ঢাকা ০৮:১৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ৩০ ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

জুলাই ডিনায়াল বা অস্বীকারের রাজনীতি

প্রতিবেদকের নাম :
  • আপডেট সময় : ০৬:৫৯:০৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৫ অগাস্ট ২০২৫
  • / ৩৮ জন পড়েছেন

এই লেখার আরও একটা শিরোনাম ভেবেছিলাম। সেটা হলো- রাজনৈতিক জায়োনিজম। এই বিষয়টি আজকে অতি সংক্ষেপে আলোচনা করতে চেষ্টা করব। রাজনৈতিক জায়োনিজম এমন একটি প্রবণতা; যা চর্চা করার জন্য আপনার ইহুদি হতে হবে না। যে কোনো ধর্ম বা অবিশ্বাসীরাও এটা চর্চা করতে পারে। এর অনেক দিক আছে- আজকে একটা দিক নিয়ে শুধু কথা বলব।

ধরেন, একটা রাজনৈতিক দলের একজন নেতা বা একাধিক নেতা জুলাইকে বিশ্বাস করল না, অস্বীকার করল। এবার আপনি দেখলেন একজন বুদ্ধিজীবী লিখছেন, এ ধরনের প্রবণতাকে তিনি ‘জুলাই ডিনায়াল প্রজেক্ট হিসেবে’ দেখেন এবং দলের প্রধান নেতা এটা অন্যকে দিয়ে করাচ্ছেন। নিজে দায় নিচ্ছেন না, তবে ইলেকশনের পর তিনিও সরাসরি এ কাজ করবেন। মানে জুলাই ডিনায়ালের রাজনীতি করবেন। কত বড় বিপদের কথা তাই না?

সোশ্যাল মিডিয়ার হাইপের মধ্যে এ বক্তব্যকে প্রচণ্ড রকম সঠিক মনে হবে। কারণ যে জুলাই নিয়ে সমালোচনা করেছে সে খুবই আপত্তিকর কথা বলেছে। যে কোনো লোক শুনলেই বুঝবেন তার কথার মধ্যে সমস্যা আছে; কিন্তু এ সমস্যাজনক বক্তব্যকে গোটা দল ও সবার পজিশন হিসেবে ট্যাগ করা এবং জুলাই ডিনায়াল একটা ফেনোমেনা আকারে তৈরির চেষ্টা কতটা ভয়ঙ্কর তার দুই-একটা দিক নিয়ে আলোচনা করব।

এ জুলাই ডিনায়াল কথাটা কোনো বুদ্ধিজীবীর আবিষ্কার না। এটার জায়োনিস্টদের হলোকাস্ট ডিনায়াল কথাটার বাংলা নকল। কিন্তু শুধু নকল হলে কোনো সমস্যা থাকতো না। এর মধ্যে জায়োনিস্ট রাজনীতির প্রকল্পও হাজির আছে। কিভাবে হাজির আছে তা সংক্ষেপে বলতে চেষ্টা করব।

যারা জুলাইকে পূজা বা নিজেদের রাজনৈতিক দলের ক্রেডিট বলে দাবি করেন তারা ঠিক আওয়ামী লীগ যেভাবে ৭১-কে ব্যবহার করেছে- সেই রাজনীতিই করছে। আওয়ামী লীগ ৭১-এর জনযুদ্ধকে আওয়ামী যুদ্ধ মনে হিসেবে বয়ান করেছে। এমনি জুলাইকে একটা দল নিজেদের একক কৌশল ও মূল অবদান বলে দাবি করার চেষ্টা করছে এবং আওয়ামী লীগ তাদেরই এর আগে বলেছে ওরা ৭১ ডিনায়াল করেছে এবং এজন্য তাদের গণশত্রুতে পরিণত করার চেষ্টা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকের জন্ম ৭১-এর পর হলেও ৭১ বিষয়ে লীগের বয়ান বিশ্বাস না করলেই তাকে ৭১ ডিনায়ালের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তাকে ইতিহাস থেকে বিযুক্ত করে হত্যাযোগ্য করে তোলা হয়েছিল যেই প্রকল্পের মাধ্যমে এরা জুলাইকে ঠিক সেই প্রকল্প রূপে হাজির করতে চাচ্ছে। কিন্তু তারা নিজেদের দাবি করছে তারা সব চাইতে সহিহ জুলাই করনেওলা। সব চেয়ে জনদরদি। সবচেয়ে মেধাবী। সব চেয়ে সেরা কৌশলী।

এই প্রবণতা একটা গ্লোবাল জায়োনিস্ট প্রবণতা। পরে এটা নিয়ে কথা বলবো। এ ধরনের বুদ্ধিজীবীরা যেটা করছে তা হলো-ঠিক লীগ বিরোধিতার নামে লীগের রাজনীতিই করছে। জাস্ট অন্য দলের ব্যানারে করছে। এদেরকেই আমি বলি- লীগ বিরোধী লীগ এবং এরাই যে কোনো ইভেন্টকে ইতিহাস মনে করে। ইতিহাসের যে কালেকটিভ কর্তাসত্ত্বা থাকতে হয়। ইতিহাসে যে ব্যক্তি, দল, মতাদর্শ না বরং গুরুত্বপূর্ণ হলো স্পিরিট এবং এই স্পিরিটই কালেকটিভ কর্তাসত্ত্বাকে ধারণ করে এবং ২৪-এর কর্তাসত্ত্বাও প্লুরাল। যাদের জুলাই ডিনায়াল বলছেন তারাই জুলাইয়ের অন্যতম ফাইটার। তারাও এটার অংশ। কিন্তু তারা নিজেদের সমগ্র দাবি করে অন্যদের ডিনায়াল বানানোর বয়ানগিরি শুরু করে দিয়েছে। এটার মাধ্যমে যে তারা ঠিক পরাজিত লীগের ন্যারোটিভ পলিটিক্স করছে-এটা তারা হয়তো বুঝতে পারে না অথবা বুঝেই এ ইতিহাসের নামে ইতিহাস বিরুদ্ধ রাজনীতি করে এবং তারা একটা ইভেন্টকেই ইতিহাস মনে করে। তারা দলীয় ও গোষ্ঠীগত বয়ান তৈরির চেষ্টা করে। আর সেই বয়ানের আলোকেই শত্রু-মিত্র বিভাজন শুরু করে দেয়।

এরা ইডিওলোজি কিভাবে ফাংশন করে এটা বুঝতে পারে না। এটা না বুঝলেও একটা দলের ইডিওলোজিকে নিরপেক্ষ ও জনগণের ভয়েস হিসেবে সার্ভ করতে শুরু করে। সেই দল গণহত্যার উপযুক্ত হয়ে ওঠে এই ধরনের আত্মঘাতী বুদ্ধিজীবিতার দ্বারাই।

এরা মূলত ছদ্ম বুদ্ধিজীবী। সক্রেটিস এদের সোফিস্ট বলতেন। এরা সত্যকে অনুসন্ধান করে না। এরা সত্যকে নকল করে। সত্য-মিথ্যার মিশ্রণে পলিটিক্যাল ট্রুথ তৈরি করে; যা মিথ্যার চেয়ে ভয়ঙ্কর। এরা সসি বা মজাদার কথা-বর্তা বলে, এরা যখন রাজনৈতিক ক্ষমতার দিকে ঝুঁকে তখন গণমানুষের কণ্ঠস্বর হওয়ার নাম করে গণহত্যার লজিক তৈরি করতে থাকে। লীগের আমলের বুদ্ধিজীবীরাও এটাই করেছে। জুলাইকে নিয়ে এখন এই প্রবণতা কতিপয় ছদ্ম বুদ্ধিজীবীর মধ্যেও দেখা যাচ্ছে। আমি কারো নাম নিচ্ছি না। জাস্ট চিন্তাটার ভয়াবহতা ধরে কয়েকটা কথা বলেই শেষ করবো। ৭১-এর জনযুদ্ধকে যেই তরিকায় অওয়ামী যুদ্ধ বানিয়ে বিপুল মানুষকে ইতিহাসের বাইরে রাখা হয়েছে। ঠিক জুলাই নিয়েও এই ধরনের ধান্ধাবাজি চলছে। ইতিহাস বিষয়ে কালেকটিভ অসচেতনতা থাকার ফলে আগামীতে যেই প্রবণতা আরও বাড়বে মনে হচ্ছে; তা হলো-

জুলাই, ২০২৪ নিয়ে যেসব বুদ্ধিজীবী বেশি লাফাবে, তারাই বেশি বেশি জুলাই পূজা করবে- যাদের মাঠে কোনো ভূমিকা ছিল না। যারা গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত করার ক্ষেত্রে কোনো ‘রিস্কি’ ভূমিকা পালন করে নাই। এসব অশিক্ষিত বুদ্ধিজীবীরা সবচেয়ে বেশি জুলাই পূজারি আকারে হাজির হবে এবং নিজের অনুগত দলকে বা মতাদর্শকে জুলাই ক্রেডিট দেওয়ার জন্য প্রচণ্ড নিষ্ঠার সঙ্গে সত্যের বিকৃতি ঘটাতে থাকবে।

এরা যেই দলের বয়ান তৈরির কাজ করবে সেই দলই লীগের উত্তরাধিকার হয়ে উঠবে। জুলাইকে আমরা পূজা দেওয়া ও দলীয় বয়ানের বাইরে রাখতে চাই। এটা কালেকটিভ জাতীয় ফেনোমেনা। ক্রেডিট শুধু শহীদদের। জীবিতদের আছে শুধু দায়িত্ব। এমনকি এত দ্রুত জুলাইকে আমরা ইতিহাস করে তুলতে চাই না। জুলাইকে আমরা লিভিং প্রেজেন্ট রাখতে চাই। কারণ জুলাইয়ের রাজনৈতিক অঙ্গীকার এখনও বাস্তবায়ন শুরু হয় নাই। এটাকে ইতিহাস করে দলের ক্রেডিট দখলের জুয়ার তাসে পরিণত করতে চায় যারা তারা কোনো বুদ্ধিজীবী না। সিম্পল রেটরিক্যাল, অশিক্ষিত ফটকা।

‘ইন দ্য রং সাইড অব হিস্ট্রি’তে কেউ অবস্থান নেন । কেউ যদি জনগণের উইল বা আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে থাকে তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত জনগণকেই নিতে দিন। আপনি তার হয়ে রায় দিয়ে দিলে বিপদ হবে। ৭১ কে বা ২৪ কে ডিনাই করার বিষয়ে আপনি হাইপার সেনসেটিভ না হলেও হবে। বা ২৪ কে দিয়ে ৭১ এর পাপকে প্রলেপ দেওয়ার রাজনীতি যারা করছে তাদের বিষয়েও জনগণকে সিদ্ধান্তকে নিতে দিন। কিন্তু জনগণের হয়ে আপনি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলে, আপনি জনগণের চেয়ে স্মার্ট হয়ে গেলে, জনগণ অশিক্ষিত তারা ভুল করে ফেলবে, যোগ্য ও আসল চেতনাধারীকে চিনতে পারবে না। ৭১-এর রাজাকার বা ২৪-এর যোদ্ধাকে চিনতে পারবে না- ফলে আপনাকে এটা ঠিক করে দিতে হবে- আপনি এমনটা মনে করলে আপনি আসলে খুবই নিকৃষ্ট মানের ফ্যাসিস্ট। আপনি গণতন্ত্রকে বুঝেন আপনার ‘স্বার্থের’ আলোকে। আপনি লীগবিরোধী লীগার। মনে রাখতে হবে- আপনি বিজয়ী হওয়ার পরও হেরে যাবেন যদি শত্রুর খাসিলত আপনার মধ্যে থেকে যায়।

এবার আসল পয়েন্টে আসি। যেউ যদি ৭১ বা জুলাই ডিনাই করে– তা হলে কী হবে? সে বা তারা কি কোনো রাজনৈতিক বা নাগরিক হিসেবে থাকার অধিকার নিয়ে টিকে থাকার সুযোগ নাই? আপনি যদি মনে করেন নাই- তাইলে আপনি ট্রাইবাল যুগে পড়ে আছেন। নাগরিক অধিকারভিত্তিক রাজনীতির বিষয়টা আপনি বুঝেন গোত্রভিত্তিক আবেগ দিয়ে। ইতহাসের কোনো বিষয়ে একটা দলের বা নাগরিকদের মত ভিন্নতা তার টিকে থাকার বা অধিকার নিয়ে থাকার জন্য কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে।

আপনাদের কী মনে হয়? একটা ঘটনার বহু রকম ব্যাখ্যা থাকে, তার সঙ্গে কেউ দ্বিমত হলে আপনি যখন তাকে সেই ঘটনার ডিনায়াল হিসেবে চিহ্নিত করে তাকে আদারিং বা অপর করেন তাকে আপনি জাতীয় শত্রু করে তুলবার প্রক্রিয়া শুরু করেন, দমনযোগ্য করে তুলেন। এটাই বাংলাদেশে করেছিল- আওয়ামী লীগ। এটাই করা হয় গ্লোবাল জায়নিস্ট পলিটিক্সের বয়ান তৈরির বেলায়। আপনি ঠিক এই কাজটাই করলেন কাউকে জুলাই ডিনায়াল বলার মাধ্যমে।

আমি আশিস নন্দীর একটা বই একবার ফুটপাত থেকে কিনেছিলাম। বইটার নাম: TRADITIONS TYRANNY AND UTOPIAS: ESSAYS IN THE POLITICS OF AWARENESS.

এই বইটার ভূমিকা লিখেছেন বিখ্যাত ফরাশি দার্শনিক (Roger Garaudy) রজার গারোডি। ছোট্ট ভূমিকা কিন্তু তাতে তিনি যেসব কথা লিখেছেন তা পড়েই মনে হয়েছিল এই লোক জিনিয়াস। তকে পড়তে হবে। পরে উনার আরও কাজ পড়তে গিয়ে দেখি- পুরাই বিপ্লবী লোক। তার বিখ্যাত অনেক কাজ আছে। তিনি জেলেও খেটেছেন। শেষ জীবনে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত এক বইতে তিনি ষাট লাখ ইহুদির গণহত্যাকে ‘মিথ’ বলে দাবি করেন। এজন্য ফরাশি আইনে তাকে হলোকাস্ট ডিনায়ালকারী বা অস্বীকার করার জন্য কয়েক বছরের কারাদণ্ড দেয়।

তার বিখ্যাত বই, The Founding Myths of Modern Israel-এতে হলোকাস্টের বয়ানকে তিনি চ্যালেঞ্চ করেন। তাকে করাগারে পাঠিয়ে দিয়ে বইটিও নিষিদ্ধ করা হয়। বইটাতে তিনি কোথাও নাৎসিরা যে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে তা অস্বীকার করেন নাই। বরং ফরাশি আদালত তার মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেছে। গারোডি আদালতে বলেন, তিনি নাৎসি জাতীয় সমাজতন্ত্রকে সমর্থন করেন না। তিনি মূলত দেখিয়েছেন, হলোকাস্টকে ইসরাইল কিভাবে জায়োনিস্ট প্রকল্প কায়েমের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে এবং প্রকৃত ঘটনার একটা ফিকশনাল ওমিথিক্যাল বয়ান হাজির করে; যার সঙ্গে সত্যের কোনো সম্পর্ক নাই। ফিলিস্তিনের ওপর গণহত্যা চালানোর অজুহাত হিসেবে এই হলোকাস্টকে জায়নিস্টরা ব্যবহার করে। এটাই ছিল তার আলোচনার বিষয়; কিন্তু এটাকে বানিয়ে দেওয়া হলো– হলোকাস্ট ডিনায়াল।

তার আপিল খারিজ করে তাকে করাগারে পাঠানো হয়। অবশ্য এর আগে ‘দ্য কেস অব ইসরাইল: আ স্টাডি অফ পলিটিক্যাল জায়োনিজম”’(১৯৮৩) বইতে, গারোডি জায়োনিজমকে একটি সন্ত্রাবাদী মতাদর্শ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং এটা কিভাবে পলিটিক্যাল ট্রুথ ও আবেগ উসকে দিয়ে ফিলিস্তিনের জনগণের ওপর গণহত্যার লজিক তৈরি করে দেখিয়েছেন।

এখন বাংলাদেশেও আপনি যদি আপনার ৭১-এর বয়ান বা আপনার তৈরি ২৪-এর বয়ান কেউ না মানে আপনি তাকে ডিনায়ালকারী হিসেবে যখন চিহ্নিত করেন তখন ঠিক জায়োনিস্ট রাজনীতিই করেন। মনে রাখতে হবে ৫ তারিখের পর আমরা পোস্ট ন্যারেটিভ যগে চলে গেছি। আমরা আর কোনো একক ন্যারেটিভ বা বয়ানের আলোকে দেশকে, দেশের জনগোষ্ঠীকে দেখি না। নাগরিকদের দেখি না। আমরা দেখি সে অন্যায়কারী নাকি নিরপরাধী। তার কোন কিছু স্বীকার ও অস্বীকার করার ওপর তার রাজনৈতিক ও নাগরিক মর্যাদা নির্ভর করলে আপনি দ্রুতই তাকে হত্যাযোগ্য করে তুলতে পারবেন। এজন্য নাগরিকভিত্তিক রাজনীতিতে কোনো একক বা গ্রান্ড ন্যারেটিভ ও মতাদর্শকে আমরা রাষ্ট্র পরিচালনায় দেখতে চাই না। রাষ্ট্র হবে- ভ্যালু বেইজড। রাষ্ট্র ভ্যালু প্লুরালিটি করবে। কিন্তু করাপ্ট অশিক্ষিত ও ছদ্দ বুদ্ধিজীবীরা সব সময় সমাজকে মতাদর্শগতভাবে বিভক্ত করেছে। এই কারণে আমাদের দেশ জাতী হয়ে উঠবার বদলে কয়েকটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে রয়েছে। আর বুদ্ধিজীবীরা এই ধরনের ফ্যানাটিক প্রবণতা তৈরিতে অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখছেন। একক মতাদর্শ না ভিন্নতার মধ্যে ঐক্য। সব মানুষের অধিকার নিছিন্ত হচ্ছে কিনা সেটাই প্রধান বিবেচনা। সব মানুষ আপনার মতোন চিন্তা করে কিনা। আপনার ইতিহাসের বয়ানে ইমান রাখে কিনা- এটা দেখবার দরকার নাই। পলিটিক্যাল ইউজ অব দ্য পাস্ট খুবই ভয়ঙ্কর। হিস্ট্রিসিটিকে একটা পুলিশি প্রকল্প আকারে নেওয়ার মধ্য দিয়ে পাশের দেশে কিভাবে উগ্র হিন্দুত্ববাদ সমাজকে ছেয়ে ফেলেছে তা আমাদের মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করা দরকার। এটা আমাদেরও অনেক ক্ষতি করেছে। আমরা ইতিহাসকে দেখি- ট্রুথফুল কালেকটিভ স্পিরিট আকারে। কোনো দল বা ব্যক্তির মধ্যে আমরা ইতিহাসকে দেখি না। আমরা জাতীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য ইত্যাদির বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন পজিশনকে সম্মান করি। আমাদের এই ভিন্নতার মধ্যে ঐক্যই- আমাদের শক্তি। মনে রাখতে হবে-

‘Once man loses his faculty of indifference he becomes a potential murderer.’

-E. M Cioran.

( বই: A Short History of Decay)

যে কোনো ইভেন্ট বিষয়ে পজিশনের বিষয়ে এসব ছদ্ম চিন্তকদের উত্তেজক উসকানি আপনাকে দ্রুত পক্ষে-বিপক্ষে বিভক্ত করে ফেলবে। আমাদের মনে করাখতে হবে আপনার কোনো কিছু ডিনায়াল বা স্বীকার করায় কিছু যায় আসে না। আপনি একটা বা দুইটা জাতীয় ইভেন্টে কি পজিশন নিলেন তাতে আপনার জাতীয় ইতিহাস তৈরি হয় না। ইভেন্ট বা ঘটনা আর ইতিহাস এক না। ইতিহাসের জন্য একটা ইউনিভাসাল অবস্থান লাগে। সেটা অনেক ইভেন্ট নিলে তৈরি হয়। একটা দুইটার আলোকে জাতিকে যারা নেমিং করতে চায় এরা ক্ষমতার জন্য জাস্ট অতীতকে ব্যবহার করে। তারা জাতীয় ইতিহাসের মুক্তি ঘটায় না। আপনার মনে রাখতে হবে, আরব জাতীয় ইতিহাস, চীন জাতীয় ইতিহাস কিভাবে গড়ে উঠেছে। কোনো বিশেষ ইভেন্ট পূজা করে না। জাতীয় আত্ম-শক্তির দার্শনিক বিকাশের ওপর ভর করে ইতিহাস গড়ে ওঠে। একক মতাদর্শ গত বয়ানে ট্রুথফুলনেস থাকে না। যেটা সোভিয়েত আমলের ইতিহাস প্রকল্প করতে গিয়ে ফেইল করেছে। ইতিহাসের মূল চালিকাশক্তি হলো স্পিরিট; যা একটা গ্লোবাল-সিভিলাইজেশনাল প্রকল্প। হেগেল যেটাকে ইতিহাসের ইঞ্জিন বলেছেন- যা আমাদের নাই। ইতিহাসের নামে ইভেন্ট পূজার এই সংষ্কৃতি আমাদের দিন দিন আরও বিভক্তি করছে। এটা নিয়ে আমাদের সিরিয়াসলি কাজ করতে হবে। ২৪-এর পর এ সুযোগ আমাদের সামনে হাজির হয়েছে। বাংলাদেশি পরিচয়টিকে একটি সভ্যতাগত ভিত্তি দেওয়ার চিন্তাশীল কাজ আমাদের করতে পারতে হবে। বিশ্ব বাঙালির একটাই দেশ। জাতি, ধর্ম, গোত্র, লিঙ্গ যাই হোক, আপনি পৃথিবীর যে দেশেই থাকেন- বাংলাদেশ আপনার একটা সিভিলাইজেশনাল আইডেনটিটি যেন হতে পারে। তেমন একটা ট্রান্স ন্যাশনাল জাতীয় ইতিহাসের পরিচয় আমাদের লাগবে। ইরান, চীন, ভারত, আরব– এদের যেমন আছে। এটা না হলে সেই আন্তর্জাতিক দুনিয়াতে সম্মানের আসনে আমরা পৌঁছতে পারব না। মাল্টিপোলার দুনিয়ায় আমরাও যদি একটা পোল হতে চাই তাহলে আমাদের এই জাতীয় ইতিহাসের প্রকল্পকে কয়েকটা ইভেন্ট পার হয়ে গ্লোবাল হয়ে উঠতে পারতে হবে। জাতীয় ইতিহাসের মুক্তি না হলে জাতি তৈরি হয় না। জাতীয় মুক্তি আসে না। এগুলো নিয়ে লম্বা আলাপ দিতে হবে।

তবে আপাতত জরুরি হলো- আপনি অধিকার পাচ্ছেন কিনা? রাষ্ট্র আপনার নাগরিক অধিকার দিচ্ছে কিনা- এটা জরুরি। আপনি কী বিশ্বাস করেন, কী অস্বীকার করেন- এটা জরুরি না অন্যের জন্য। আপনি সব স্বীকার করলেন আর দিন দিন করাপ্ট পলিটিক্যাল ক্যাডার বাহিনী শক্তিশালী হলো এবং রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করল তখন আপনাকে দ্রুতই শত্রু  বানিয়ে ফেলবে। বাংলাদেশের সর্বনাশের জন্য এসব ফ্যানাটিক বুদ্ধিজীবীদের উসকানিতে পা দেওয়া যাবে না। কোনো মতাদর্শ মানুষের জীবনের চেয়ে মূল্যবান হতে পারে না। মতাদর্শ পূজারিরা মানুষকে মতাদর্শগতভাবে চিহ্নিত করে হত্যা যোগ্য করে তুলেন। আমাদের সব বিভাজন ও মত-ভিন্নতাসহ একসঙ্গে থাকার আর্ট অর্জন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, টলারেন্সি ফার্স্ট, ডেমোক্রেসি সেকেন্ড। জাতি মানে, রাষ্ট্র মানে, বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য। নিজের বয়ানের দাস যারা আপনাকে বানাতে চায়- মনে রাখবেন তারা আপনাকে হত্যাযোগ্য করে তুলতে চেষ্টা করছে।

ট্যাগ :

সংবাদটি সোস্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন

জুলাই ডিনায়াল বা অস্বীকারের রাজনীতি

আপডেট সময় : ০৬:৫৯:০৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৫ অগাস্ট ২০২৫

এই লেখার আরও একটা শিরোনাম ভেবেছিলাম। সেটা হলো- রাজনৈতিক জায়োনিজম। এই বিষয়টি আজকে অতি সংক্ষেপে আলোচনা করতে চেষ্টা করব। রাজনৈতিক জায়োনিজম এমন একটি প্রবণতা; যা চর্চা করার জন্য আপনার ইহুদি হতে হবে না। যে কোনো ধর্ম বা অবিশ্বাসীরাও এটা চর্চা করতে পারে। এর অনেক দিক আছে- আজকে একটা দিক নিয়ে শুধু কথা বলব।

ধরেন, একটা রাজনৈতিক দলের একজন নেতা বা একাধিক নেতা জুলাইকে বিশ্বাস করল না, অস্বীকার করল। এবার আপনি দেখলেন একজন বুদ্ধিজীবী লিখছেন, এ ধরনের প্রবণতাকে তিনি ‘জুলাই ডিনায়াল প্রজেক্ট হিসেবে’ দেখেন এবং দলের প্রধান নেতা এটা অন্যকে দিয়ে করাচ্ছেন। নিজে দায় নিচ্ছেন না, তবে ইলেকশনের পর তিনিও সরাসরি এ কাজ করবেন। মানে জুলাই ডিনায়ালের রাজনীতি করবেন। কত বড় বিপদের কথা তাই না?

সোশ্যাল মিডিয়ার হাইপের মধ্যে এ বক্তব্যকে প্রচণ্ড রকম সঠিক মনে হবে। কারণ যে জুলাই নিয়ে সমালোচনা করেছে সে খুবই আপত্তিকর কথা বলেছে। যে কোনো লোক শুনলেই বুঝবেন তার কথার মধ্যে সমস্যা আছে; কিন্তু এ সমস্যাজনক বক্তব্যকে গোটা দল ও সবার পজিশন হিসেবে ট্যাগ করা এবং জুলাই ডিনায়াল একটা ফেনোমেনা আকারে তৈরির চেষ্টা কতটা ভয়ঙ্কর তার দুই-একটা দিক নিয়ে আলোচনা করব।

এ জুলাই ডিনায়াল কথাটা কোনো বুদ্ধিজীবীর আবিষ্কার না। এটার জায়োনিস্টদের হলোকাস্ট ডিনায়াল কথাটার বাংলা নকল। কিন্তু শুধু নকল হলে কোনো সমস্যা থাকতো না। এর মধ্যে জায়োনিস্ট রাজনীতির প্রকল্পও হাজির আছে। কিভাবে হাজির আছে তা সংক্ষেপে বলতে চেষ্টা করব।

যারা জুলাইকে পূজা বা নিজেদের রাজনৈতিক দলের ক্রেডিট বলে দাবি করেন তারা ঠিক আওয়ামী লীগ যেভাবে ৭১-কে ব্যবহার করেছে- সেই রাজনীতিই করছে। আওয়ামী লীগ ৭১-এর জনযুদ্ধকে আওয়ামী যুদ্ধ মনে হিসেবে বয়ান করেছে। এমনি জুলাইকে একটা দল নিজেদের একক কৌশল ও মূল অবদান বলে দাবি করার চেষ্টা করছে এবং আওয়ামী লীগ তাদেরই এর আগে বলেছে ওরা ৭১ ডিনায়াল করেছে এবং এজন্য তাদের গণশত্রুতে পরিণত করার চেষ্টা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকের জন্ম ৭১-এর পর হলেও ৭১ বিষয়ে লীগের বয়ান বিশ্বাস না করলেই তাকে ৭১ ডিনায়ালের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তাকে ইতিহাস থেকে বিযুক্ত করে হত্যাযোগ্য করে তোলা হয়েছিল যেই প্রকল্পের মাধ্যমে এরা জুলাইকে ঠিক সেই প্রকল্প রূপে হাজির করতে চাচ্ছে। কিন্তু তারা নিজেদের দাবি করছে তারা সব চাইতে সহিহ জুলাই করনেওলা। সব চেয়ে জনদরদি। সবচেয়ে মেধাবী। সব চেয়ে সেরা কৌশলী।

এই প্রবণতা একটা গ্লোবাল জায়োনিস্ট প্রবণতা। পরে এটা নিয়ে কথা বলবো। এ ধরনের বুদ্ধিজীবীরা যেটা করছে তা হলো-ঠিক লীগ বিরোধিতার নামে লীগের রাজনীতিই করছে। জাস্ট অন্য দলের ব্যানারে করছে। এদেরকেই আমি বলি- লীগ বিরোধী লীগ এবং এরাই যে কোনো ইভেন্টকে ইতিহাস মনে করে। ইতিহাসের যে কালেকটিভ কর্তাসত্ত্বা থাকতে হয়। ইতিহাসে যে ব্যক্তি, দল, মতাদর্শ না বরং গুরুত্বপূর্ণ হলো স্পিরিট এবং এই স্পিরিটই কালেকটিভ কর্তাসত্ত্বাকে ধারণ করে এবং ২৪-এর কর্তাসত্ত্বাও প্লুরাল। যাদের জুলাই ডিনায়াল বলছেন তারাই জুলাইয়ের অন্যতম ফাইটার। তারাও এটার অংশ। কিন্তু তারা নিজেদের সমগ্র দাবি করে অন্যদের ডিনায়াল বানানোর বয়ানগিরি শুরু করে দিয়েছে। এটার মাধ্যমে যে তারা ঠিক পরাজিত লীগের ন্যারোটিভ পলিটিক্স করছে-এটা তারা হয়তো বুঝতে পারে না অথবা বুঝেই এ ইতিহাসের নামে ইতিহাস বিরুদ্ধ রাজনীতি করে এবং তারা একটা ইভেন্টকেই ইতিহাস মনে করে। তারা দলীয় ও গোষ্ঠীগত বয়ান তৈরির চেষ্টা করে। আর সেই বয়ানের আলোকেই শত্রু-মিত্র বিভাজন শুরু করে দেয়।

এরা ইডিওলোজি কিভাবে ফাংশন করে এটা বুঝতে পারে না। এটা না বুঝলেও একটা দলের ইডিওলোজিকে নিরপেক্ষ ও জনগণের ভয়েস হিসেবে সার্ভ করতে শুরু করে। সেই দল গণহত্যার উপযুক্ত হয়ে ওঠে এই ধরনের আত্মঘাতী বুদ্ধিজীবিতার দ্বারাই।

এরা মূলত ছদ্ম বুদ্ধিজীবী। সক্রেটিস এদের সোফিস্ট বলতেন। এরা সত্যকে অনুসন্ধান করে না। এরা সত্যকে নকল করে। সত্য-মিথ্যার মিশ্রণে পলিটিক্যাল ট্রুথ তৈরি করে; যা মিথ্যার চেয়ে ভয়ঙ্কর। এরা সসি বা মজাদার কথা-বর্তা বলে, এরা যখন রাজনৈতিক ক্ষমতার দিকে ঝুঁকে তখন গণমানুষের কণ্ঠস্বর হওয়ার নাম করে গণহত্যার লজিক তৈরি করতে থাকে। লীগের আমলের বুদ্ধিজীবীরাও এটাই করেছে। জুলাইকে নিয়ে এখন এই প্রবণতা কতিপয় ছদ্ম বুদ্ধিজীবীর মধ্যেও দেখা যাচ্ছে। আমি কারো নাম নিচ্ছি না। জাস্ট চিন্তাটার ভয়াবহতা ধরে কয়েকটা কথা বলেই শেষ করবো। ৭১-এর জনযুদ্ধকে যেই তরিকায় অওয়ামী যুদ্ধ বানিয়ে বিপুল মানুষকে ইতিহাসের বাইরে রাখা হয়েছে। ঠিক জুলাই নিয়েও এই ধরনের ধান্ধাবাজি চলছে। ইতিহাস বিষয়ে কালেকটিভ অসচেতনতা থাকার ফলে আগামীতে যেই প্রবণতা আরও বাড়বে মনে হচ্ছে; তা হলো-

জুলাই, ২০২৪ নিয়ে যেসব বুদ্ধিজীবী বেশি লাফাবে, তারাই বেশি বেশি জুলাই পূজা করবে- যাদের মাঠে কোনো ভূমিকা ছিল না। যারা গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত করার ক্ষেত্রে কোনো ‘রিস্কি’ ভূমিকা পালন করে নাই। এসব অশিক্ষিত বুদ্ধিজীবীরা সবচেয়ে বেশি জুলাই পূজারি আকারে হাজির হবে এবং নিজের অনুগত দলকে বা মতাদর্শকে জুলাই ক্রেডিট দেওয়ার জন্য প্রচণ্ড নিষ্ঠার সঙ্গে সত্যের বিকৃতি ঘটাতে থাকবে।

এরা যেই দলের বয়ান তৈরির কাজ করবে সেই দলই লীগের উত্তরাধিকার হয়ে উঠবে। জুলাইকে আমরা পূজা দেওয়া ও দলীয় বয়ানের বাইরে রাখতে চাই। এটা কালেকটিভ জাতীয় ফেনোমেনা। ক্রেডিট শুধু শহীদদের। জীবিতদের আছে শুধু দায়িত্ব। এমনকি এত দ্রুত জুলাইকে আমরা ইতিহাস করে তুলতে চাই না। জুলাইকে আমরা লিভিং প্রেজেন্ট রাখতে চাই। কারণ জুলাইয়ের রাজনৈতিক অঙ্গীকার এখনও বাস্তবায়ন শুরু হয় নাই। এটাকে ইতিহাস করে দলের ক্রেডিট দখলের জুয়ার তাসে পরিণত করতে চায় যারা তারা কোনো বুদ্ধিজীবী না। সিম্পল রেটরিক্যাল, অশিক্ষিত ফটকা।

‘ইন দ্য রং সাইড অব হিস্ট্রি’তে কেউ অবস্থান নেন । কেউ যদি জনগণের উইল বা আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে থাকে তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত জনগণকেই নিতে দিন। আপনি তার হয়ে রায় দিয়ে দিলে বিপদ হবে। ৭১ কে বা ২৪ কে ডিনাই করার বিষয়ে আপনি হাইপার সেনসেটিভ না হলেও হবে। বা ২৪ কে দিয়ে ৭১ এর পাপকে প্রলেপ দেওয়ার রাজনীতি যারা করছে তাদের বিষয়েও জনগণকে সিদ্ধান্তকে নিতে দিন। কিন্তু জনগণের হয়ে আপনি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলে, আপনি জনগণের চেয়ে স্মার্ট হয়ে গেলে, জনগণ অশিক্ষিত তারা ভুল করে ফেলবে, যোগ্য ও আসল চেতনাধারীকে চিনতে পারবে না। ৭১-এর রাজাকার বা ২৪-এর যোদ্ধাকে চিনতে পারবে না- ফলে আপনাকে এটা ঠিক করে দিতে হবে- আপনি এমনটা মনে করলে আপনি আসলে খুবই নিকৃষ্ট মানের ফ্যাসিস্ট। আপনি গণতন্ত্রকে বুঝেন আপনার ‘স্বার্থের’ আলোকে। আপনি লীগবিরোধী লীগার। মনে রাখতে হবে- আপনি বিজয়ী হওয়ার পরও হেরে যাবেন যদি শত্রুর খাসিলত আপনার মধ্যে থেকে যায়।

এবার আসল পয়েন্টে আসি। যেউ যদি ৭১ বা জুলাই ডিনাই করে– তা হলে কী হবে? সে বা তারা কি কোনো রাজনৈতিক বা নাগরিক হিসেবে থাকার অধিকার নিয়ে টিকে থাকার সুযোগ নাই? আপনি যদি মনে করেন নাই- তাইলে আপনি ট্রাইবাল যুগে পড়ে আছেন। নাগরিক অধিকারভিত্তিক রাজনীতির বিষয়টা আপনি বুঝেন গোত্রভিত্তিক আবেগ দিয়ে। ইতহাসের কোনো বিষয়ে একটা দলের বা নাগরিকদের মত ভিন্নতা তার টিকে থাকার বা অধিকার নিয়ে থাকার জন্য কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে।

আপনাদের কী মনে হয়? একটা ঘটনার বহু রকম ব্যাখ্যা থাকে, তার সঙ্গে কেউ দ্বিমত হলে আপনি যখন তাকে সেই ঘটনার ডিনায়াল হিসেবে চিহ্নিত করে তাকে আদারিং বা অপর করেন তাকে আপনি জাতীয় শত্রু করে তুলবার প্রক্রিয়া শুরু করেন, দমনযোগ্য করে তুলেন। এটাই বাংলাদেশে করেছিল- আওয়ামী লীগ। এটাই করা হয় গ্লোবাল জায়নিস্ট পলিটিক্সের বয়ান তৈরির বেলায়। আপনি ঠিক এই কাজটাই করলেন কাউকে জুলাই ডিনায়াল বলার মাধ্যমে।

আমি আশিস নন্দীর একটা বই একবার ফুটপাত থেকে কিনেছিলাম। বইটার নাম: TRADITIONS TYRANNY AND UTOPIAS: ESSAYS IN THE POLITICS OF AWARENESS.

এই বইটার ভূমিকা লিখেছেন বিখ্যাত ফরাশি দার্শনিক (Roger Garaudy) রজার গারোডি। ছোট্ট ভূমিকা কিন্তু তাতে তিনি যেসব কথা লিখেছেন তা পড়েই মনে হয়েছিল এই লোক জিনিয়াস। তকে পড়তে হবে। পরে উনার আরও কাজ পড়তে গিয়ে দেখি- পুরাই বিপ্লবী লোক। তার বিখ্যাত অনেক কাজ আছে। তিনি জেলেও খেটেছেন। শেষ জীবনে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত এক বইতে তিনি ষাট লাখ ইহুদির গণহত্যাকে ‘মিথ’ বলে দাবি করেন। এজন্য ফরাশি আইনে তাকে হলোকাস্ট ডিনায়ালকারী বা অস্বীকার করার জন্য কয়েক বছরের কারাদণ্ড দেয়।

তার বিখ্যাত বই, The Founding Myths of Modern Israel-এতে হলোকাস্টের বয়ানকে তিনি চ্যালেঞ্চ করেন। তাকে করাগারে পাঠিয়ে দিয়ে বইটিও নিষিদ্ধ করা হয়। বইটাতে তিনি কোথাও নাৎসিরা যে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে তা অস্বীকার করেন নাই। বরং ফরাশি আদালত তার মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেছে। গারোডি আদালতে বলেন, তিনি নাৎসি জাতীয় সমাজতন্ত্রকে সমর্থন করেন না। তিনি মূলত দেখিয়েছেন, হলোকাস্টকে ইসরাইল কিভাবে জায়োনিস্ট প্রকল্প কায়েমের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে এবং প্রকৃত ঘটনার একটা ফিকশনাল ওমিথিক্যাল বয়ান হাজির করে; যার সঙ্গে সত্যের কোনো সম্পর্ক নাই। ফিলিস্তিনের ওপর গণহত্যা চালানোর অজুহাত হিসেবে এই হলোকাস্টকে জায়নিস্টরা ব্যবহার করে। এটাই ছিল তার আলোচনার বিষয়; কিন্তু এটাকে বানিয়ে দেওয়া হলো– হলোকাস্ট ডিনায়াল।

তার আপিল খারিজ করে তাকে করাগারে পাঠানো হয়। অবশ্য এর আগে ‘দ্য কেস অব ইসরাইল: আ স্টাডি অফ পলিটিক্যাল জায়োনিজম”’(১৯৮৩) বইতে, গারোডি জায়োনিজমকে একটি সন্ত্রাবাদী মতাদর্শ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং এটা কিভাবে পলিটিক্যাল ট্রুথ ও আবেগ উসকে দিয়ে ফিলিস্তিনের জনগণের ওপর গণহত্যার লজিক তৈরি করে দেখিয়েছেন।

এখন বাংলাদেশেও আপনি যদি আপনার ৭১-এর বয়ান বা আপনার তৈরি ২৪-এর বয়ান কেউ না মানে আপনি তাকে ডিনায়ালকারী হিসেবে যখন চিহ্নিত করেন তখন ঠিক জায়োনিস্ট রাজনীতিই করেন। মনে রাখতে হবে ৫ তারিখের পর আমরা পোস্ট ন্যারেটিভ যগে চলে গেছি। আমরা আর কোনো একক ন্যারেটিভ বা বয়ানের আলোকে দেশকে, দেশের জনগোষ্ঠীকে দেখি না। নাগরিকদের দেখি না। আমরা দেখি সে অন্যায়কারী নাকি নিরপরাধী। তার কোন কিছু স্বীকার ও অস্বীকার করার ওপর তার রাজনৈতিক ও নাগরিক মর্যাদা নির্ভর করলে আপনি দ্রুতই তাকে হত্যাযোগ্য করে তুলতে পারবেন। এজন্য নাগরিকভিত্তিক রাজনীতিতে কোনো একক বা গ্রান্ড ন্যারেটিভ ও মতাদর্শকে আমরা রাষ্ট্র পরিচালনায় দেখতে চাই না। রাষ্ট্র হবে- ভ্যালু বেইজড। রাষ্ট্র ভ্যালু প্লুরালিটি করবে। কিন্তু করাপ্ট অশিক্ষিত ও ছদ্দ বুদ্ধিজীবীরা সব সময় সমাজকে মতাদর্শগতভাবে বিভক্ত করেছে। এই কারণে আমাদের দেশ জাতী হয়ে উঠবার বদলে কয়েকটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে রয়েছে। আর বুদ্ধিজীবীরা এই ধরনের ফ্যানাটিক প্রবণতা তৈরিতে অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখছেন। একক মতাদর্শ না ভিন্নতার মধ্যে ঐক্য। সব মানুষের অধিকার নিছিন্ত হচ্ছে কিনা সেটাই প্রধান বিবেচনা। সব মানুষ আপনার মতোন চিন্তা করে কিনা। আপনার ইতিহাসের বয়ানে ইমান রাখে কিনা- এটা দেখবার দরকার নাই। পলিটিক্যাল ইউজ অব দ্য পাস্ট খুবই ভয়ঙ্কর। হিস্ট্রিসিটিকে একটা পুলিশি প্রকল্প আকারে নেওয়ার মধ্য দিয়ে পাশের দেশে কিভাবে উগ্র হিন্দুত্ববাদ সমাজকে ছেয়ে ফেলেছে তা আমাদের মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করা দরকার। এটা আমাদেরও অনেক ক্ষতি করেছে। আমরা ইতিহাসকে দেখি- ট্রুথফুল কালেকটিভ স্পিরিট আকারে। কোনো দল বা ব্যক্তির মধ্যে আমরা ইতিহাসকে দেখি না। আমরা জাতীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য ইত্যাদির বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন পজিশনকে সম্মান করি। আমাদের এই ভিন্নতার মধ্যে ঐক্যই- আমাদের শক্তি। মনে রাখতে হবে-

‘Once man loses his faculty of indifference he becomes a potential murderer.’

-E. M Cioran.

( বই: A Short History of Decay)

যে কোনো ইভেন্ট বিষয়ে পজিশনের বিষয়ে এসব ছদ্ম চিন্তকদের উত্তেজক উসকানি আপনাকে দ্রুত পক্ষে-বিপক্ষে বিভক্ত করে ফেলবে। আমাদের মনে করাখতে হবে আপনার কোনো কিছু ডিনায়াল বা স্বীকার করায় কিছু যায় আসে না। আপনি একটা বা দুইটা জাতীয় ইভেন্টে কি পজিশন নিলেন তাতে আপনার জাতীয় ইতিহাস তৈরি হয় না। ইভেন্ট বা ঘটনা আর ইতিহাস এক না। ইতিহাসের জন্য একটা ইউনিভাসাল অবস্থান লাগে। সেটা অনেক ইভেন্ট নিলে তৈরি হয়। একটা দুইটার আলোকে জাতিকে যারা নেমিং করতে চায় এরা ক্ষমতার জন্য জাস্ট অতীতকে ব্যবহার করে। তারা জাতীয় ইতিহাসের মুক্তি ঘটায় না। আপনার মনে রাখতে হবে, আরব জাতীয় ইতিহাস, চীন জাতীয় ইতিহাস কিভাবে গড়ে উঠেছে। কোনো বিশেষ ইভেন্ট পূজা করে না। জাতীয় আত্ম-শক্তির দার্শনিক বিকাশের ওপর ভর করে ইতিহাস গড়ে ওঠে। একক মতাদর্শ গত বয়ানে ট্রুথফুলনেস থাকে না। যেটা সোভিয়েত আমলের ইতিহাস প্রকল্প করতে গিয়ে ফেইল করেছে। ইতিহাসের মূল চালিকাশক্তি হলো স্পিরিট; যা একটা গ্লোবাল-সিভিলাইজেশনাল প্রকল্প। হেগেল যেটাকে ইতিহাসের ইঞ্জিন বলেছেন- যা আমাদের নাই। ইতিহাসের নামে ইভেন্ট পূজার এই সংষ্কৃতি আমাদের দিন দিন আরও বিভক্তি করছে। এটা নিয়ে আমাদের সিরিয়াসলি কাজ করতে হবে। ২৪-এর পর এ সুযোগ আমাদের সামনে হাজির হয়েছে। বাংলাদেশি পরিচয়টিকে একটি সভ্যতাগত ভিত্তি দেওয়ার চিন্তাশীল কাজ আমাদের করতে পারতে হবে। বিশ্ব বাঙালির একটাই দেশ। জাতি, ধর্ম, গোত্র, লিঙ্গ যাই হোক, আপনি পৃথিবীর যে দেশেই থাকেন- বাংলাদেশ আপনার একটা সিভিলাইজেশনাল আইডেনটিটি যেন হতে পারে। তেমন একটা ট্রান্স ন্যাশনাল জাতীয় ইতিহাসের পরিচয় আমাদের লাগবে। ইরান, চীন, ভারত, আরব– এদের যেমন আছে। এটা না হলে সেই আন্তর্জাতিক দুনিয়াতে সম্মানের আসনে আমরা পৌঁছতে পারব না। মাল্টিপোলার দুনিয়ায় আমরাও যদি একটা পোল হতে চাই তাহলে আমাদের এই জাতীয় ইতিহাসের প্রকল্পকে কয়েকটা ইভেন্ট পার হয়ে গ্লোবাল হয়ে উঠতে পারতে হবে। জাতীয় ইতিহাসের মুক্তি না হলে জাতি তৈরি হয় না। জাতীয় মুক্তি আসে না। এগুলো নিয়ে লম্বা আলাপ দিতে হবে।

তবে আপাতত জরুরি হলো- আপনি অধিকার পাচ্ছেন কিনা? রাষ্ট্র আপনার নাগরিক অধিকার দিচ্ছে কিনা- এটা জরুরি। আপনি কী বিশ্বাস করেন, কী অস্বীকার করেন- এটা জরুরি না অন্যের জন্য। আপনি সব স্বীকার করলেন আর দিন দিন করাপ্ট পলিটিক্যাল ক্যাডার বাহিনী শক্তিশালী হলো এবং রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করল তখন আপনাকে দ্রুতই শত্রু  বানিয়ে ফেলবে। বাংলাদেশের সর্বনাশের জন্য এসব ফ্যানাটিক বুদ্ধিজীবীদের উসকানিতে পা দেওয়া যাবে না। কোনো মতাদর্শ মানুষের জীবনের চেয়ে মূল্যবান হতে পারে না। মতাদর্শ পূজারিরা মানুষকে মতাদর্শগতভাবে চিহ্নিত করে হত্যা যোগ্য করে তুলেন। আমাদের সব বিভাজন ও মত-ভিন্নতাসহ একসঙ্গে থাকার আর্ট অর্জন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, টলারেন্সি ফার্স্ট, ডেমোক্রেসি সেকেন্ড। জাতি মানে, রাষ্ট্র মানে, বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য। নিজের বয়ানের দাস যারা আপনাকে বানাতে চায়- মনে রাখবেন তারা আপনাকে হত্যাযোগ্য করে তুলতে চেষ্টা করছে।