জনবলসংকটসহ নানা যুক্তি পুলিশ সুপারের
যানজট নিরসনে পুলিশের দ্বৈত আচরণ, ক্ষুব্ধ নগরবাসী

- আপডেট সময় : ০৮:০৪:২২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ জুন ২০২৫
- / ৩৫ জন পড়েছেন
নারায়ণগঞ্জ শহরের মানুষের জন্য যা নিত্যদিনের দুঃসহ ভোগান্তি, গতকাল রোববার তা-ই যেন এক মুহূর্তে উধাও হয়ে গেল। শহরের মন্ডলপাড়া থেকে নিতাইগঞ্জ পর্যন্ত অবৈধ ট্রাক স্ট্যান্ডের দৌরাত্ম্যে যে সড়ক স্থবির থাকে, সেই পথেই পুলিশের জাদুকরী তৎপরতায় ছিল স্বস্তির ছোঁয়া। তবে এই স্বস্তি নগরবাসীর মনে জন্ম দিয়েছে তীব্র ক্ষোভ আর প্রশ্নের। উপলক্ষ ছিল, বন্দরে জোড়া খুনের ঘটনাস্থল পরিদর্শনে জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) প্রত্যুষ কুমার মজুমদারের আগমন।
সাধারণ মানুষের একটাই প্রশ্ন, শুধু এসপি, অতিরিক্ত ডিআইজি বা সরকারের কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আগমনেই যদি পুলিশ শহরকে যানজটমুক্ত করতে পারে, তাহলে জনগণের জন্য প্রতিদিন কেন পারে না? পুলিশের এই দ্বৈত আচরণে প্রশ্ন উঠে, তাহলে কি জনগনকে ‘দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক’ ভাবতে শুরু করেছেন তাঁরা।
যদিও পুলিশ সুপার এমন অভিযোগ অস্বীকার করে যানজটের জন্য শহরের অতিরিক্ত ইজিবাইক, ভাঙাচোরা রাস্তা ও পুলিশের জনবলসংকটকে দায়ী করেছেন।
নারায়ণগঞ্জের বঙ্গবন্ধু সড়কের মন্ডলপাড়া থেকে নিতাইগঞ্জ পর্যন্ত অংশটি শহরের অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র। তবে সড়কের দুই পাশ দখল করে গড়ে ওঠা অবৈধ ট্রাক স্ট্যান্ডের কারণে এটি এখন নগরবাসীর কাছে এক দুঃস্বপ্নের নাম। দিনরাত শত শত ট্রাকে পণ্য ওঠানো-নামানোর কারণে এখানে তীব্র যানজট লেগেই থাকে। ভিক্টোরিয়া জেনারেল হাসপাতালে যাওয়া মুমূর্ষু রোগী, শিক্ষার্থী, অফিসগামী মানুষসহ লাখো নগরবাসী প্রতিদিন অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহান।
এই সমস্যা সমাধানে সিটি করপোরেশন একাধিকবার জেলা প্রশাসন ও পুলিশকে চিঠি দিয়েছে। হাইকোর্টের নির্দেশনা সত্ত্বেও কয়েকবার উচ্ছেদ অভিযান চালানো হলেও প্রভাবশালী সিন্ডিকেট ও অদৃশ্য শক্তির ইশারায় কয়েক দিনের মধ্যেই পরিস্থিতি আগের চেহারায় ফিরে আসে।
তবে, গতকাল রোববার চিত্র ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুমদারের আগমনের খবরে সকাল থেকেই নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানা ও ট্রাফিক পুলিশের ব্যাপক তৎপরতা দেখা যায়। আনা হয় রেকার (গাড়ি উদ্ধারের যন্ত্র)। যে পুলিশ সদস্যদের সড়কে কম দেখা যায়, তাঁরাই লাঠি হাতে যানজট নিরসনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। নিতাইগঞ্জের অবৈধ ট্রাক স্ট্যান্ড মুহূর্তেই উধাও হয়ে যায়। এসপির গাড়িবহর বিনা বাধায় গন্তব্যে পৌঁছায়। নগরবাসীর অভিযোগ, শুধু এসপি নন, পুলিশের ঊর্ধ্বতন যেকোনো কর্মকর্তার আগমনের দিনেই এমন ‘নাটক’ মঞ্চস্থ হয়।
পুলিশের এই বৈষম্যমূলক আচরণে ক্ষুব্ধ নগরবাসী। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিতাইগঞ্জের এক ব্যবসায়ী বলেন, “আমরা দিনের পর দিন যানজটে আটকে থেকে ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। হাসপাতালে যাওয়ার পথে অ্যাম্বুলেন্স আটকে থাকে। কিন্তু এসপি সাহেব আসবেন বলে সব ঠিক হয়ে গেল! এর মানে হলো, পুলিশ পারে না তা নয়, আসলে তারা আমাদের জন্য করতে চায় না। তাহলে কি আমরা এই দেশের প্রজা?”
অনেকেই মনে করছেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সামনে নিজেদের কর্মদক্ষতা জাহির করতে এবং শহরের আসল চিত্র আড়াল করতেই অধীনস্থ কর্মকর্তারা এই ‘চোখে ধুলো দেওয়ার মহড়া’ আয়োজন করেন।
এসব অভিযোগ ও নগরবাসীর ক্ষোভের বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুমদার বলেন, “আসলে এই শহরে ধারণক্ষমতার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি ইজিবাইকের পারমিশন দেওয়া হয়েছে। কারা দিয়েছে, সেটা আমি না বলি। এদের কারণেই মূলত যানজট। রাস্তাঘাটগুলোও মসৃণ নয়।”
‘ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আগমনের দিন এসব সমস্যা থাকার পরও যানজটমুক্ত রাখা সম্ভব হলে প্রতিদিন কেন সম্ভব নয়’-এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “আমি যখন মুভ করি (চলাচল করি), তখন অন্য জায়গার পুলিশও এখানে যুক্ত করা হয়। কিন্তু তাদের তো অন্য দায়িত্বও থাকে। শুধু যানজট নিরসন নয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজও করতে হয়। আমাদের জনবলসংকট রয়েছে। এত জনবল নেই, যা দিয়ে প্রতিদিন এই বিপুলসংখ্যক ইজিবাইক ঠেকানো যায়। এর জন্য সবার সম্মিলিত প্রয়াস দরকার, শুধু পুলিশকে ঢালাওভাবে দোষ দিলে হবে না।”
তবে একদিনের এই ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, নারায়ণগঞ্জের যানজট সমস্যা সমাধানের অযোগ্য নয়। পুলিশের জনবলসংকটের যুক্তি সত্ত্বেও ‘বিশেষ দিবসের’ এই তৎপরতা তাই নগরবাসীর মনে স্বস্তি নয়, বরং প্রশ্নকেই আরও জোরালো করছে-জনগণের দুর্ভোগ লাঘবে স্থায়ী সমাধানে আন্তরিকতার অভাব ঠিক কোথায়?