চব্বিশের জুলাই বিপ্লবে সাহসের উজ্জ্বল প্রদীপ হয়ে জ্বলে উঠেছিলেন শহীদ আবু সাঈদ। পুলিশের গুলির মুখে দাঁড়িয়ে দুই হাত প্রসারিত করে বুক চিতিয়ে যেন বলতে চেয়েছিলেন ‘এভাবে মানুষ মারা চলবে না’।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যা মামলায় বুধবার (২৭ আগস্ট) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেওয়া সূচনা বক্তব্যে এ কথা বলেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।
বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ দেওয়া সূচনা বক্তব্যে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, বাংলা পঞ্জিকায় দিনটি ছিল আষাঢ়ের শেষ দিন।
সেখানেই জুলাই বিপ্লবের সাহসের উজ্জ্বল প্রদীপ হয়ে জ্বলে উঠেছিলেন শহীদ আবু সাঈদ।পুলিশের লাঠিচার্জে রক্তাক্ত হয়েও দুহাত প্রসারিত করে বুক চিতিয়ে যেন বলতে চেয়েছিলেন, ‘এভাবে মানুষ মারা চলবে না’। কিন্তু সাধারণ ছাত্রদের বাঁচাতে চাইলেন যিনি, ঠিক তার বুকেই তাক করা হলো বন্দুকের নল। ঘড়ির কাঁটায় তখন দুপুর ২টা ১৭ মিনিট। ঠিক তখনই গর্জে ওঠে মামলার আট নম্বর আসামি পুলিশের সাবেক এএসআই মো. আমির হোসেনের রাইফেল। যে অস্ত্র কেনা হয়েছিল আবু সাঈদের ট্যাক্সের টাকায়, শত্রুর বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য। সে অস্ত্রই বিদ্ধ করল আবু সাঈদকে।
তিনি আরো বলেন, প্রথম গুলিটি যখন আবু সাঈদের পেটে লাগে, তখন তিনি হতবাক হয়ে যান। আবার বুক প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে যান। তখনই তাকে পরপর দুই রাউন্ড গুলি করেন নয় নম্বর আসামি সাবেক কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায়। এরপর রাস্তার ডিভাইডার পার হয়ে বসে পড়েন আবু সাঈদ। একজন সহযোদ্ধা তাকে মাটি থেকে তোলার জন্য ধরতে গেলে আবার সে পড়ে যান। আবু সাঈদকে নেওয়ার সময় তাদের লক্ষ্য করে আবার গুলি চালায় পুলিশ। এতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তাওহিদুর হক সিয়ামের শরীরের বাঁ দিকটি ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। প্রায় ৬০টি ছররা গুলি তার মাথা, মুখ-হাত, বাহু, পেট, কোমর ও পায়ের বাঁ দিকে বিদ্ধ হয়। আবু সাঈদকে নিয়ে আন্দোলনরত ছাত্ররা রিকশায় করে রওনা দেন রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে উদ্দেশে। হাসপাতালে নেওয়ার পথে সহযোদ্ধাদের বাহুডোরেই ঢলে পড়েন আবু সাইদ।
চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কাছে এ রকম মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের বিচার চান।
এদিন ট্রাইব্যুনালে আবু সাঈদকে গুলি করার দুটি ভিডিও প্রদর্শনের সময় তার বাবা মকবুল হোসেন মনিটরের দিকে তাকিয়ে অশ্রুসিক্ত হন। এক পর্যায়ে প্রসিকিউশনের আবেদনে ট্রাইব্যুনাল আগামীকাল এই মামলায় প্রথম সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করেন।
গত ৩০ জুলাই প্রসিকিউশন পক্ষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম এই মামলায় অভিযোগ গঠনের প্রার্থনা করেন। অন্যদিকে আসামি পক্ষে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি চাওয়া হয়। এরপর গত ৬ আগস্ট ট্রাইব্যুনাল এই মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে সূচনা বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য ২৭ আগস্ট দিন ধার্য করেন।
এই মামলার যে ৩০ জনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ আনা হয়, তাদের মধ্যে গ্রেপ্তার ছয়জন আজ ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় হাজির ছিলেন। এরা হলেন—বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর শরিফুল ইসলাম, সাবেক সহকারী রেজিস্ট্রার রাফিউল হাসান রাসেল, রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের চুক্তিভিত্তিক সাবেক কর্মচারী মো. আনোয়ার পারভেজ, পুলিশের সাবেক সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আমির হোসেন, সাবেক কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায় ও নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা ইমরান চৌধুরী ওরফে আকাশ।
আবু সাঈদ হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গত ৩০ জুন ৩০ জনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।