ঢাকা ০৬:১৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ০১ জুলাই ২০২৫, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :

নারায়ণগঞ্জে ফিটনেসবিহীন বাসের দৌরাত্ম্য

সোজাসাপটা রিপোর্ট
  • আপডেট সময় : ০৯:৩৪:৪৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ২২ জুন ২০২৫
  • / ৩৯ জন পড়েছেন

নারায়ণগঞ্জ শহর যেন আজ ফিটনেসবিহীন বাস, অবৈধ লেগুনা ও অসংগঠিত যানবাহনের নগরীতে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিনই শহরের রাস্তাগুলোতে তীব্র যানজট আর বিশৃঙ্খলার মুখোমুখি হচ্ছে সাধারণ মানুষ। এর পেছনে রয়েছে অবৈধ বাসস্ট্যান্ড, লাইসেন্সবিহীন চালক এবং প্রশাসনের নিরবতা। ফলে নাগরিক জীবনের গতি থেমে যাচ্ছে যানজট আর দুর্ভোগের জালে।
নগরজুড়ে চলছে ফিটনেস ও বৈধ কাগজপত্রবিহীন বাস, ট্রাক ও লেগুনার দৌরাত্ম্য। অভিযোগ রয়েছে, সম্প্রতি ঈদকে কেন্দ্র করে অবৈধভাবে নগরীতে ৩০টি নতুন বাস নামানো হয়েছে, যার একটিরও সঠিক রুট পারমিট নেই। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে এসব যানবাহনের বিরুদ্ধে কোনো দৃশ্যমান ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, নগরীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো—বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু সড়কের নিতাইগঞ্জ অংশ, ১নং রেলগেট, মেট্রো হলের মোড়, খানপুর ও চাষাড়ায় গড়ে উঠেছে একাধিক অবৈধ বাসস্ট্যান্ড। এসব জায়গায় ইচ্ছেমতো গাড়ি পার্কিং ও যাত্রী ওঠানামা করা হয়, প্রায় সময়ই রাস্তার মাঝখান দখল করে রাখা হয় বাস। এতে করে অন্যান্য যান চলাচল কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ে। এসব অবৈধ স্ট্যান্ডকে ঘিরে গড়ে উঠেছে চাঁদাবাজির বিশাল নেটওয়ার্ক। চাষাড়া ও ট্রাফিক পুলিশ ফাঁড়ির কতিপয় অসাধু সদস্য এবং প্রভাবশালী একটি মহল এর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত বলেও অভিযোগ উঠেছে।
নারায়ণগঞ্জের বাস সার্ভিসগুলোর তালিকা করলে দেখা যায়, এখানে অন্তত ২০-২৫টি কোম্পানি সক্রিয় রয়েছে। এদের মধ্যে সিটি বন্ধন, উৎসব পরিবহন, আনন্দ, হিমাচল, আল্লাহ ভরসা, দূরন্ত, বন্ধু ও বাঁধন পরিবহন অন্যতম। অধিকাংশ বাস কোম্পানির রুট পারমিট নেই, চালকদের বড় অংশের ড্রাইভিং লাইসেন্সও বৈধ নয়। এর পাশাপাশি শহরে দ্রুত বেড়ে উঠেছে লেগুনা সার্ভিস, যেগুলোর কাগজপত্র ও রেজিস্ট্রেশন নেই বললেই চলে। বেশিরভাগ লেগুনার চালকই অপ্রাপ্তবয়স্ক এবং ট্রাফিক আইনের কোনো তোয়াক্কা করেন না।
চাষাড়া থেকে সাইনবোর্ড, মোক্তারপুর, ফতুল্লা পর্যন্ত এইসব লেগুনা চলাচল করে একপ্রকার বেপরোয়াভাবে। যাত্রী নিরাপত্তা, সড়ক শৃঙ্খলা ও ট্রাফিক ব্যবস্থা এইসব যানবাহনের কারণে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে।
এই পরিস্থিতি নিয়ে নাম প্রকাশ নয়া করার শর্তে একজন ট্র্যাফিক কর্মকর্তা জানান, “ট্রাকস্ট্যান্ড, বাসস্ট্যান্ড ও লেগুনাগুলো থেকে পুলিশ এবং বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নামে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা চাঁদা তোলা হচ্ছে। অথচ পঞ্চবটি এলাকায় ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণ করা হলেও চালকেরা সেখানে যান না। রাস্তার উপরেই ট্রাক দাঁড় করিয়ে মাল লোড-আনলোড করা হচ্ছে।”
এদিকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাঝে মাঝে অভিযান পরিচালনা করা হলেও তা স্থায়ী সমাধান আনতে পারছে না। সর্বশেষ ১৮ ফেব্রুয়ারি চাঁদমারি এলাকায় জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে পরিচালিত এক অভিযানে ৪টি ফিটনেসবিহীন বাস আটক করা হয় এবং ৬টি মামলায় মোট ২৮ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। সিনিয়র সহকারী কমিশনার মোঃ মোনাব্বর হোসেনের নেতৃত্বে এই অভিযান চালানো হয়।
তিনি জানান, “ আগে মৌমিতা, আসিয়ান ও বন্ধু পরিবহনের বাসগুলোর রুট পারমিট ও ফিটনেস না থাকায় তা ডাম্পিং করা হয়েছিলো। এখন আর এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। শহরের ফিটনেসবিহীন বাস মনিটরিংয়ের জন্য এ ধরনের অভিযান নিয়মিত চালানো প্রয়োজন।”
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু অভিযান নয়—এই সমস্যা সমাধানে দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রভাবশালী মহলের চাঁদাবাজি বন্ধ এবং শহরজুড়ে সুপরিকল্পিত গণপরিবহন নীতি। অন্যথায় যানজট, চাঁদাবাজি আর ফিটনেসবিহীন গাড়ির দাপটে নারায়ণগঞ্জ শহরবাসীর দুর্ভোগ ক্রমেই বাড়বে।
গত ৭ মে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে শহরের যানজট নিরসন সংক্রান্ত এক আইনশৃঙ্খলা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় অংশ নিয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, রুট পারমিট ও ফিটনেসবিহীন সকল বাস ডাম্পিংয়ে দেয়া হবে। দ্রুত আপনারা এসকল বাস সরিয়ে নিবেন। আমরা এগুলো কোন ভাবেই ছাড় দেব না। আমরা কারও প্রতি রুষ্ঠ হতে চাই না। আপনারা আজকে সিদ্ধান্ত নিবেন কী পরিমান আনসার আপনাদের প্রয়োজন। এটা আজকের মধ্যে আপনারা আমাদের জানাবেন।
তিনি বাস মালিকদের উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনাদের আর কতবার বলতে হবে রাস্তায় বাসগুলো রাখবেন না। আপনি চেঞ্জ করুন, অটোচালকের কথা কেন আপনি বলবেন। চেম্বার অনেকগুলো প্রস্তাব দিয়েছে সেই প্রস্তাব নিয়ে আমরা কাজ করবো। আমরা তাদের প্রস্তাবগুলো দেখেছি। তারা খুব ভাল প্রস্তাব দিয়েছে। আমাদের প্রতিনিয়ত সমস্যা আসবে এবং তার সমাধান করতে হবে। তবে আমাদের আইনের আওতায় থেকে কাজ করতে হবে। আপনি যদি ভাবেন আবেগ দিয়ে আইনকে প্রভাবিত করবেন সে সুযোগ আইনেও নেই, আমার কাছেও নেই।’
সাধারণ মানুষের দাবি এখন একটাই, শুধু কথা নয় কাজ চাই। অবৈধ স্ট্যান্ড উচ্ছেদ, চাঁদাবাজি বন্ধ এবং প্রশাসনের কার্যকর নজরদারি—এই তিনটি পদক্ষেপ বাস্তবায়ন হলে তবেই হয়তো রাস্তায় নামতে স্বস্তি পাবে এই শহরের লাখো যাত্রী।

ট্যাগ :

সংবাদটি সোস্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন

নারায়ণগঞ্জে ফিটনেসবিহীন বাসের দৌরাত্ম্য

আপডেট সময় : ০৯:৩৪:৪৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ২২ জুন ২০২৫

নারায়ণগঞ্জ শহর যেন আজ ফিটনেসবিহীন বাস, অবৈধ লেগুনা ও অসংগঠিত যানবাহনের নগরীতে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিনই শহরের রাস্তাগুলোতে তীব্র যানজট আর বিশৃঙ্খলার মুখোমুখি হচ্ছে সাধারণ মানুষ। এর পেছনে রয়েছে অবৈধ বাসস্ট্যান্ড, লাইসেন্সবিহীন চালক এবং প্রশাসনের নিরবতা। ফলে নাগরিক জীবনের গতি থেমে যাচ্ছে যানজট আর দুর্ভোগের জালে।
নগরজুড়ে চলছে ফিটনেস ও বৈধ কাগজপত্রবিহীন বাস, ট্রাক ও লেগুনার দৌরাত্ম্য। অভিযোগ রয়েছে, সম্প্রতি ঈদকে কেন্দ্র করে অবৈধভাবে নগরীতে ৩০টি নতুন বাস নামানো হয়েছে, যার একটিরও সঠিক রুট পারমিট নেই। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে এসব যানবাহনের বিরুদ্ধে কোনো দৃশ্যমান ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, নগরীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো—বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু সড়কের নিতাইগঞ্জ অংশ, ১নং রেলগেট, মেট্রো হলের মোড়, খানপুর ও চাষাড়ায় গড়ে উঠেছে একাধিক অবৈধ বাসস্ট্যান্ড। এসব জায়গায় ইচ্ছেমতো গাড়ি পার্কিং ও যাত্রী ওঠানামা করা হয়, প্রায় সময়ই রাস্তার মাঝখান দখল করে রাখা হয় বাস। এতে করে অন্যান্য যান চলাচল কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ে। এসব অবৈধ স্ট্যান্ডকে ঘিরে গড়ে উঠেছে চাঁদাবাজির বিশাল নেটওয়ার্ক। চাষাড়া ও ট্রাফিক পুলিশ ফাঁড়ির কতিপয় অসাধু সদস্য এবং প্রভাবশালী একটি মহল এর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত বলেও অভিযোগ উঠেছে।
নারায়ণগঞ্জের বাস সার্ভিসগুলোর তালিকা করলে দেখা যায়, এখানে অন্তত ২০-২৫টি কোম্পানি সক্রিয় রয়েছে। এদের মধ্যে সিটি বন্ধন, উৎসব পরিবহন, আনন্দ, হিমাচল, আল্লাহ ভরসা, দূরন্ত, বন্ধু ও বাঁধন পরিবহন অন্যতম। অধিকাংশ বাস কোম্পানির রুট পারমিট নেই, চালকদের বড় অংশের ড্রাইভিং লাইসেন্সও বৈধ নয়। এর পাশাপাশি শহরে দ্রুত বেড়ে উঠেছে লেগুনা সার্ভিস, যেগুলোর কাগজপত্র ও রেজিস্ট্রেশন নেই বললেই চলে। বেশিরভাগ লেগুনার চালকই অপ্রাপ্তবয়স্ক এবং ট্রাফিক আইনের কোনো তোয়াক্কা করেন না।
চাষাড়া থেকে সাইনবোর্ড, মোক্তারপুর, ফতুল্লা পর্যন্ত এইসব লেগুনা চলাচল করে একপ্রকার বেপরোয়াভাবে। যাত্রী নিরাপত্তা, সড়ক শৃঙ্খলা ও ট্রাফিক ব্যবস্থা এইসব যানবাহনের কারণে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে।
এই পরিস্থিতি নিয়ে নাম প্রকাশ নয়া করার শর্তে একজন ট্র্যাফিক কর্মকর্তা জানান, “ট্রাকস্ট্যান্ড, বাসস্ট্যান্ড ও লেগুনাগুলো থেকে পুলিশ এবং বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নামে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা চাঁদা তোলা হচ্ছে। অথচ পঞ্চবটি এলাকায় ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণ করা হলেও চালকেরা সেখানে যান না। রাস্তার উপরেই ট্রাক দাঁড় করিয়ে মাল লোড-আনলোড করা হচ্ছে।”
এদিকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাঝে মাঝে অভিযান পরিচালনা করা হলেও তা স্থায়ী সমাধান আনতে পারছে না। সর্বশেষ ১৮ ফেব্রুয়ারি চাঁদমারি এলাকায় জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে পরিচালিত এক অভিযানে ৪টি ফিটনেসবিহীন বাস আটক করা হয় এবং ৬টি মামলায় মোট ২৮ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। সিনিয়র সহকারী কমিশনার মোঃ মোনাব্বর হোসেনের নেতৃত্বে এই অভিযান চালানো হয়।
তিনি জানান, “ আগে মৌমিতা, আসিয়ান ও বন্ধু পরিবহনের বাসগুলোর রুট পারমিট ও ফিটনেস না থাকায় তা ডাম্পিং করা হয়েছিলো। এখন আর এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। শহরের ফিটনেসবিহীন বাস মনিটরিংয়ের জন্য এ ধরনের অভিযান নিয়মিত চালানো প্রয়োজন।”
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু অভিযান নয়—এই সমস্যা সমাধানে দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রভাবশালী মহলের চাঁদাবাজি বন্ধ এবং শহরজুড়ে সুপরিকল্পিত গণপরিবহন নীতি। অন্যথায় যানজট, চাঁদাবাজি আর ফিটনেসবিহীন গাড়ির দাপটে নারায়ণগঞ্জ শহরবাসীর দুর্ভোগ ক্রমেই বাড়বে।
গত ৭ মে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে শহরের যানজট নিরসন সংক্রান্ত এক আইনশৃঙ্খলা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় অংশ নিয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, রুট পারমিট ও ফিটনেসবিহীন সকল বাস ডাম্পিংয়ে দেয়া হবে। দ্রুত আপনারা এসকল বাস সরিয়ে নিবেন। আমরা এগুলো কোন ভাবেই ছাড় দেব না। আমরা কারও প্রতি রুষ্ঠ হতে চাই না। আপনারা আজকে সিদ্ধান্ত নিবেন কী পরিমান আনসার আপনাদের প্রয়োজন। এটা আজকের মধ্যে আপনারা আমাদের জানাবেন।
তিনি বাস মালিকদের উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনাদের আর কতবার বলতে হবে রাস্তায় বাসগুলো রাখবেন না। আপনি চেঞ্জ করুন, অটোচালকের কথা কেন আপনি বলবেন। চেম্বার অনেকগুলো প্রস্তাব দিয়েছে সেই প্রস্তাব নিয়ে আমরা কাজ করবো। আমরা তাদের প্রস্তাবগুলো দেখেছি। তারা খুব ভাল প্রস্তাব দিয়েছে। আমাদের প্রতিনিয়ত সমস্যা আসবে এবং তার সমাধান করতে হবে। তবে আমাদের আইনের আওতায় থেকে কাজ করতে হবে। আপনি যদি ভাবেন আবেগ দিয়ে আইনকে প্রভাবিত করবেন সে সুযোগ আইনেও নেই, আমার কাছেও নেই।’
সাধারণ মানুষের দাবি এখন একটাই, শুধু কথা নয় কাজ চাই। অবৈধ স্ট্যান্ড উচ্ছেদ, চাঁদাবাজি বন্ধ এবং প্রশাসনের কার্যকর নজরদারি—এই তিনটি পদক্ষেপ বাস্তবায়ন হলে তবেই হয়তো রাস্তায় নামতে স্বস্তি পাবে এই শহরের লাখো যাত্রী।