গত আড়াই দশকে হাতবদল হলেও উদ্ধার হয়নি অবৈধ অস্ত্র
নারায়ণগঞ্জে বিশাল অস্ত্রভা-ার!

- আপডেট সময় : ০৮:৩০:৩৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ জুন ২০২৫
- / ৪৬ জন পড়েছেন
নারায়ণগঞ্জ অতীতের সেই সন্ত্রাসের জনপদ তকমা থেকে অনেকটাই বেরিয়ে এসেছে। অস্ত্রের রাজনীতির চর্চা অতীতের মতো না থাকলেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আশীর্বাদপুষ্ট সন্ত্রাসীদের কাছে এখনও রয়ে গেছে বিশাল অস্ত্রভা-ার। এর একটি ঝলক দেখা গেছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমনে শামীম ওসমান ও তার অনুসারীদের কর্মকা-ে। শত শত আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় শামীম ওসমান। পাঁচ আগস্টের পরেও নারায়ণগঞ্জে বিএনপির দলীয় কোন্দলে সংগঠিত সংঘর্ষে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার দেখা গেছে।
মূলত বিএনপির জোট সরকার আমলে পুলিশের সঙ্গে ক্রসফায়ারে শহরের দুই ডজন সন্ত্রাসী নিহত হলেও উদ্ধার হয়নি অস্ত্র। ক্রসফায়ারে নিহত এসব সন্ত্রাসীর প্রত্যেকেরই ছিল বিশাল অস্ত্রভা-ার। এদের বেশিরভাগ অস্ত্রই বর্তমানে হাতবদল হয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ক্যাডার ও ঝুট সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণে আছে।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে এদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ছিলেন শহরের মিশনপাড়ার যুবদল নেতা মমিনউল্লাহ ডেভিড। দুর্র্ধষ ডেভিডের ছিল বিশাল ক্যাডার বাহিনী। এছাড়াও তার কাছে ছিল বিশাল অস্ত্রের ভা-ার। সেসময় অত্যাধুনিক সব অস্ত্র ডেভিড ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী ব্যবহার করত বলে জানা গেছে। ২০০৪ সালে র্যাবের সঙ্গে ক্রসফায়ারে নিহত হন ডেভিড। তবে ডেভিডের মৃত্যুর পর তার অস্ত্রভা-ারের খোঁজ মেলেনি। উদ্ধার হয়নি সেই অস্ত্র।
প্রায় কাছাকাছি সময়ে ঘটে নারায়ণগঞ্জে তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে আলোচিত হত্যাকা-। নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক তৈমুর আলম খন্দকারের ছোট ভাই ও ব্যবসায়ী নেতা সাব্বির আলম খন্দকারকে নিজ বাড়ির সামনে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।
২০০৪ সালে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের ঘোষণার পরই বদলে যেতে শুরু করে নারায়ণগঞ্জের দৃশ্যপট। ঘোষণার পর থেকে স্থানীয় দুর্র্ধষ সন্ত্রাসীদের সঙ্গে র্যাব আর পুলিশের বন্দুকযুদ্ধে ক্রসফায়ারে মারা যেতে শুরু করে একের পর এক সন্ত্রাসী। জেলার আলোচিত কুখ্যাত কিলার, ৪০টি খুনসহ অর্ধশতাধিক মামলার আসামি রকমত, পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ক্রসফায়ারে মারা যাওয়ার মধ্য দিয়ে নারায়ণগঞ্জে পুলিশ ক্রসফায়ারের খাতা খোলে। একে একে ক্রসফায়ারে পড়ে মারা যান ৩৭ মামলার আসামি জেলার আলোচিত শীর্ষ সন্ত্রাসী ও যুবদল ক্যাডার মমিনউল্লাহ ডেভিড, আদমজীর কদমতলী এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী ও বিএনপি ক্যাডার মিনিস্টার শাহ আলম, যুবলীগের নজরুল ইসলাম, আদমজীর যুবলীগ কর্মী শফিকুল ইসলাম, আদমজীর শীর্ষ সন্ত্রাসী ও যুবলীগ ক্যাডার রগ কাটা জাফর, ফতুল্লার বিএনপি সন্ত্রাসী রুবেল, অস্ত্র ও মাদক ব্যবসায়ী বিপ্লব এবং আলমগীর হোসেন, বন্দরের মকবুল, কেন্দ্রীয় কৃষক লীগ নেতা টাওয়ার সেলিম, আবদুল্লাহ আল মামুন, কিলার রুবেল, আড়াইহাজারের কুখ্যাত ডাকাত সর্দার রওশন, জাকির খানের সহযোগী আহাদ, ফতুল্লার শীর্ষ সন্ত্রাসী ইবু বাহিনীর প্রধান ইবু, ডাকাত দানিয়েল, রওশন, রূপগঞ্জে মোহাম্মদ আলী, বন্দরে সুমন, আবুল হোসেন, মাহে আলম বিপু, সিদ্ধিরগঞ্জে মামুন, মোহাম্মদ আলী, আবুল হোসেন প্রমুখ। এছাড়া আততায়ীদের হাতে খুন হয় পাগলার দুর্র্ধষ সন্ত্রাসী তোফাজ্জল। ২০০৫ সালের ২১ জুন স্থানীয় বিএনপি নেতা বিপ্লব ও আলমগীর হোসেনের কাছ থেকে একে-৪৭, নাইন এমএমসহ অত্যাধুনিক অনেক অস্ত্র উদ্ধারই বলে দিয়েছিল—নারায়ণগঞ্জে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র রয়েছে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসলে এসব অস্ত্রভা-ার চলে যায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হাতে। অস্ত্র নিয়ে নারায়ণগঞ্জের ঝুট সেক্টর, লোহা ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেন আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা।
বিগত দশকে নারায়ণগঞ্জে অস্ত্রের রাজনীতির চর্চা কমে আসলেও নানান সময়ে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কার্যক্রমে বারবার জাতীয় গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে নারায়ণগঞ্জ।
২০১৭ সালের ৩ জুন রূপগঞ্জের পূর্বাচল আবাসিক এলাকার লেক থেকে প্রায় অর্ধশতাধিক এম-সিক্সটিন রাইফেল, রকেট লঞ্চার, মর্টারশেলসহ বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়।
২০১৮ সালের ১৭ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জে হকার উচ্ছেদকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে জড়ায় আওয়ামী লীগের দুই পক্ষ। এসময় সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীকে উদ্দেশ্য করে অস্ত্র তাক করে রাখতে দেখা যায় সাবেক যুবলীগ নেতা নিয়াজুলকে। শহরে শাহ নিজামসহ আওয়ামী লীগের বহু ক্যাডার সেদিন অস্ত্র নিয়ে গুলি ছুঁড়েছিলেন। মূলত ২০০৪ সালের পর এদিনই প্রকাশ্য দিবালোকে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের অস্ত্রের শোডাউন দেখেছিল নারায়ণগঞ্জবাসী। দুই পক্ষই অস্ত্র হাতে সংঘর্ষে জড়িয়েছিল সেদিন।
সর্বশেষ ২০২০ সালের ১ মার্চ এক বক্তব্যে আলোচনায় আসেন নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমান। জেলা পুলিশ লাইনে পুলিশ মেমোরিয়াল ডে ২০২০ উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে শামীম ওসমান বলেন, “আমি একটা কথা বলতে চাই। ইদানীং ওয়াজে যাই, অনেকে টিটকারি করে। ২ বেলা কোরআন শরিফ পড়ি। ২২ বছর ধরে তাহাজ্জুদ ছাড়ি নাই। ২০০১ সালের আগে আপনার টোটাল পুলিশ ফোর্সের কাছে যা অস্ত্র আছে, তার চেয়ে বেশি অস্ত্র আমার কাছে ছিল। ২০০১ সালের আগে আমার রাজনৈতিক দর্শন এক রকম ছিল।”
শামীম ওসমানের এমন বক্তব্যে সমালোচনা শুরু হলে ২ মার্চ সংবাদমাধ্যমে সেটির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে শামীম ওসমান বলেন, বক্তব্যে ২০০১ সাল উল্লেখ করলেও সালটি ভুল ছিল। মূলত এটি হবে ১৯৯১ সাল।
শামীম ওসমান জানান, স্বাধীনতাবিরোধীদের হামলা থেকে জীবন বাঁচানোর জন্য সেসময় অস্ত্র রাখতে হতো। তবে আমাদের হাতে কেউ মারা যায়নি। বরং আমরাই মারা গেছি হামলায়। মূলত ১৯৯১ সালে এরশাদ সরকারের পতন ও গণতন্ত্র কায়েমের পরই দলের নেতাদের নির্দেশে অস্ত্রগুলো জমা দেন বলে জানান শামীম ওসমান। তৎকালীন নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার মমিনউল্লাহ পাটোয়ারীর কাছে সর্বোচ্চ আনঅফিসিয়াল অস্ত্র জমা দেন তিনি।
নিজের সাফাই গাইতে গিয়ে সেসময় নানান বক্তব্য দিলেও শামীম ওসমানের কাছে থাকা অস্ত্রভা-ারের প্রমাণ মিলেছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে। নারায়ণগঞ্জে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক এমপি শামীম ওসমান ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা যে লঙ্কাকা- ঘটিয়েছেন, তা সিনেমার দৃশ্যকেও হার মানায়। হিন্দি অ্যাকশন ফিল্মের স্টাইলে স্বয়ংক্রিয় মেশিনগান, শর্টগান, পিস্তল নিয়ে আন্দোলন দমন করতে নারায়ণগঞ্জের রাজপথে নামেন শামীম ওসমান।
সাম্প্রতিক সময়ে সেসময়ের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে শামীম ওসমান ও তার পুত্র অয়ন ওসমানসহ আওয়ামী লীগের কয়েকশত নেতাকর্মীকে ফিল্মি স্টাইলে অস্ত্র নিয়ে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে দেখা যায়। সেদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে ছাত্র জনতার এই সংঘাত চলে।
একই দিন রাতে শামীম ওসমানের পুত্র অয়ন ওসমান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক শব্দের একটি স্ট্যাটাস দেন। স্ট্যাটাসে ইংরেজিতে তিনি লেখেন “কএঋ”। তার স্ট্যাটাসটি সংঘাতে অংশ নেওয়া আওয়ামী লীগের ক্যাডারদের অনেকেই সেদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করে ফলাও করে প্রচার করেছিলেন।
১৯ জুলাইয়ের সেই দিনটি ছিল শুক্রবার। জুমার নামাজের পর শহরের চাষাঢ়া নূর মসজিদ, ডিআইটি মসজিদসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ছাত্র জনতার কর্মসূচি শুরু করার কথা ছিল। জুমার নামাজের আগেই বঙ্গবন্ধু সড়কে অবস্থিত নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের ভেতরে ও নির্মাণাধীন ভবনে অবস্থান নিতে থাকে আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডাররা। জুমার নামাজ শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ আগে সেখানে উপস্থিত হন শামীম ওসমান ও তার পুত্র অয়ন ওসমান।
এদিকে ডিআইটি এলাকা থেকে জুমার নামাজ শেষে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে ছাত্র জনতা। চাষাঢ়া নূর মসজিদ থেকেও একটি মিছিল বের হয়ে চাষাঢ়ার দিকে যেতে থাকে। এমন সময় হঠাৎ নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের ভেতর থেকে হামলা চালায় আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা। মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সামনে অবস্থান নেয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
এসময় শামীম ওসমান ও তার বেয়াই সালাউদ্দিন লাভলু, ভিকি, তানভীর আহমেদ টিটু, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি হাবিবুর রহমান রিয়াদসহ আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের কয়েকশো নেতাকর্মী নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সামনে অবস্থান নেন। একসময় শামীম ওসমান ও তার অনুসারীরা পিস্তল, শর্টগান ও অটোমেটিক মেশিনগান দিয়ে গুলি ছুড়তে ছুড়তে ডিআইটি এলাকার দিকে অগ্রসর হন।
এসময় চাষাঢ়া থেকে ডিআইটি এলাকা পর্যন্ত চলমান এই সংঘাত ও গোলাগুলিতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন শামীম ওসমান। এসময় শহরের আলী আহমেদ চুনকা পাঠাগারের সামনে আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মী কোণঠাসা হয়ে পড়লে বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হন শামীম ওসমান। এক পর্যায়ে শামীম ওসমানকেও অটোমেটিক রাইফেল নিয়ে চুনকা পাঠাগারের সামনে মহড়া দিতে দেখা যায়।
জানা গেছে, গত ২৫ বছরে এসব অবৈধ অস্ত্রের বেশির ভাগই চলে গেছে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন রাজনৈতিক ক্যাডারদের কাছে। ক্রসফায়ারে নিহত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে পরিচিত শহরের অনেক চিহ্নিত সন্ত্রাসী এখনও বীরদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে অস্ত্রভা-ার হাতবদল হয়েছে। এখনও নারায়ণগঞ্জে সন্ত্রাসীদের কাছে এসব অবৈধ অস্ত্রের বিশাল ভা-ার সুরক্ষিত রয়েছে।