ঢাকা ০৬:৪৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ০১ অগাস্ট ২০২৫, ১৭ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :

অনিরাপদ ঢাকা-না.গঞ্জ লিংক রোড!

 সাব্বির হোসেন
  • আপডেট সময় : ০৩:১৪:৩৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই ২০২৫
  • / ৩৫ জন পড়েছেন

ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড একটি সময় ছিল যেটি ছিল শিল্পাঞ্চলের প্রাণ। প্রতিদিন হাজার হাজার শ্রমিক, চাকরিজীবী, শিক্ষার্থী আর সাধারণ মানুষ এই রোড ব্যবহার করে চলাফেরা করতেন নির্বিঘেœ। কিন্তু সময় বদলেছে। এখন সন্ধ্যা নামতেই লিংক রোড যেন রূপ নেয় এক বিভীষিকাময় ছিনতাই ও সন্ত্রাসের স্বর্গরাজ্যে। হাতে চাপাতি, আগ্নেয়াস্ত্র হাতে একদল দুর্বৃত্ত এই সড়কটিকে পরিণত করেছে একটি মুক্ত ছিনতাই অঞ্চল হিসেবে। কোথাও নেই পুলিশের টহল, কোথাও নেই সিসিটিভি ক্যামেরা,সড়ক জুড়ে অন্ধকার আর এই সুযোগেই রাতের আঁধারে নগরবাসীর স্বপ্নভঙ্গ করছে একের পর এক ভয়াবহ অপরাধ।
নারায়ণগঞ্জের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ততম এই সড়কটিকে ঘিরে বহু শিল্প কারখানা, আবাসিক এলাকা ও ছোট বড় বাজার গড়ে উঠেছে। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে এই এলাকা হয়ে ওঠে নিরাপত্তাহীনতার প্রতীক। স্থানীয়রা বলছেন, রাত ৯টার পর কেউ যদি সাহস করে রাস্তায় নামে, তাহলে নিশ্চিতভাবে সে ডাকাতি কিংবা ছিনতাইয়ের শিকার হবে।
রুবেল হোসেন নামে এক গার্মেন্টস কর্মী জানান, পাঁচদিন আগেই রাত সাড়ে ৯টায় ফ্যাক্টরি থেকে ফেরার সময় জালকুড়ি সংলগ্ন এলাকায় আমাকে আটকায় তিনজন যুবক। একজনের হাতে চাপাতি, আরেকজন কোমরে পিস্তল। মোবাইল, মানিব্যাগ, এমনকি আমার গলায় থাকা সোনার চেইনটাও নিয়ে যায়।
কয়েকটি ঘটনাতে ছিনতাইয়ের পাশাপাশি হত্যাকা-েরও প্রমাণ পাওয়া গেছে। গত কয়েকমাসেই এই সড়কে ছিনতাইকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু খুনে ঘটনা ঘটে। এ ধরনের অপরাধী চক্র দীর্ঘদিন ধরেই এলাকায় সক্রিয়, কিন্তু স্থানীয় থানা প্রশাসন শুধু আশ্বাসই দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না!
স্থানীয় সচেতন নাগরিকরা বলছেন, লিংক রোডের অপরিকল্পিত অবকাঠামো, সড়কের দুপাশে ঝোপঝাড় ও অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ ছিনতাইকারীদের জন্য এক আদর্শ পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছে।
লিংক রোডের আশপাশে থাকা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো সন্ধ্যার আগেই দোকান বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছে। যাত্রী পরিবহন কমে গেছে রাত ৯টার পর। রাইড শেয়ারিং অ্যাপ চালকেরা এই রোডে অর্ডার নিতে ভয় পাচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রেই নারী যাত্রীদের উদ্দেশ্য করে অশ্লীল মন্তব্য কিংবা অনুসরণ করার ঘটনাও ঘটছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
বন্ধন পরিহনের এক বাসচালক বলেন, এই রোডে রাতে গাড়ি চালানো মানে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা। প্রতি সপ্তাহেই কোনও না কোনও যাত্রী বা হেল্পার ছিনতাইয়ের শিকার হয়। দুই সপ্তাহ আগে এক সহকর্মীকে ছুরিকাঘাত করে মোবাইল নিয়ে যায়।
সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এত অপরাধের পরেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। শুধু মাঝে মাঝে কিছু লোককে ধরা হয়, কয়েকদিন পরেই জামিনে বেরিয়ে আসে।
ফতুল্লা থানার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা প্রতিদিন প্যাট্রোল করি, কিন্তু পুরো লিংক রোড কভার করা সম্ভব নয়। আমাদের জনবল সংকট রয়েছে। তবে আমরা অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নিই।
এখানে সন্ধ্যার পর একা চলাফেরা করা তো দূরের কথা, নারী যাত্রীদের জন্য রিকশা, বাস বা প্রাইভেট গাড়িতেও নিরাপত্তা নেই। অনেক সময় গাড়ি থামিয়ে ছিনতাইকারীরা গাড়ির ভেতরেও ঢুকে পড়ে। বিশেষত জালকুড়ি বাস স্যান্ড পার হলেই ফতুল্লা স্টেডিয়ামের সামনের সড়কে ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।
শামীমা আক্তার, স্থানীয় কলেজের শিক্ষার্থী বলেন, আমি এখন সন্ধ্যার পর টিউশনি ছেড়ে দিয়েছি। রাস্তায় নামতে ভয় হয়। বাবা নিজে এসে নিয়ে না গেলে বাসায় ফেরা সম্ভব হয় না।
বিশ্লেষকদের মতে, নি¤েœাক্ত পদক্ষেপগুলো দ্রুত না নেওয়া হলে এই সড়কটি একসময় হবে একমাত্র অপরাধীরাই ব্যবহার করে এমন একটি অঞ্চল:পূর্ণ দৈর্ঘ্যে এলইডি স্ট্রিট লাইট স্থাপন,নিরাপত্তার জন্য, সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন ও নিয়মিত মনিটরিং, প্রতিদিন অন্তত তিনবার মোবাইল টহল ব্যবস্থা, পথচারী পারাপারের জন্য নির্ধারিত পয়েন্ট এবং পুলিশ বুথ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের হস্তক্ষেপ ও নজরদারি।
তারা আরও বলেন, নারায়ণগঞ্জ শহরের অন্যতম প্রধান প্রবেশপথ হিসেবে পরিচিত ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড এখন এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের নাম। যারা প্রতিদিন এই পথ ব্যবহার করেন, তাদের জন্য দিনশেষে বেঁচে ফেরা যেন এক আশীর্বাদ। কিন্তু কতদিন? কত প্রাণ হারালে নড়বে প্রশাসন? এই প্রশ্ন এখন প্রতিটি পথচারী, ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থী ও সাধারণ নাগরিকের।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুমদার বলেন, আমাদের টহল টিম প্রতিনিয়ত এই সড়কে থাকে প্রয়োজনে নিরাপত্তা আরও কঠোর করা হবে এবং অপরাধীদের দ্রুত গ্রেফতার করা হবে।

ট্যাগ :

সংবাদটি সোস্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন

অনিরাপদ ঢাকা-না.গঞ্জ লিংক রোড!

আপডেট সময় : ০৩:১৪:৩৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই ২০২৫

ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড একটি সময় ছিল যেটি ছিল শিল্পাঞ্চলের প্রাণ। প্রতিদিন হাজার হাজার শ্রমিক, চাকরিজীবী, শিক্ষার্থী আর সাধারণ মানুষ এই রোড ব্যবহার করে চলাফেরা করতেন নির্বিঘেœ। কিন্তু সময় বদলেছে। এখন সন্ধ্যা নামতেই লিংক রোড যেন রূপ নেয় এক বিভীষিকাময় ছিনতাই ও সন্ত্রাসের স্বর্গরাজ্যে। হাতে চাপাতি, আগ্নেয়াস্ত্র হাতে একদল দুর্বৃত্ত এই সড়কটিকে পরিণত করেছে একটি মুক্ত ছিনতাই অঞ্চল হিসেবে। কোথাও নেই পুলিশের টহল, কোথাও নেই সিসিটিভি ক্যামেরা,সড়ক জুড়ে অন্ধকার আর এই সুযোগেই রাতের আঁধারে নগরবাসীর স্বপ্নভঙ্গ করছে একের পর এক ভয়াবহ অপরাধ।
নারায়ণগঞ্জের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ততম এই সড়কটিকে ঘিরে বহু শিল্প কারখানা, আবাসিক এলাকা ও ছোট বড় বাজার গড়ে উঠেছে। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে এই এলাকা হয়ে ওঠে নিরাপত্তাহীনতার প্রতীক। স্থানীয়রা বলছেন, রাত ৯টার পর কেউ যদি সাহস করে রাস্তায় নামে, তাহলে নিশ্চিতভাবে সে ডাকাতি কিংবা ছিনতাইয়ের শিকার হবে।
রুবেল হোসেন নামে এক গার্মেন্টস কর্মী জানান, পাঁচদিন আগেই রাত সাড়ে ৯টায় ফ্যাক্টরি থেকে ফেরার সময় জালকুড়ি সংলগ্ন এলাকায় আমাকে আটকায় তিনজন যুবক। একজনের হাতে চাপাতি, আরেকজন কোমরে পিস্তল। মোবাইল, মানিব্যাগ, এমনকি আমার গলায় থাকা সোনার চেইনটাও নিয়ে যায়।
কয়েকটি ঘটনাতে ছিনতাইয়ের পাশাপাশি হত্যাকা-েরও প্রমাণ পাওয়া গেছে। গত কয়েকমাসেই এই সড়কে ছিনতাইকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু খুনে ঘটনা ঘটে। এ ধরনের অপরাধী চক্র দীর্ঘদিন ধরেই এলাকায় সক্রিয়, কিন্তু স্থানীয় থানা প্রশাসন শুধু আশ্বাসই দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না!
স্থানীয় সচেতন নাগরিকরা বলছেন, লিংক রোডের অপরিকল্পিত অবকাঠামো, সড়কের দুপাশে ঝোপঝাড় ও অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ ছিনতাইকারীদের জন্য এক আদর্শ পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছে।
লিংক রোডের আশপাশে থাকা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো সন্ধ্যার আগেই দোকান বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছে। যাত্রী পরিবহন কমে গেছে রাত ৯টার পর। রাইড শেয়ারিং অ্যাপ চালকেরা এই রোডে অর্ডার নিতে ভয় পাচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রেই নারী যাত্রীদের উদ্দেশ্য করে অশ্লীল মন্তব্য কিংবা অনুসরণ করার ঘটনাও ঘটছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
বন্ধন পরিহনের এক বাসচালক বলেন, এই রোডে রাতে গাড়ি চালানো মানে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা। প্রতি সপ্তাহেই কোনও না কোনও যাত্রী বা হেল্পার ছিনতাইয়ের শিকার হয়। দুই সপ্তাহ আগে এক সহকর্মীকে ছুরিকাঘাত করে মোবাইল নিয়ে যায়।
সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এত অপরাধের পরেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। শুধু মাঝে মাঝে কিছু লোককে ধরা হয়, কয়েকদিন পরেই জামিনে বেরিয়ে আসে।
ফতুল্লা থানার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা প্রতিদিন প্যাট্রোল করি, কিন্তু পুরো লিংক রোড কভার করা সম্ভব নয়। আমাদের জনবল সংকট রয়েছে। তবে আমরা অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নিই।
এখানে সন্ধ্যার পর একা চলাফেরা করা তো দূরের কথা, নারী যাত্রীদের জন্য রিকশা, বাস বা প্রাইভেট গাড়িতেও নিরাপত্তা নেই। অনেক সময় গাড়ি থামিয়ে ছিনতাইকারীরা গাড়ির ভেতরেও ঢুকে পড়ে। বিশেষত জালকুড়ি বাস স্যান্ড পার হলেই ফতুল্লা স্টেডিয়ামের সামনের সড়কে ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।
শামীমা আক্তার, স্থানীয় কলেজের শিক্ষার্থী বলেন, আমি এখন সন্ধ্যার পর টিউশনি ছেড়ে দিয়েছি। রাস্তায় নামতে ভয় হয়। বাবা নিজে এসে নিয়ে না গেলে বাসায় ফেরা সম্ভব হয় না।
বিশ্লেষকদের মতে, নি¤েœাক্ত পদক্ষেপগুলো দ্রুত না নেওয়া হলে এই সড়কটি একসময় হবে একমাত্র অপরাধীরাই ব্যবহার করে এমন একটি অঞ্চল:পূর্ণ দৈর্ঘ্যে এলইডি স্ট্রিট লাইট স্থাপন,নিরাপত্তার জন্য, সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন ও নিয়মিত মনিটরিং, প্রতিদিন অন্তত তিনবার মোবাইল টহল ব্যবস্থা, পথচারী পারাপারের জন্য নির্ধারিত পয়েন্ট এবং পুলিশ বুথ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের হস্তক্ষেপ ও নজরদারি।
তারা আরও বলেন, নারায়ণগঞ্জ শহরের অন্যতম প্রধান প্রবেশপথ হিসেবে পরিচিত ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড এখন এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের নাম। যারা প্রতিদিন এই পথ ব্যবহার করেন, তাদের জন্য দিনশেষে বেঁচে ফেরা যেন এক আশীর্বাদ। কিন্তু কতদিন? কত প্রাণ হারালে নড়বে প্রশাসন? এই প্রশ্ন এখন প্রতিটি পথচারী, ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থী ও সাধারণ নাগরিকের।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুমদার বলেন, আমাদের টহল টিম প্রতিনিয়ত এই সড়কে থাকে প্রয়োজনে নিরাপত্তা আরও কঠোর করা হবে এবং অপরাধীদের দ্রুত গ্রেফতার করা হবে।