট্র কেমন ভয় পায় একটি মেধাবী সন্তানের সাহসিকতাকে। এখন প্রশ্ন একটাই এই হত্যা কি কখনো বিচার পাবে? নাকি রক্তাক্ত জুলাই-অগাস্ট কেবলই অরক্ষিত তরুণদের কবরে নাম লেখাতে থাকবে?