ছেলের মুখে বাবা ডাক শোনা হয়নি শহীদ জামালের
ছেলের মুখে বাবা ডাক শোনা হয়নি শহীদ জামালের

- আপডেট সময় : ০৪:২৫:৩০ অপরাহ্ন, সোমবার, ২১ জুলাই ২০২৫
- / ৩৯ জন পড়েছেন
সোজাসাপটা রিপোর্ট
মাত্র ২৭ বছর বয়সে জীবন দিয়ে শহীদের গৌরবের মালা পরেছেন পটুয়াখালীর সন্তান মোঃ শাহ জামাল ভূঁইয়া। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের এক বীর যোদ্ধা, যিনি ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই নারায়ণগঞ্জের জালকুড়ি বাসস্ট্যান্ডে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর গুলিতে নির্মমভাবে প্রাণ হারান। ছোট একটি মুরগির দোকানের মালিক জামাল সেইদিন স্ত্রীর সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলেন, ছেলের একটি ছবি দেখতে চেয়েছিলেন, মনটা ছেলের জন্য ছটফট করছিল। কথাটি শেষ হওয়ার আগেই গুলি লাগে কোমরের নিচে। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। স্ত্রী তখনও ফোনের ওপাশে চিৎকার শুনতে পান। এরপর আর কোনও কথা হয়নি।
জামালের গল্প শুধু একটি ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়, এটি এক রাষ্ট্রীয় বর্বরতার প্রমাণ, যেখানে জীবন মূল্যহীন, যেখানে প্রতিবাদের দাম জীবন দিয়ে দিতে হয়।
জামাল জন্মগ্রহণ করেন ১৯৯৭ সালে পটুয়াখালী জেলার রাঙাবালি থানার বড়বাইশদিয়া ইউনিয়নে। বাবা মরহুম মো: হারুল ও মা মেহেরজান বিবির ছয় সন্তানের মধ্যে তিনিই ছিলেন সবার ছোট। অভাব-অনটনের সংসারে বড় দুই ভাইয়ের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জে এসে একটি মুরগির দোকান খোলেন। সেখান থেকেই চলে যেত গোটা পরিবারের খরচ। পিতার মৃত্যু, তিন বোনের বিয়ে, মায়ের গ্রামে একাকী জীবন। সব কিছুর ভার জামালের কাঁধে।
তিন ভাইয়ের যৌথ আয়েই গ্রামে নির্মিত হয় একটি আধাপাকা টিনশেড ঘর। কিন্তু বসতভিটা ছাড়া আর কোনও জমি বা স্থায়ী সম্পদ নেই। জামাল তার ছোট সংসার ও পুত্র ইয়াসিনকে নিয়ে গড়েছিলেন স্বপ্ন। ছেলেকে বড় হাফেজ বানাবেন, মানুষের মতো মানুষ করবেন। সেই স্বপ্ন আজ শুধু তার স্ত্রী মানসুরার চোখে ঝাপসা স্মৃতি হয়ে রয়ে গেছে।
২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় স্ত্রীকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন জামাল। সেখান থেকে আবার জীবিকার তাগিদে ফিরে আসেন নারায়ণগঞ্জে। ১৯ জুলাই বিকেল ৪টায় দোকানে ফিরে স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছিলেন ফোনে। বলেন, “ছেলেটারে দেখতে মন চায়, একটা ছবি দে।” ঠিক সেই সময় রাষ্ট্রীয় বাহিনীর গুলি এসে ছিন্নভিন্ন করে দেয় তার কোমরের নিচের অংশ। রক্তে ভেসে যায় দোকানের সামনের মাটি।
তাকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয়, কিন্তু সেই সময় হাসপাতালের পরিস্থিতিও ছিল শোচনীয়। চারদিকে গুলিবিদ্ধ মানুষ, বারান্দা ভর্তি আহতদের আহাজারি। সন্ধ্যা ৭:৩০-এ তাকে মৃত ঘোষণা করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক। ২০ জুলাই ময়নাতদন্ত শেষে লাশ বুঝিয়ে দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ২১ জুলাই জানাজা শেষে তাকে পটুয়াখালীর নিজ গ্রামে দাফন করা হয়।
স্বামী হারিয়ে কেবল ১৮ বছরের তরুণী মানসুরা আক্তার এখন বিধবা। কোলে একমাত্র সন্তান ইয়াসিন। শহীদের স্ত্রী মানসুরার কথায় উঠে আসে অপূর্ণ স্বপ্ন আর ভয়াবহ বাস্তবতা,
“ও প্রায়ই কইতো, ইয়াসিনরে বড় হাফেজ বানামু। ভালো জায়গায় পড়ামু। ওর জন্য টাকা জমাই। এখন ওর মুখে বাবা ডাক শোনার জন্য অস্থির আছিল। ইয়াসিন এখন মাঝেমধ্যে ওর কাকারে বাবা ডাকে।”
ছেলের মৃত্যুর কথা বলতে গিয়ে জামালের বড় ভাই আলমাস বলেন,
“আমি ভাইটারে আইতে নিষেধ করছিলাম। কিন্তু ও বললো, ভাই ব্রাদাররা আন্দোলন করতাছে, কিছু হইবো না। যাওনের ঘণ্টাও পার হয় নাই, বাজার থেকে ফোন আসে, আপনার ভাই গুলিবিদ্ধ। পায়ে গুলি মনে করছিলাম, বাঁচবো। ঢাকা মেডিকেলে নেয়ার পথে ও বলল, ভাই, আমি বাঁচুম না। ইয়াসিনরে দেখবা। কালিমা পড়ে ও রাস্তাতেই মারা গেল।”
তিনি জানান, সরকার থেকে আর্থিক সহায়তা পাওয়া গেছে। জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ ও জেলা পরিষদ থেকে ২ লাখ টাকা। এই টাকাগুলো ইয়াসিন ও মা মেহেরজান বিবির নামে ব্যাংকে জমা রাখা হয়েছে।
জামালের মা মেহেরজান এখনো ছেলের নাম শুনলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। একবুক অভিমান, একবুক শোক নিয়ে তিনি বলেন,
“আমার ছেলে দুপুরে ভাত খাইয়া দোকানে গেছিল। দোকানে না গেলে ঘরে খাওন আসতো না। দোকানের ভেতরেই গুলি কইরা ওরে মারছে। আমার ছেলের বিচার চাই। যারা আমার দুধের বাচ্চারে এতিম বানাইছে, তাদের বিচার চাই।”
এই শহীদজীবনের শেষ অধ্যায় যেন এক মহা-অভিযোগ রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে। যেখানে একজন যুবক মুরগির দোকান চালিয়ে পরিবার চালাতেন, ছেলের জন্য স্বপ্ন দেখতেন, স্ত্রীকে ভালোবাসতেন—সেই যুবককে কোনো কারণ ছাড়াই গুলি করে হত্যা করা হলো, শুধুমাত্র সে একটি অন্যায় রাষ্ট্রের বিরোধিতা করেছিল বলে।
শহীদ জামালের গল্প একাধিক সত্য তুলে ধরে। দেশে মানুষের জীবন কতটা সস্তা, প্রতিবাদের দাম কতটা ভয়ানক, এবং এই জাতি কিভাবে নিজের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হারাচ্ছে একের পর এক। এই মৃত্যু কেবল একটি পরিবারের জন্য শোক নয়, সমগ্র জাতির জন্য এক বিবেকের প্রশ্ন।
আজও জালকুড়ি বাজারের সামনে সেই রক্তাক্ত দোকানটি বন্ধ পড়ে আছে। মানুষ জানে, সেখানে কোনো এক বিকালে জামাল নামের এক তরুণ ফোনে স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছিলেন, ছেলের ছবি দেখতে চেয়েছিলেন। আর কখনও তিনি কিছু দেখতে পাননি। ইয়াসিন এখন দেড় বছরে পা দিয়েছে। আধো আধো বোলে ডাকে—“বাবা”। কিন্তু বাবা নেই। এই ডাক শুধু বাতাসে ভেসে বেড়ায়—নিরুত্তর, নিস্তব্ধ, ন্যায়বিচারহীন রাষ্ট্রের দিকে চেয়ে থাকে।