প্রশাসনের নাকের ডগায় ভুয়া দাঁতের চিকিৎসকদের দৌরাত্ম্য

- আপডেট সময় : ০৬:৫৩:৫২ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৯ জুন ২০২৫
- / ১১৯ জন পড়েছেন
কেউ মাধ্যমিক আবার কেউ উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেই বনে গেছেন দন্ত চিকিৎসক। আবার কারো নেই ন্যূনতম পড়াশোনাও। এত কিছুর পরেও দিব্যি চেম্বার খুলে চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন এসব ভুয়া চিকিৎসকেরা। প্রশাসনের নাকের ডগায়, খোদ নারায়ণগঞ্জের শহরেই হচ্ছে চিকিৎসার নামে প্রতারণা। নারায়ণগঞ্জ শহরের কালিরবাজারে চিকিৎসক নামধারী সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র এবার দন্ত চিকিৎসার বাহারি সাইনবোর্ড ও অস্তিত্বহীন পদবী দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। এসব ভুঁইফোড় দন্ত চিকিৎসকদের দৌরাত্ম্য দিন দিন বেড়েই চলছে। আর এতে সর্বস্বান্ত হচ্ছে রোগী ও তার স্বজনরা। জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জের অলিগলিতে ভুয়া দন্ত চিকিৎসকরা চেম্বার খুলে সাধারণ মানুষকে চিকিৎসার নামে প্রতারণা করছে। সেই সাথে হাতিয়ে নিচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। এসব দন্ত চিকিৎসকের নেই স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানের কোন ডিগ্রি । নেই বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) সনদও। আছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত চেম্বার ও ভুয়া ডিগ্রি সংবলিত বাহারি সাইনবোর্ড। শহরের বিভিন্ন স্থানে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে শতাধিক ডেন্টাল ক্লিনিক খুলে ভুয়া চিকিৎসক সেজে রোগীদের সাথে প্রতারণা করে যাচ্ছে যুগযুগ ধরে। চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা জানান, শুধু ওষুধের পরামর্শপত্র লিখে দেয়ার জন্য রোগীদের কাছ থেকে ভিজিট নেওয়া হচ্ছে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। আর দাঁতের সামান্য কাজের জন্য নেন হাজার হাজার টাকা। এইসব চিকিৎসকদের অধিকাংশই ভুয়া। অনেকেই ভুয়া সনদ নিয়ে দন্ত চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন। সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ডেন্টাল ডিপ্লোমা পাস করে অনেকে নামের আগে সরাসরি চিকিৎসক বা ডাক্তার পদবী ব্যবহার করে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন জায়গায় ব্যবসা করছেন। অথচ ন্যূনতম ব্যাচেলর অব মেডিসিন, ব্যাচেলর অব সার্জারি (এমবিবিএস) বা ব্যাচেলর অফ ডেন্টাল সার্জারি (বিডিএস) ডিগ্রি ছাড়া অন্য কেউ তাদের নামের আগে ‘ডাক্তার’ পদবি ব্যবহার করতে পারবেন না বলে রায় দিয়েছে হাইকোর্ট।
চলতি বছরের ১২ মার্চ হাইকোর্টের বিচারপতি রাজিক আল জলিল ও বিচারপতি সাথীকা হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত দ্বৈত বেঞ্চ এ রায় দেন।
সংক্ষেপে, এই রায়ের মূল বিষয়গুলি হলো:
* শুধুমাত্র যাদের এমবিবিএস অথবা বিডিএস ডিগ্রি আছে, তারাই নামের আগে “ডাক্তার” বা “চিকিৎসক” পদবি ব্যবহার করতে পারবে।
* অন্য কোনো ডিগ্রি বা কোর্স সম্পন্নকারীরা এই পদবি ব্যবহার করতে পারবে না।
* যদি কোনো ব্যক্তি এই নিয়ম ভঙ্গ করে, তবে সেটি আইনত দ-নীয়।
সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান চিকিৎসা শাস্ত্রে সনদ ও নিবন্ধনপত্র দিতে পারে না।
সূত্রে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জে দিন দিন ভুয়া চিকিৎসকের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আর দাঁতের চিকিৎসার মতো উচ্চমূল্যের খরচ কম খরচে করার আশায় এসব ভুয়া দন্ত চিকিৎসকদের রোগীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এমনকি দাঁতের চিকিৎসার মতো সংবেদনশীল চিকিৎসায় এ ভুয়া চিকিৎসকরা রোগীকে চিকিৎসা দেয়ার সময় যেসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেন তা জীবাণুমুক্তকরণের ব্যবস্থা না নিয়েই চিকিৎসা করছেন। ফলে রোগীর জীবাণুসংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। এর ফলে রোগীদের রক্তবাহিত বিভিন্ন রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়। জীবাণুমুক্তকরণ ছাড়াই অবাধে এক যন্ত্র একাধিক ব্যক্তির মুখে ঢোকানো হচ্ছে। এতে অনেকেরই দাঁত ভাল না হয়ে দাঁতের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে।
এসব ভুয়া চিকিৎসকের বিরুদ্ধে এখনই ব্যবস্থা নেয়া উচিত বলেও মন্তব্য বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) সনদপ্রাপ্ত ডাক্তারদের। নারায়ণগঞ্জে ব্যাঙের ছাতার মতো অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে প্রায় শতাধিক ডেন্টাল ক্লিনিক। নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা খেটে খাওয়া মানুষকে ধোঁকা দিয়ে দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞ ডাক্তার সেজে বিভিন্ন নাম সর্বস্ব ভুয়া ডিগ্রি দেখিয়ে সাইন বোর্ড, ব্যানার ও ভিজিটিং কার্ড ছাপিয়ে দাঁতের চিকিৎসার ব্যবস্থাপত্র দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। অনেক হাতুড়ে চিকিৎসক কোনো ডাক্তারের সাথে দীর্ঘ দিন কাজ করেছেন মর্মে এখানে এসে ক্লিনিক খুলে ডাক্তার সেজে কাজ করছেন। অথচ তারা ডেন্টাল সার্জন লিখে চিকিৎসাপত্র দিচ্ছেন। এ সব ভুয়া চিকিৎসক রোগীর দাঁতের স্কেলিং, দাঁতের ফিলিং, দাঁত তোলা, দাঁত বাঁধানোসহ দাঁতের নানা রোগের চিকিৎসার নামে হয়রানি করে টাকা কামিয়ে নিচ্ছেন।
শহরের কালিরবাজারে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় ৭-৮ বছর যাবৎ চিকিৎসা দিচ্ছেন এক ভুয়া দন্ত চিকিৎসক। এই চিকিৎসকের চেম্বারে রোগীও বেশ ভালো। মহিলা রোগীর সংখ্যাই বেশী। নাম-ডাকেরও কমতি নেই। চেম্বারে আসা এক রোগী বলছেন, অন্য ডাক্তারদের তুলনায় তাঁর চিকিৎসা ভাল। আরেক রোগী জানালেন, তিনি ভুয়া চিকিৎসক কিনা এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না। “মামুন ডেন্টাল সার্জারী” নামে ক্লিনিক খুলে চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছে বীরদর্পে। ভুয়া এই দন্ত চিকিৎসকের নাম আব্দুল্লাহ আল মামুন। নামের আগে সুকৌশলে ব্যবহার করছেন ডেন্টিস্ট। অথচ তার নেই স্বীকৃত কোন প্রতিষ্ঠান বা বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) কোন সনদ।
প্রায় শত বছরেরও বেশী সময় ধরে পারিবারিক উত্ত্বরাধীকার সূত্রে পাওয়া ডাক্তার হয়ে বসে আছেন আরেক ভুয়া দন্ত চিকিৎসক। দাদা থেকে বাবা, বাবা থেকে ছেলে সবাই ডাক্তার। রোগীও আসে নিয়মিত। কালিরবাজারে আছে বিশাল সাইনবোর্ড। নাম “এম.ঈ. আলী ডেন্টাল”। প্রতিষ্ঠানটির মালিক চিকিৎসক না হয়ে নিজেই উত্ত্বরাধীকার সূত্রে পাওয়া চেম্বার চালিয়ে যাচ্ছেন, দেখছেন রোগী, করছেন সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষা। মালিকের সঙ্গে কথা বলে চিকিৎসক না হয়েও কেন তিনি চিকিৎসা দিচ্ছেন এমন প্রশ্নের জন্য দীর্ঘসময় বসে থাকার পর সাংবাদিকের অবস্থান টের পেয়ে পালিয়ে যান এ ভুয়া চিকিৎসক। নাম ফায়েজ আলী। যদিও চতুর ও এককাঠি সরেস এ চিকিৎসক নিজের নামে কন ভিজিটিং কার্ড বা ব্যানার তৈরি করেননি। সাংবাদিক থাকা অবস্থায় তিনি যে চেম্বারে রোগী দেখছিলেন তা নিশ্চিত হওয়া গেছে চেম্বার থেকে বের হওয়া রোগীর সাথে কথা বলে।
কালিরবাজার সিরাজউদ্দৌলা রোডের কে.এফ টাওয়ারের নিচতলায় “নিঝুম ডেন্টাল কেয়ার”। প্রতিষ্ঠানটির চাকচিক্যই বলে দেয় ব্যবসা ভালো। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নামের আগে ডাক্তার লিখে দিব্যি চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। ভিজিটিং কার্ডে লেখা ডাঃ মোঃ নওশাদ আলী। অথচ তারও নেই কোন বিডিএস ডিগ্রি।
ডাক্তার না হয়েও কেনো লিখেন ডাক্তার সে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ডাক্তার না লিখলে রোগী আসবেনা তাই!
একই ভবনের দোতলায় বসেন আরেক ভুয়া ডাক্তার লিটন সরকার। তিনি আশরাফ ডেন্টালের মালিক আবার নিজেই চিকিৎসক। অথচ নেই কোন চিকিৎসকের ডিগ্রী!
নামের আগে দিব্যি ডাক্তার লিখা আরেক ভুয়া চিকিৎসকের সন্ধান পাওয়া যায় পাশের গলিতেও। ভিজিটিং কার্ডে নির্ধিদায় লিখে রেখেছেন ডাক্তার। এই ভুয়া প্রতারক ডাক্তারের নাম এম নজরুল হক খোকন। উনি নাকি বিএমডিসি (বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল) প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯৭৩ সালে তারও আগের ডাক্তার। তাই তার নাম বিডিএস এর তালিকায় আসেনি!
প্রেসিডেন্ট রোডে আছেন এমন আরেকটি ভুয়া ডাক্তার। যার নামের সাথে বেশ চতুরতার সাথে লিখেছেন “সিনিয়র দন্ত চিকিৎসক” সাথে “ডাক্তার” লিখতেও ভুল করেন নি। এই ভুয়া ডাক্তারের নাম “ডাক্তার মোঃ জসিম উদ্দিন”। তিনি কোন বিডিএসের ধারধারেন না। প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়েছেন “লাইফ হীট স্কয়ার ডেন্টাল”।
এমন প্রায় অর্ধশতাধিক ভুয়া ডাক্তার আর ক্লিনিক আছে খোদ শহরেই। শহরের পাশেই উত্তর চাষাড়ার চাঁনমারীর ফরিদা বিল্ডিংয়ের দক্ষিণ পার্শ্বে আছে “সেবা ডেন্টাল এন্ড ফার্মেসী” অথচ তার নেই কোন ড্রাগ লাইসেন্স কিংবা নিজের কোন বৈধ কাগজ।
নারায়ণগঞ্জের শহর থেকে গ্রামে , চারারগোপ থেকে মাসদাইর, ফতুল্লা, বিবি রোড থেকে বন্দর , আড়াইহাজার, রূপগঞ্জ সর্বত্র এ রকম অসংখ্য ভুয়া দন্ত চিকিৎসকে ভরে গেছে। তবে নজরদারি নেই প্রশাসনের।
এ বিষয়ে জেলা সিভিল সার্জন ডাঃ এ এফ এম মুশিউর রহমান জানান, ভুয়া চিকিৎসকদের ব্যাপারে নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে। তালিকা করা হচ্ছে। খুব দ্রুতই ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ড. জেনীথ ডেন্ট এর স্বত্বাধিকারী ফরহাদ আহমেদ জেনীথ জানান, দায়িত্বে যাঁরা আছেন তাদের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে শৈথিল্য আছে। এ ধরনের ভুয়া চিকিৎসকদের ধরতে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি তা বাস্তবায়নে ধীরগতি আছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, এসব ভুয়া চিকিৎসক ধরতে তাদের নির্বাহী ক্ষমতা নেই। যে কারণে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে প্রতারকেরা।
বাংলাদেশের প্রতিবছর লক্ষাধিক জনগণ দাঁতের ভুল চিকিৎসা ও অপ্রচিকিৎসার শিকার হচ্ছে, অনেকে মৃত্যুবরণ করছে! প্রধান কারণ হলো ভুয়া ডেন্টিস্ট বা ভুয়া দাঁতের ডাক্তার। দেশের আনাচে কানাচে গড়ে উঠা এসব ভুয়া ডাক্তারদের চেম্বারে চিকিৎসা নিয়ে অনেকেই নিজের অজান্তে এইডস, হেপাটাইটিস, ক্যান্সারের মতো মরণঘাতী রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এসব ভুয়া চিকিৎসকের কারণে জনস্বাস্থ্য হুমকিতে থাকলেও মাঠে নেই তদারকি।