ভুইগড়ে গুলিবিদ্ধ হন পারভেজ
আ.লীগ-প্রশাসনের চাপে রাতের আধারে দাফন

- আপডেট সময় : ০২:২৭:০৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৩ জুলাই ২০২৫
- / ৭৬ জন পড়েছেন
পারিবারিক দারিদ্র্য ঘোচাতে, বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে, বোনদের পাশে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন পারভেজ। কিন্তু সকল স্বপ্ন আর সংগ্রাম থেমে গেল গত ১৯ জুলাই পুলিশের গুলিতে। নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড-সানারপাড় এলাকায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নিয়ে শহীদ হলেন ২৩ বছর ৬ মাস ৮ দিন বয়সের এই তরুণ। তার মৃত্যু শুধু একটি জীবনকে নিভিয়ে দেয়নি, একটি পরিবারের স্বপ্নকেও গুঁড়িয়ে দিয়েছে।
কুমিল্লার মুরাদনগরের রামচন্দ্রপুর উত্তর ইউনিয়নের আমিননগর গ্রামের সন্তান পারভেজের পরিবার প্রায় ৩০ বছর আগে জীবিকার তাগিদে এলাকা ছেড়ে ঢাকার সানারপাড়ে চলে আসে। বাবা সোহরাব হোসেন বয়সের ভারে এখন কর্মহীন। সংসার চালাতেন মা পারভীন বেগম, যিনি একটি পোশাক কারখানার শ্রমিক। দুই বোন পাপিয়া ও পপি কলেজে পড়ালেখার পাশাপাশি মায়ের সঙ্গে একই কারখানায় কাজ করতেন। তাদের উপার্জনেই ভাই পারভেজ পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছিলেন নারায়ণগঞ্জের সিসিএন মডেল কলেজে ডিগ্রি কোর্সে।
পারভেজের বড় বোন পাপিয়া জানান, “আমরা নিজেরা ছোট হয়ে বড় ভাইয়ের লেখাপড়ার খরচ চালাতাম। আশা ছিল, ভাই পড়াশুনা শেষ করে সংসারের হাল ধরবে।” কিন্তু ১৯ জুলাই সেই আশা গুলির শব্দে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।
সেদিন দুপুরের খাবারের পর কাউকে না জানিয়ে পারভেজ স্থানীয় ভূইগড় এলাকায় একটি ছাত্র-জনতার মিছিলে যোগ দেন। আন্দোলন চলছিল শান্তিপূর্ণভাবেই। হঠাৎ এসবি গার্মেন্টসের সামনে থেকে পুলিশের ছোড়া এলোপাতাড়ি গুলিতে আহত হন পারভেজসহ ৭-৮ জন। আশঙ্কাজনক অবস্থায় পথচারীরা তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে তার শরীরে গুলির চিহ্ন স্পষ্ট ছিল—বুক, পিঠ, কোমরসহ সারা দেহে। প্রচুর রক্তক্ষরণে অচেতন হয়ে পড়েন তিনি। চিকিৎসকরা আপ্রাণ চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারেননি। ২০ জুলাই দুপুরে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
১২ নং উত্তর রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের যুবদলের সভাপতি ও আমিননগর এলাকার বাসিন্দা গিয়াস উদ্দিন বলেন, পারভেজ ছিলো অত্যন্ত ভালো ছেলে। ঢাকায় থাকলেও প্রায় সময় এলাকায় আসতেন।
তিনি জানান, তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে পরিবারে নেমে আসে শোকের মাতম। সহপাঠীরা মরদেহ এলাকায় পৌঁছে দেয় রাত ১০টার পর। পরিবারের ইচ্ছে ছিলো দূরের আত্মীয় স্বজনরা আসলে সকালে জানাজা দেয়া হবে। কিন্তু স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও পুলিশের চাপে তাকে গভীর রাতেই দাফন করতে হয়েছে। তিনি দুঃখপ্রকাশ করে বলেন, পারভেজের কবরে লাগানো জাতীয় পতাকা সকালে এসে খুলে নিয়ে যায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। যা এলাকাবাসীর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে।
পারভেজের বাবা সোহরাব হোসেন বলেন, “আমার ছেলের মতো পরিণতি যেন আর কারো সন্তানের না হয়। সে প্রতিবাদী ছিল, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতো। আমি নিষেধ করতাম, তবুও সে মিছিলে যেতো।”
মায়ের মুখেও অসীম বেদনার সুর, “ভেবেছিলাম ছেলেটা মানুষ হবে। আমাদের একটু ভালো রাখবে। কিন্তু আমার বুক খালি করে দিল ওরা।”
পারভেজের মৃত্যুতে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে ২ লাখ টাকা এবং সাবেক প্রতিমন্ত্রী কায়কোবাদের পক্ষ থেকে ৫০ হাজার টাকা সহযোগিতা পেয়েছে পরিবারটি। পাশাপাশি কায়কোবাদের পক্ষ থেকে প্রতি মাসে ২ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া হচ্ছে।
বাবা সোহরাব হোসেন বাদী হয়ে গত বছরের ২২ আগষ্ট ফতুল্লা থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলার এজাহারে উল্লেখ করেন, ১৯ জুলাই বিকেলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নির্দেশে নারায়ণগঞ্জের সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমান, নজরুল ইসলাম ও গোলাম দস্তগীর গাজী, শামীম ওসমানের ভাতিজা আজমেরী ওসমান, শ্যালক তানভীর আহমেদসহ (টিটু)সহ ১৭৮ জন এবং অজ্ঞাতনামা আরও ৮০ জন আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। শামীম ওসমানের নির্দেশে আসামিরা ককটেল বিস্ফোরণ ও গুলি করেন। পারভেজ ওই স্থান অতিক্রম করার সময় অয়ন ওসমান অস্ত্র দিয়ে গুলি করেন। গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলে তাঁর মৃত্যু হয়। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ গিয়ে ছেলের মরদেহ শনাক্ত করেন বাদী।
তবে হত্যার বিচার হয়নি। হত্যা মামলা দায়ের করলেও সেটি এখনও তদন্ত বা বিচার প্রক্রিয়ার আলো দেখেনি। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “আমার ছেলের হত্যাকারীদের বিচার চাই। এখনো কিছুই হয়নি।”
১২ নম্বর উত্তর রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের যুবদল সভাপতি গিয়াস উদ্দিন বলেন, “পারভেজ খুবই ভদ্র ও সচেতন ছেলে ছিলো। তার মতো ছেলেকে আমরা হারালাম। তাকে গভীর রাতে দাফন করতে বাধ্য করা হয়েছে, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক।”
মুরাদনগর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কামাল উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, “পারভেজের পরিবার একেবারেই নিঃস্ব। আমরা দলীয়ভাবে তাদের পাশে আছি। এবং আমরা এই হত্যার বিচার চাই।”
মুরাদনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আবদুর রহমান বলেন, “শহীদ পরিবারের সঙ্গে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে। নতুন কোনো সরকারি নির্দেশনা এলে তা বাস্তবায়ন করা হবে।”
পারভেজ ২০০১ সালের ১১ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জের ভূইগড় এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। মামুদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি, আনন্দলোক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং সিসিআরই মডেল কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। মৃত্যুকালে তিনি সরকারি তোলারাম কলেজে ডিগ্রি ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন।
সেই স্বপ্নের ছেলেটি, যে বোনদের বিয়ে দিবে, পুরনো ঘর মেরামত করবে, বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোটাবে, সে এখন কবরেই চিরনিদ্রায়