নারায়ণগঞ্জে ৬০ দিনে ৯ খুন
নারায়ণগঞ্জে ৬০ দিনে ৯ খুন

- আপডেট সময় : ০৪:৫২:৪১ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৮ জুলাই ২০২৫
- / ২১ জন পড়েছেন
সাব্বির হোসেন
গত দুই মাসে নারায়ণগঞ্জ জেলায় অন্তত ৯টি খুনের ঘটনা সরাসরি গণমাধ্যমে এসেছে, যা জেলা পুলিশের চোখ এড়িয়ে যায়নি। এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে রয়েছে পারিবারিক কলহ, জমি সংক্রান্ত বিরোধ, চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তার এবং কিছু ক্ষেত্রে সন্দেহজনকভাবে পরিকল্পিত গুমের পর লাশ ফেলে দেওয়ার মতো ঘটনা। জেলার সাধারণ মানুষ ক্রমাগত এক ভয় আর অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।
খুনের ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এই আটটি খুনের মধ্যে ২টি হত্যা জমি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে হয়েছে। ৩টি হত্যা ছিল পারিবারিক দ্বন্দ্ব বা ব্যক্তিগত শত্রুতার ফল। ২টি ঘটনা পরিকল্পিত গুমের পর হত্যা বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ও চাঁদাবাজির ইঙ্গিত রয়েছে।
সোনারগাঁয়ের যুবককে গুম ও পরে লাশ উদ্ধার:
গত মাসে সোনারগাঁয়ের ভারগাঁও এলাকার ওলামা নগর খালপাড় বেরিবাঁধের পূর্ব পাশ থেকে রতন নামে এক যুবকের লাশ উদ্ধার করে সোনারগাঁ থানা পুলিশ। নিখোঁজের চারদিন পর তার লাশ উদ্ধার হয় শীতলক্ষ্যা নদী থেকে। পরিবারের দাবি, তিনি রাজনৈতিক গ্রুপের অভ্যন্তরীণ বিরোধের শিকার হন। স্থানীয় একটি চক্র তাকে তুলে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ ওঠে।
রূপগঞ্জে ব্যবসায়ী খুন:
চলতি বছরেরর গত ১০ জুন মাঝিপাড়া এলাকায় ভুলতা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সাব্বির হোসেন খোকাকে আটক করে স্থানীয় লোকজন। সেখানে যুবদল নেতা বাদলের অনুসারী কর্মী-সমর্থকরাও ছিলেন। ছাত্রলীগ নেতাকে বাদলের বাড়ির দিকে নেওয়ার পথে হামলা চালায় সাবেক ছাত্রদল নেতা জায়েদুল ইসলাম বাবু ও তার সমর্থকেরা। পরে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় বাবু ও সমর্থকরা আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি চালালে ব্যবসায়ী মামুন গুলিবিদ্ধ হয়। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
জমিজমা নিয়ে আপন ভাইয়ের হাতে ভাই খুন:
আড়াইহাজারে জমি নিয়ে দীর্ঘদিনের বিরোধের জেরে বড় ভাই ছোট ভাইকে দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। ১০ জুলাই আড়াইহাজারের হাইজাদী ইউনিয়নে ঘটনাটি ঘটে। গ্রামজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। নিহতের স্ত্রী বলেন, “একই পেটের ভাই এতটা হিংস্র হতে পারে, ভাবতেও পারিনি।
নারায়ণগঞ্জ সদর এলাকায় এক তরুণীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে ডোবায় ফেলে দেওয়া হয়:
গত মাসের ১২ জুলাই রিয়া নামের এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করা হয় সদর এলাকার বাবুরাইলের ডোবা থেকে। প্রেমের সম্পর্কের টানাপোড়েনকে কেন্দ্র করে এ ঘটনা ঘটে বলে পুলিশের ধারণা। নিহত তরুণীর পরিবারের অভিযোগ, অভিযুক্ত যুবক পূর্বে হুমকি দিয়েছিল।
সিদ্ধিরগঞ্জে স্বামীর হাতে স্ত্রী খুবঃ
গত ২৫ জুলাই রাত ১১টায় নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ১ নম্বর ওয়ার্ডের মিজমিজি বাতেন পাড়া ক্যানেল পাড় এলাকায় ইতি আক্তার নামে এক গৃহবধূকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে তার স্বামী বিল্লাল হোসেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনকার সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো পরিকল্পিত গুম ও পরে লাশ ফেলে দেওয়ার প্রবণতা। এর মধ্যে কিছু ঘটনার সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী মহলের নাম জড়ালেও তা প্রকাশ্যে আসে না। একাধিক ঘটনার ক্ষেত্রে ভিকটিমকে প্রথমে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, পরিবার থানায় অভিযোগ করতে গেলে মামলা নিতে গড়িমসি করে পুলিশ। এরপর কয়েকদিন পরই পাশের নদী বা জলাশয় থেকে লাশ উদ্ধার হয়।
একজন সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অন্য সময়ের চেয়ে গুমের পর লাশ ফেলে যাওয়ার ঘটনা বেড়েছে। কিছু ঘটনা আন্তঃদলীয় কোন্দল বা অর্থনৈতিক দ্বন্দ্বের ফল। তবে সব ক্ষেত্রে প্রমাণ পাওয়া কঠিন।
নারায়ণগঞ্জ শহরের দেওভোগ এলাকার বাসিন্দা শারমিন আক্তার বলেন, আমার স্বামী কয়েকদিন আগে এলাকার একটি সন্ত্রাসী গ্রুপের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিল। এরপর থেকেই আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। প্রতিদিন খবর দেখি, কে কখন গুম হয়ে লাশ হয়ে ফিরছে, কে জানে আমাদের সঙ্গেও এমন কিছু হবে না।
অভিযোগ রয়েছে, বেশ কয়েকটি খুনের ঘটনায় অভিযুক্তদের নাম উঠলেও তারা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। এমনকি, খুনের মামলার আসামিদের অনেকে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকায় গ্রেফতার হচ্ছে না। স্থানীয় সাংবাদিক সমাজের অনেকে বলছেন, এখানে খুনের বিচার না হলে খুন বাড়বে।
সদর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নাসির হোসেন একাধিক ঘটনায় গণমাধ্যমকে বলেছেন, তদন্ত চলছে এবং অপরাধীদের গ্রেফতারে চেষ্টা অব্যাহত আছে। তবে বাস্তবতা হলো, অধিকাংশ খুনের ঘটনায় এখনো চার্জশিট দাখিল হয়নি।
এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাহমুদুল হাসান বলেন, নারায়ণগঞ্জে রাজনীতি ও অপরাধের যে মিশ্রন, তা দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে। কিছু গোষ্ঠী রাজনৈতিক পরিচয় ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। প্রশাসনের নির্লিপ্ততা তাদের আরও সাহসী করে তুলছে।
এই হত্যাকাণ্ডগুলো নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় নারায়ণগঞ্জ-ভিত্তিক অনেক গ্রুপে এ নিয়ে সরব আলোচনা চলছে। কেউ বলছেন, এখন লাশ না পড়লে পুলিশ নড়ে না। আবার কেউ লিখেছেন, নারায়ণগঞ্জ এখন খুনের শহর!
একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, খুনের ঘটনার শিকার পরিবারগুলো দীর্ঘ সময় ধরে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু জেলা পর্যায়ে নেই কোনো মানসিক সহায়তা কেন্দ্র বা কাউন্সেলিং সেবা। ফলে অনেক পরিবার নিজ গরজে ঢাকায় গিয়ে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হয়।
খুন ও গুমের অধিকাংশ চার্জশিট দিতে দেরি হওয়ার কারনণ জানতে নারায়ণগঞ্জ জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তারেল আল মেহেদীকে মুঠোফোন করলে তিনি জানায়, বিভিন্ন মামলা বিভিন্ন রকমের হয়। কিছু মামলা ক্লুলেস হওয়ার কারণে তদন্ত করতে দেরি হওয়াতে অধিকাংশ সময় চার্জশিট দিতে দেরি হয়।
নগরীর সচেতন নাগরিকদের ভাষ্যমতে, নারায়ণগঞ্জে খুন যেন এখন আর শুধু অপরাধ নয়, বরং একটি প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া বাস্তবতা। প্রশাসন থেকে শুরু করে স্থানীয় নেতৃত্ব, কারোই ভূমিকা সন্তোষজনক নয়। অপরাধীরা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থেকে পার পেয়ে যাচ্ছে এমন ধারণা শক্ত হচ্ছে দিনদিন। এখনই যদি এই হত্যাকাণ্ডগুলোর বিচার ও প্রতিরোধে কঠোর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে নারায়ণগঞ্জের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়ে উঠবে, এবং সাধারণ নাগরিকেরা এক ভয়ংকর অনিশ্চয়তার মধ্যে বাঁচতে বাধ্য হবেন।